কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিরূপণের বহুল প্রত্যাশিত জৈব-সূচক আবিষ্কার
জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর লড়াইয়ে আজ সবচেয়ে বেশি চেষ্টা চিকিৎসা ও জৈব বিজ্ঞানীদের। রেকর্ড সময়ে কোভিড-১৯ এর মতো প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের টিকা তাদের কল্যাণেই পেয়েছে বিশ্ব। কিন্তু, সব ভ্যাকসিন সমান নয়, মানব ট্রায়ালে এসবের কার্যকারিতার হার নিরূপণ করাটাও বেশ সময় ও শ্রমসাধ্য। কিন্তু, তারপরও ভাইরাসের নানান নতুন ধরনের বিরুদ্ধে সকল বয়স শ্রেণির মধ্যে সুরক্ষা নিরূপণের কাজটিও জটিল।
সমস্যাটি সমাধান করে টিকা গবেষণায় গতি আনতে মহামারি হানা দেওয়া পর থেকেই কোভিড-১৯ টিকার একটি জৈব-সূচক খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আবিষ্কারক বিজ্ঞানীরা। আশার কথা; তাদের সে চেষ্টা সাফল্য পেয়েছে।
এতে করে নির্দিষ্ট কোনো শারীরিক অবস্থা ও বয়সের মানুষ টিকা নেওয়ার পর তার দেহে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে কিনা- তার আভাস পাবেন বিজ্ঞানীরা।
এই উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় এক মানব ট্রায়াল। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের রক্তে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রোটিনের (কো-রিলেট প্রোটিন) সন্ধান পেয়েছেন। এই প্রথম কোনো টিকার আবিষ্কারক বিজ্ঞানীরা এর সন্ধান পেলেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, রক্তে এ প্রোটিনের সূচক বর্তমানে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলো উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন টিকা গবেষণাতেও গতি আনবে। কমাবে কার্যকারিতা পরীক্ষায় বড় পরিসরে পরিচালিত ব্যয়বহুল মানব ট্রায়ালের প্রয়োজনীয়তা।
গত ২৪ জুন অনলাইন জার্নাল- মেডরেক্সিভ- এ মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ পূর্ব এক নিবন্ধে এসব তথ্য জানানো হয়।
ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের ভ্যাক্সিনোলজিস্ট ডেভিড গোল্ডব্ল্যাট বলেন, "সফলভাবে কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার আভাস দিতে পারে এমন একটি নির্ভরযোগ্য সূচক দরকার। কারণ, এতে করে নতুন আবিষ্কৃত টিকাকে দ্রুত অনুমোদন দেওয়া যাবে।"
করোনাভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জা গোত্রের এবং ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। তাই বিজ্ঞানীরা ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা ভাইরাল প্রোটিনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারছে কিনা- তা নিরূপণে সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে ট্রায়ালের ভিত্তিতে একটি নতুন ফর্মুলা তৈরি করেছেন। অথচ টিকাপ্রাপ্তদের দেহে সংক্রমণ হার কমছে কিনা তা নিরূপণে এপর্যন্ত বড় আকারের ট্রায়াল অনুষ্ঠানই একমাত্র উপায় ছিল।
সংক্ষিপ্ত ও কম খরচে ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকার কার্যকারিতা পরিমাপে সফলতা আসার পর, তারা এখন কোভিড-১৯ টিকার ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করার আশা করছেন।
বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অবস্থিত বেথ ইসরায়েল মেডিকেল সেন্টারের ভাইরোলজি ও ভ্যাকসিন গবেষণা শাখার পরিচালক ড্যান বারুচ বলেন, "ভ্যাকসিন গবেষণায় কো-রিলেট প্রোটিনের শক্তি অপরিসীম। নির্ভরযোগ্য কো-রিলেট এর সন্ধান পাওয়া গেলে- তা মানব ট্রায়াল প্রয়োগ করে প্রার্থী টিকা কীভাবে কাজ করবে, এর প্রদত্ত সুরক্ষা কতদিন স্থায়ী হবে- তার একটি আগাম আভাস পাওয়া যায়।
জৈব সূচক সন্ধানের ইতিহাস:
ট্রায়ালে অংশ নেওয়াদের মধ্যে যারা কোনো টিকা নিয়ে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছেন তাদের রোগ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যারা সম্পূর্ণরূপে টিকাকরণের পরও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের কো-রিলেট প্রোটিনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়।
তবে অধিকাংশ কোভিড-১৯ টিকার উচ্চ কার্যকারিতা হার থাকায় এ প্রক্রিয়ায় সঠিক ফল পেতে ভ্যাকসিন গবেষকদের দীর্ঘসময় লেগে যায়, বলে জানান বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ইন্টিগ্রেটেড ক্লিনিক্যাল ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট শাখার ডেপুটি ডিরেক্টর পিটার ডাল।
সম্পূর্ণরূপে টিকা পেয়েও আক্রান্তদের 'ব্রেক থ্রু' কেস হিসেবে চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, কিছু উচ্চ সফলতা হার থাকা টিকার ক্ষেত্রে এধরনের কেসের সন্ধান না পাওয়ায়; টিকা গবেষণার প্রকাশিত কার্যকারিতা হারের সঙ্গে কো-রিলেট সুরক্ষার তুলনা করতে বাধ্য হন বেশ কয়েকটি গবেষক দল।
এসব গবেষণায় উঠে আসে যে ভাইরাস রোধী 'নিউট্রালাইজিং' অ্যান্টিবডি কোন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিরূপণের মানসম্মত সূচক হতে পারে। ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার মতো টিকা এসব অ্যান্টিবডি বেশি পরিমাণে গড়ে ওঠার উদ্দীপনা যোগায়, তাই এ দুটি প্রতিষেধক অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার চেয়ে বেশি ফলদায়ক বলেই তারা উপসংহার টানেন।
অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাম্প্রতিক গবেষণাতেও উচ্চ মাত্রার 'নিউট্রালাইজিং' অ্যান্টিবডি ও ফলদায়ক সুরক্ষার মধ্যে সম্পর্ক প্রমাণিত হয়েছে। অক্সফোর্ডের জৈবপরিসংখ্যানবিদ মিরিন ভয়সির নেতৃত্বে পরিচালিত এ গবেষনায় ১৭১টি ব্রেক থ্রু কেসের সঙ্গে ভ্যাকসিন পাওয়া এবং লক্ষণযুক্ত সংক্রমণে আক্রান্ত হননি এমন ১,০৪৪ জনের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া তুলনা করা হয়।
গবেষক দল জানান, উচ্চ মাত্রার বাইন্ডিং ও নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি থাকা অংশগ্রহণকারীরা কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সম্পূর্ণভাবে না হলেও অনেকগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। গবেষকরা ৫০- ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা হার থাকা বিভিন্ন কোভিড-১৯ টিকার অ্যান্টিবডি মাত্রা নিরূপণের একটি মডেলও তৈরি করেছেন। এর ভিত্তিতে তারা জানান, এই সূচকের মাধ্যমে কোন ভ্যাকসিনের অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া তৈরির মাত্রা অনুসারে লক্ষণযুক্ত সংক্রমণ প্রতিরোধে সম-পরিমাণ সফলতার ফলাফল জানা যাবে।
- সূত্র: নেচার ডটকম