একজন রঘু রাই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও কিছু দুর্লভ ছবি
১৯৭১ সাল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে চলছে তখন অধিকার আদায়ের লড়াই। উদ্দেশ্য, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করা। 'বাংলাদেশ' নামের একটি স্বাধীন দেশ গড়ার লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া অবাক করে দেয় পুরো বিশ্বকে। যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সেই বীভৎস, অমানবিক, বর্বর আচরণে কেঁদেছে সাধারণ মানুষের মন। নিজের জায়গা ছেড়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয় অনেক নারী পুরুষকে। নতুন পরিচয়,তারা 'শরণার্থী'।
চারদিকে যখন যুদ্ধের এমন ভয়াবহ অবস্থা, বাঁচার তাগিদে মানুষের এদিক সেদিক ছুটোছুটি, ঠিক সে সময়ে মুক্তিবাহিনীদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তরুণ এক আলোকচিত্রী। ঘুরছেন দেশের এই প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার, অস্থিরতা, অমানবিকতার করুণ সব দৃশ্যপট ধারণ করছিলেন ক্যামেরা হাতে। যুদ্ধের মুহূর্ত ধারণে ছুটতে থাকা সেই আলোকচিত্রী আর কেউ নন, তিনি রঘু রাই। পুরো নাম, রঘুনাথ রাই চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধের চিত্রপট জীবন্ত হয়ে মানুষের কাছে ধরা পড়ে কিছু আলোকচিত্রীর ছবিতে। জীবনের তোয়াক্কা না করে তারা বিশ্বকে দেখিয়ে গেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। ছিল প্রাণসংহারের ঝুঁকিও। এতসব বুঝতে পারার পরেও সে সময় ছবি ধারণ করে গেছেন যারা, তাদের একজন কিংবদন্তী আলোকচিত্রী রঘু রাই।
তাঁর তোলা যুদ্ধের সে সময়ের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি দাগ কেটেছে মানুষের মনে। তাই নতুন করে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন বোধহয় নেই। ফটোগ্রাফির দুনিয়ার উজ্জ্বল এই মহারথী প্রত্যক্ষ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা। সে সময়ে সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ জীবনের অধ্যায় বরাবরই তাকে ব্যথিত করেছে। সাধারণ মানুষের নিজ দেশ ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করেছে গভীরভাবে। তার ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি সেই অনুভূতিই ব্যক্ত করে যায়। নতুন প্রজন্মকে সুযোগ করে দেয় যুদ্ধের সময়ে মানুষের আর্তনাদ, চাপা কান্না ও অসহায়ত্বের অদেখা জীবন দেখার। তাঁর তোলা প্রতিটি ছবিই বলে যায় অনেককিছু।
রঘু রাইয়ের ছবিতে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম, দেশের জন্য তাদের লড়াই, শরণার্থীদের হৃদয়বিদারক সব মুহুর্ত, ক্ষুধার্তদের আহার প্রাপ্তির হাহাকার, বিজয়ের আনন্দ- সমস্ত কিছুই ফুটে উঠেছে জীবন্তভাবে।
যুদ্ধের সময়ে তোলা রঘু রাইয়ের দুর্লভ কিছু ছবি নিয়েই গত ৫ই মে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় 'রাইজ অব এ ন্যাশন' শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। চলবে আগামী ১৯ মে পর্যন্ত। আর এই পুরো আয়োজনটি করা হয় দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।
যুদ্ধের সময়ে ছবি তোলার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রঘু রাই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যখন আমাকে দ্য স্টেটসম্যান (যেখানে আমি কাজ করতাম) থেকে বাংলাদেশ হতে আগত শরনার্থীদের ছবি তোলার জন্য নিয়োগ করা হলো, তখন আমার অবচেতন মনের কোথাও হয়তো শৈশবে নিজের শরণার্থী হয়ে যাওয়া এবং অজানা জায়গায় হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মাথায় ভর করে বসেছিলো। তাই যুদ্ধের সময়ে আমি পাগলের মত করে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ছবি তুলেছিলাম।'
কিংবদন্তি এই আলোকচিত্রশিল্পীর জন্ম ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে। অবিভক্ত ভারতের ঝাং (এখন পাকিস্তানের অংশ) শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে তাঁর নতুন ঠিকানা হয় বিভক্ত ভারত। কিন্তু নিজ জন্মভূমিকে ভুলতে পারেননি কখনো।
