কোভিড-১৯: ক্যামেরার নেপথ্যের মানুষেরা
কয়েক দশক আগেও বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারে ছবি তোলাই ছিল একটি বিশেষ উৎসব। রীতিমতো আয়োজন করে প্রস্তুতি নিয়ে পরিবার পরিজন সমেত স্টুডিওর বিশেষ কক্ষে বিশেষ ভাবে ধারণ করা হতো সেই সব ছবি।
কালের বিবর্তনে ক্যামেরায় পরিবর্তন এসেছে ধাপে ধাপে। রিলের ক্যামেরার পরবর্তী ধাপে এসেছে ডিজিটাল ক্যামেরা। যেখানে রিলের পরিবর্তে জায়গা দখল করে নিয়েছে মেমোরি কার্ড। সেই মেমোরি কার্ডেও এসেছে আধুনিকায়ন। শত শত ছবির পরিবর্তে এখন ধারণ করা যায় হাজারে হাজার ছবি। এরও উন্নত সংস্করণ হিসেবে আধুনিক ক্যামেরার রূপান্তর ঘটেছে স্মার্ট ফোনে। ক্যামেরা এসেছো হাতের মুঠোয়। এই কামেরা দিয়ে শুধুমাত্র স্থিরচিত্রই নয় এমনকি চলচ্চিত্রও ধারণ করা সম্ভব। তবুও বিশেষ দিন, বিশেষ উৎসবে, বিশেষভাবে ক্যামেরায় ছবি তোলার আয়োজন করা হয়, যা আগেও ছিল বাঙালীর একটি বিশেষ বিলাসিতা। এছাড়া, বাণিজ্যিকভাবে ছবি তোলার বিষয় তো ছিলই যা বর্তমানে ব্যাপকতা লাভ করেছে।
অতীতের সীমিত পরিসরের আলোকচিত্রীদের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন, এসেছে ব্যাপকতা। পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রও হয়েছে বিশেষায়ন। স্বভাবতই আধুনিক পেশাদার ক্যামেরার যুগে আলোকচিত্রও (ফটোগ্রাফি) জায়গা করে নিয়েছে যে কোন উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে। বর্তমান তরুনদের একটি অংশের জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠেছে একে কেন্দ্র করেই। এই করোনাকালীন এদের একটা বড় অংশ জীবিকা হারিয়েছেন আবার কেউ কেউ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কাজ করছেন সীমিত পরিসরে।
সালেহ আহমেদ, ৫২, নব্বইয়ের দশক থেকেই একাধারে পেশাদার ফটোগ্রাফার। পাশাপাশি ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি নীলক্ষেতে 'স্টুডিও ভিশন' – নামে স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেন। শুরুর দিকে স্টুডিওর পরিসর যেমন ছিল বিস্তৃত তেমনি স্টুডিও সংশ্লিষ্ট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রও ছিল ব্যাপক। আগে প্রতিদিনই একাধিক পরিবার স্টুডিওতে আসতেন পারিবারিক ছবি তুলতে। এছাড়া, প্রচুর অনুষ্ঠানের ছবি তোলার অর্ডার থাকতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, উদয়ন বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হওয়াতে ছাত্র-ছাত্রীদের ছবির পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের বিশেষ অনুষ্ঠানের ছবি তোলার কাজটিও ছিল নিয়মিতই। সেসব ছবি ল্যাব থেকে প্রিন্ট করানোর কাজটিও ছিল অন্যতম। তাছাড়া ল্যাব থেকে প্রিন্ট করানো ছবির মান ভালো হওয়া সত্ত্বেও তুলনামূলক খরচ বেশি হওয়াতে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহক কম্পিউটার প্রিন্টেড ছবিকেই প্রাধান্য দেন। পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় সকলের হাতে হাতে অত্যাধুনিক স্মার্টফোনের ক্যামেরাই হয়ে উঠেছে সেসব অনুষ্ঠানের ছবি তোলা ও সংরক্ষণের মূখ্য মাধ্যম। ফলে, কাজের ক্ষেত্র অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। তবুও, মোটামুটিভাবে চলছিল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত অফিসিলায় ছবি তোলা ও প্রিন্টের কাজ। পাশাপাশি, বিভিন্ন দেশের ভিসা আবেদনের জন্য ও পাসপোর্টের জন্য আবেদনের ছবি।
কিন্তু করোনা মহামারিতে সামগ্রিক ভাবেই হুমকির মুখে পড়েছে ব্যবসা।
