কোভিড-১৯ এর সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্ক কী?
কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে আক্রান্তদের মধ্যে কাদের ঝুঁকি বেশি এসংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্যই ছিলোনা চিকিৎসকদের কাছে।
অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে কাদের ঝুঁকি বেশি এবং কিধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা ও পরিচর্যার প্রয়োজন এসংক্রান্ত তথ্য থাকায় নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন চিকিৎসকরা। একারণেই বিশ্বজুড়ে গবেষকরা হাসপাতালগুলো থেকে সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের অসুস্থ হওয়ার প্রবণতার পেছনের বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করেছেন।
এধরণের কারণ অনুসন্ধানের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য ধরা হয় রক্তের গ্রুপকে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের বেশি অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা ও মৃত্যুঝুঁকির সাথে রক্তের গ্রুপের কিছুটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেলেও; শুধু রক্তের গ্রুপের কারণেই কোনো রোগীকে অগ্রাধিকার দেয়ার মতো নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। আক্রান্ত হওয়ার পর রক্তের গ্রুপ দ্বারা ঝুঁকি পরিমাপও উচিৎ নয়। তবে সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের সামান্য এ সম্পর্ক ভাইরাসটি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
রক্তের গ্রুপের তুলনা
এ, বি, এবি এবং ও গ্রুপ নিয়ে কোভিড-১৯ এর গুরুতর প্রভাব ও রক্তের গ্রুপ সম্পর্কিত গবেষণা হয়েছে। রক্তের গ্রুপের মাধ্যমে কিধরণের অ্যান্টিজেন-প্রোটিন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে তার ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে মানবদেহের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে তার ধারণাও পাওয়া যায়।
পূর্বের সার্স ভাইরাসের কম ঝুঁকির সাথে রক্তের 'ও' গ্রুপের সম্পর্ক আছে। 'এ' গ্রুপের অধিকারীরা হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকিতে থাকেন।
সার্স-কোভ-২ এর সাথেও রক্তের গ্রুপের এমন সম্পর্ক আছে কিনা তা জানতেই চীন, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আরও কিছু দেশের গবেষকদল অনুসন্ধান চালান।
সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসক মাইকেল হাল্টস্ট্রম ও তার দল দেখতে পান, অধিক মৃত্যুঝুঁকির সাথে রক্তের 'এ' এবং 'এবি' গ্রুপের সম্পর্ক আছে। 'এবি' গ্রুপের রোগীদের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি দেখা যায়, 'এ' গ্রুপের রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি 'এবি' গ্রুপের চেয়ে কম হলেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর দেহে টিউব ঢোকানোর প্রয়োজন পড়ে।
তবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রক্তের গ্রুপের পার্থক্য খুব বেশি নয়। নিউইয়র্কের গবেষকদলের অনুসন্ধানে দেখা যায়, 'এ' গ্রুপের রোগীদের ক্ষেত্রে দেহে টিউব ঢোকানোর মতো পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি থাকে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ; অন্যদিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া 'ও' গ্রুপের রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির হার ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ দুইটি গ্রুপের রোগীদের ঝুঁকির পার্থক্য ২ দশমিক ৯ শতাংশ। 'এবি' গ্রুপের রোগীদের 'ও' গ্রুপের রোগীদের তুলনায় মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বায়োমেডিকাল ইনফরম্যাটিক্স গবেষক নিকোলাস টাটোনেটি এব্যাপারে জানান, কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরিধান করাই এখন পর্যন্ত প্রমাণিত সর্বোত্তম পন্থা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগীর পরিচর্যা বা নির্দিষ্ট কিছু রোগীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেয়ার জন্য রক্তের গ্রুপের সম্পর্কের প্রমাণ এখনো যথেষ্ট নয়।
অন্যান্য ব্যাখ্যা
গবেষণায় উঠে আসা কোভিড-১৯ ঝুঁকির সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্কের পেছনে রোগীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেরও ভূমিকা থাকতে পারে।
রক্তের গ্রুপের সাথে বংশগতিরও সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্লাডব্যাংকের রক্তদাতাদের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১২ শতাংশ 'বি' গ্রুপের ব্যক্তিদের ২৫ শতাংশই এশিয়ান। ৩৭ শতাংশ 'এ' গ্রুপের রক্তদাতাদের ২৬ শতাংশের কম কৃষ্ণাঙ্গ। তবে এ শ্রেণিবিন্যাসও জিনগত বংশানুক্রমের একাংশের প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যা মাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন ও কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষ কোভিড-১৯ এর কারণে বেশি ভুগেছেন, এর পেছনে চিকিৎসা ক্ষেত্রে জাতিগত বৈষম্য সহ আরও কিছু ব্যাপার কাজ করে। একারণে বলা যায়, গবেষণায় উঠে আসা রক্তের গ্রুপের সম্পর্কের পেছনে এসব কারণও কাজ করতে পারে।
নিকোলাস জানান, এব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে গবেষকদের আরও বিশাল সংখ্যক নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে এবং রক্তের গ্রুপ ও ডিএনএ বিশ্লেষণের সম্পর্কও খতিয়ে দেখতে হবে। অনেক সময়ই মানুষের ধারণার সাথে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের পার্থক্য দেখা যায়।
কোভিড-১৯ এর ঝুঁকির সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্কের পেছনে আরও জটিল জৈবিক প্রক্রিয়াও দায়ী হতে পারে।
নিউইয়র্কের গবেষণা দলের সাথে যুক্ত গবেষক মাইকেল জেইটজ জানান, 'রক্তের গ্রুপ ছাড়াও এক্ষেত্রে আরও কী কী ব্যাপার কাজ করছে আমরা এখনো তা বুঝতে পারিনি এমনটা হতেই পারে।"
রক্তের গ্রুপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি জিনই কাজ করে, আবার ওই একই ডিএনএ-ই অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ রক্তের গ্রুপ কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে না এমনও হতে পারে। এক্ষেত্রে অন্য কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্যেরও ভূমিকা থাকতে পারে।
রক্তের গ্রুপের সাথে সম্পর্ক থাকলেও ঠিক কীভাবে তা কাজ করে এব্যাপারেও এখনো গবেষকরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারেননি। এক্ষেত্রে হাল্টস্ট্রম ও অন্যান্য গবেষকদের প্রস্তাবিত তত্ত্ব হলো, নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্তের প্রোটিন সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের ক্ষেত্রে অধিক সহায়ক। আবার, অনেক কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা দেখা যায়, 'ও' গ্রুপ ছাড়া অন্য গ্রুপের রোগীদের এমনটা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এব্যাপারটিও গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
তবে কোভিড-১৯ এর গুরুতর প্রভাবের সাথে রক্তের গ্রুপের সম্পর্কের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া গেলে তা বাস্তব সমাধানের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।