পুরোনো সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, 'আমার এখনো মনে পড়ে ঝাং-এ আমাদের বাড়িটি ছিল একটি তিনতলা বাড়ি। পাশেই ছিলো ছোট গলি। সে গলিতে ছিল দোতলা একটা বাড়ি। একদিন মাঝরাতে সব বাড়ির মানুষজন জেগে উঠে। আমরা ছাদে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম গলির কয়েকটি বাড়িতে আগুন লেগেছিল।'
পড়াশোনা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তবে সেখানে তাঁর মন টেকেনি কখনো। মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করতেই তাঁর যত স্বাচ্ছন্দ্য। ১৯৬৫ সালের কথা। রঘু উপলব্ধি করেন কেবল ফটোগ্রাফিতেই তাঁর শান্তি । তাই সিদ্ধান্ত নিতেও বেশ একটা ভাবতে হয়নি। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই পা বাড়ান স্বপ্নের পথে।
পেশাগত জীবনে ১৯৬৬ সালে ফটোগ্রাফি সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন দি স্টেটসম্যান পত্রিকায়। সেখানে কর্মরত ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এরপর নানা সময়ে নানা জায়গায় কাজ করে গেছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বিভিন্ন পুরষ্কারও। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ প্রকাশিত গল্প 'ভারতের বন্যপ্রাণীর মানব ব্যবস্থাপনা'র জন্য ১৯৯২ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'বর্ষসেরা ফটোগ্রাফার' পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৯ সালে তিনি ফরাসি সরকার কর্তৃক অফিসার ডেস আর্টস এট ডেস লেটারস উপাধিতে ভূষিত হন। ২০১৬ সালে ভারতে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান। এছাড়া 'অ্যাকাডেমি ডেস বিউক্স-আর্টস'-এর প্রথম বিজয়ী ফটোগ্রাফার হিসেবে জায়গা করে নেন রঘু রাই। ফটোগ্রাফিতে জীবন্ত কিংবদন্তিদের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শরনার্থী নিয়ে কাজ করার ফলে ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে 'পদ্মশ্রী' পুরস্কারে ভূষিত করে।
কে জানত, ২৩ বছর বয়সী ওই তরুণই একদিন আলোকচিত্র শিল্পের জগতে সৃষ্টি করবে একের পর এক ইতিহাস। রঘু করেছেন। তাঁর ছবি যেমন ইতিহাসের অংশ হয়েছে, তেমনি তিনি নিজেও। বিভিন্ন সময়ে তাঁর তোলা ছবি যেমন মানুষকে হাসিয়েছে, তেমনি কাঁদিয়েছেও।
তাঁর তোলা আরও কিছু দুর্লভ এবং অপ্রকাশিত ছবি নিয়ে উন্মোচিত হলো 'রাইজ অব আ ন্যাশন' শীর্ষক বইও! নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাস আরও বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরার লক্ষ্যে রঘু ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন থেকে নেওয়া হয় এই উদ্যোগ। ২০২৩ সালেই শেষ হয় বই প্রিন্টিংয়ের কাজ। ২০২৪-এর ১০ মে হয় সে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন রঘু রাই স্বয়ং!
বই প্রকাশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা দুর্জয় রহমান। তিনি বলেন, 'প্রায় ৩ বছর ধরে বইয়ের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছি। কাজ শেষ হতে সময় লাগলে কিছু আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর চিন্তা মাথায় আসে। তবে একটি বিশেষ মুহূর্তে এক্সিকিউট করার চিন্তা করছিলাম। সে সূত্র ধরে চারুকলার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে বেছে নিই। তারপর রঘু স্যারের সাথে কথা বলে এই প্রদর্শনীর জন্য কিছু ছবি সংগ্রহ করি।'
৫০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের। কিন্তু এখনো রঘু রাইয়ের ক্যামেরায় বন্দী করা সে সময়ের ছবির গল্পগুলো জীবন্ত। তার ছবি দেখে মুগ্ধ হননি এমন মানুষের দেখা মেলা ভার। অবশ্য আগের মতো অশীতিপর এই আলোকচিত্রীর শরীরে জোর নেই। নেই চোখের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তিও। তবুও ছবি তোলার প্রতি তার যে নেশা, সেটির ঘোর যেন শেষ হবার নয়। এখনো তাকে কাছে টানে ক্যামেরা। হাতে প্রিয় ক্যামেরা বহন করেন সদা। সেদিনও দেখা গেল প্রিয় ক্যামেরা হাতে। এক মিনিটের জন্যও হাত থেকে রাখার সাহসটুকু করেননি। বরং সুযোগ পেলেই ফ্রেমবন্দী করছিলেন নানা রঙের মুহূর্ত। হয়তো তার মন পড়ে থাকে সে সময়টায়, যখন ক্যামেরা হাতে দৌড়ে বেড়াতেন বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।