সালেহ আহমেদ বলেন, আগে স্টুডিওতে কাজ করতাম চারজন, আর বর্তমানে কষ্টেসৃষ্টে মাত্র দু'জন। করোনার শুরুতে সরকারি আদেশে দু'মাস স্টুডিও পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এরপরে খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতে একেবারেই কাজ নেই। কোনোমতে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। করোনার আগে যেখানে দৈনিক আট থেকে দশ হাজারের ব্যবসা হতো এখন দুই হাজার হওয়াই কষ্টসাধ্য।
নীরব (ছদ্মনাম) একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর মাস্টার্সের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠানের হয়ে খন্ডকালীন আলোকচিত্রীর কাজ করতেন। করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়, কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় বাসা ভাড়া বহন করা হয়েছে উঠেছিল দুর্বিষহ। অগত্যা, জুন মাসের শুরুতে নীরব বাধ্য হয়েই গ্রামের বাড়ী চলে যান।
মোহাম্মদ কবীর, তার একমাত্র ছেলের চতুর্থ জন্মদিন পালন করলেন। এই বছর ইচ্ছে ছিল জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। ফটোগ্রাফারকে বলেও রেখেছিলেন। পরবর্তীতে করোনা সংক্রমণের কারণে সবকিছু বিবেচনা করে, বিশেষত পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা বিবেচনায় রেখে সীমিত পরিসরে ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই পালন করেন ছেলের জন্মদিন। স্বভাবতই পেশাদার ফটোগ্রাফী সংক্রান্ত আয়োজনটি বাতিল করতে হয়, শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্মার্টফোনই ছিল ভরসা।
এই বিষয়ে বাসসের সাথে আলাপকালে স্পেকট্রা ইমিটেশনের জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী রিফাত বিন আহসান বলেন, 'এই করোনাকালে মূলতঃ ঘরে বসে কাজ করেছি। প্রোডাক্ট শুট বা এ ধরনের ছোটোখাটো কাজ হয়েছে। বিয়ে বা এই ধরনের অনুষ্ঠানের কাজ পুরোপুরি বন্ধ। অনেকেই বর্তমান সময়ে অনলাইন ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন, ফলে প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফির সুযোগ মিলছে। খাবার-দাবার, মশলা, ক্র্যাফটিং, গিফট আইটেম, এসব পণ্যের কাজই বেশি আসছে এই সময়ে।'
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্পর্কে রিফাত বলেন, 'এটি অল্প সময়ে সম্ভব হবে না। মোটামুটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কা যাচ্ছে সবার উপর দিয়ে। সম্ভাব্য ক্লায়েন্টের বাজেটও এখন কম। তবে, দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থাকলে একটা ইমেজ তৈরি হয়, যেটা ভবিষ্যতে কাজে দেবে।
ফটোগ্রাফি শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে স্পেকট্রা ইমিটেশনের কর্ণধার ও প্রধান আলোকচিত্রী নাভিদ ফারহান বলেন, 'এই মুহূর্তে আলোকচিত্র শিল্প অন্যান্য শিল্পের মতোই মোটামুটি চ্যালেঞ্জিং একটা সময় পার করছে। অনেকের পাওনা টাকা আটকে গেছে। অনেকের এডভান্স বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। বড় কোম্পানীগুলো কমার্শিয়াল কাজের বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে, এতে কাজের মানের উপরেও যথেষ্ট প্রভাব পড়ছে। যারা ডেডিকেটেড তারা এখনো লেগে আছেন। একটা সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক হবে এই আশায় চর্চাটা ধরে রাখছেন।
আলোকচিত্র, স্থিরচিত্র, ফটোগ্রাফ, কিংবা ছবি, যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা হচ্ছে সময়ের আয়না। কখনো ইতিহাসের সাক্ষী, কখনো বা অতীতের প্রতিচ্ছবি। সময়কে ধরে রাখার এই শিল্প করোনার কঠিন সময় কাটিয়ে ক্যামেরার ক্লিক-ক্লিক শব্দে আর চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানিতে আবার তুমুলভাবে মূখর হয়ে উঠবে- এই প্রত্যাশাতেই আছেন সংশ্লিষ্ট সবাই