ক্যানোনবল: হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে রহস্য ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাখা এক গাছ
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নৈবেদ্য হিসেবে লাল, গোলাপি ও হলুদ রঙ মিশ্রিত ক্যানোনবল ফুলের সুগন্ধি শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত। এটি তাদের কাছে 'সাল' নামে পরিচিত।
বলা হয়ে থাকে, গৌতম বুদ্ধের জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে এই গাছ সম্পর্কিত। এই অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এটি নাগলিঙ্গম নামে পরিচিত। তারা বিশ্বাস করেন, তাদের দেবতা শিবকে এই ফুল উৎসর্গ করা হয়েছিল।
তবে, ক্যানোনবল গাছটি প্রকৃতপক্ষে অসংখ্য উপাসকের ধারণাকৃত একই গাছ নয়। এমনকি ১৮০০ শতাব্দীর আগে গাছটি এশিয়া মহাদেশে ছিলই না। অর্থাৎ, হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে এই গাছের সম্পর্কিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
১৮৯৩ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে প্রকাশিত বৃটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী হেনরি ট্রিম্যানের 'হ্যান্ডবুক টু দ্য ফ্লোরা অব সেইলন' কিংবা ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত উদ্ভিদবিজ্ঞানী জে.ডি. হুকারের 'ফ্লোরা অব দ্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়া'- কোনো বইয়েই এই গাছের উল্লেখ নেই।
শ্রীলঙ্কার বোটানিক্যাল গার্ডেনের সাবেক সাধারণ পরিচালক ও গবেষক সিরিল উইজেসান্দ্রা বলেন, 'এই বইগুলোতে ওই অঞ্চলের তৎকালীন দেশি এবং ভিনদেশি সব ধরনের উদ্ভিদের বর্ণনা আছে। বৈজ্ঞানিক ইতিহাস স্পষ্ট জানায়, সেসময় ওই অঞ্চলে এই গাছ ছিল না। পেরাদানিয়ার রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে আরও অনেক সময় পর এই গাছ প্রথম রোপণ করা হয়। এক শতাব্দী পূর্বেও যখন গাছটি উপমহাদেশে নতুন ছিল, তখনও এর উৎপত্তিস্থল নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। এটি ভিনদেশি গাছ হিসেবেই পরিচিত ছিল।'
শ্রীলঙ্কায় রাজা পঞ্চম জর্জের আগমনী স্মৃতি হিসেবে ১৯০১ সালে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে এই গাছ রোপণ করা হয়। শ্রীলঙ্কার আঞ্চলিক ভাষা সিংহলিতে লেখা স্মৃতি স্মারকটিকে গাছটির আঞ্চলিক নামের উল্লেখ নেই।
সিরিল আরও বলেন, আঞ্চলিক নাম যদি আগেই থাকত, তাহলে তৎকালীন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, যারা শ্রীলঙ্কান গাছ ও ফুল লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তারা অবশ্যই সেটি উল্লেখ করতেন।
রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের বর্তমান প্রধান শেলোমি কৃষ্ণরাজা বলেন, বুদ্ধশ্রুতিতে উল্লেখিত আসল সাল গাছটি মূলত 'Shorea robusta'। এ গাছ মূলত ফুলের অসাধারণ সুঘ্রাণের কারণেই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন দুটি ধর্মের ধর্মীয় আচারের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বৌদ্ধদর্শন অনুযায়ী, ফুলটির মধ্যবর্তী স্ফীত অংশ তাদের উপাসনালয়ের প্রতীক এবং একে ঘিরে থাকা পরাগকেশরগুলো উপাসকদের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রতীক।
হিন্দু দর্শন অনুযায়ী, ফুলটির নাগলিঙ্গম নামে নাগ শব্দ এসেছে সংস্কৃত শব্দ নাগা থেকে, যার অর্থ কোবরা। লিঙ্গম শব্দটি দেবতা শিবের প্রতীক। হিন্দু পুরাণমতে, ফুলের স্ফীত অংশটি শিবের প্রতীক, যাকে পাহারা দিচ্ছে চারপাশের কোবরা।
শ্রীলঙ্কায় গাছটির আগমনের পর থেকেই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসল সাল গাছের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা হয়। অন্যতম একটি বড় ভুল ছিল, সরকার নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্যসহ এর অন্তর্ভুক্তি।
ইউনিভার্সিটি অব পেরাদানিয়ার এমিরেটস অধ্যাপক নিমাল গুনাতিলকের মতে, সাল গাছের এই ভুল পরিচয়ের প্রসার বর্তমানে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
আয়ুর্বেদ সম্পর্কিত একটি সম্মেলনে একদল বিশেষজ্ঞ জানান, তাদের পরীক্ষণের ফলাফল কাজ করেনি। তখন গুনাতিলক ব্যবহৃত উপাদানগুলো পরীক্ষা করে দেখেন, তারা প্রচলিত ভুল সাল গাছের অংশ ব্যবহার করেছেন। এ কারণেই ওই মিশ্রণ কাজ করেনি।
সাল গাছ হিসেবে এই গাছের পরিচয় এতই বদ্ধমূল, ২০০২ সালে গাছটি শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায়। নরওয়ের মধ্যস্থতায় শ্রীলঙ্কান সরকার ও তামিল বিদ্রোহী দলের শান্তিচুক্তির সময় চুক্তির উভয়পক্ষ এই গাছ রোপণ করে।
ওই শান্তি চুক্তি পরবর্তীতে ভেঙ্গে গেলেও, ক্যানোনবল গাছের পরিচয়ের ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।
- সূত্র: মঙ্গাবে ডটকম