গাবতলী বাস টার্মিনালের আশার স্কুল
প্রতিদিন দুপুর দুইটা বাজতেই শত শত মানুষ এসে জড়ো হয় রাজধানীর গাবতলীর সাবা ফাস্ট ফুড অ্যান্ড হোটেলের সামনে। বাসের হেল্পার, ভিক্ষুক, গৃহহীন শিশু—সব ধরনের মানুষ আছে সেই দলে।
কয়েক ফুট দূরত্ব রেখে বসে তারা। তারপর ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডাল ও সবজির প্লেট পার হতে থাকে একজন থেকে আরেকজনের কাছে।
দেখে মনে হবে, পিলো-পাসিং খেলা চলছে বুঝি। পার্থক্য একটাই—এখানে বাজনা থাকে না, এবং প্রত্যেকের হাতে প্লেট পৌঁছে যাবার পর এ খেলা বন্ধ হয়ে যায়।
এভাবে প্রতিদিন দুই বেলা খাওয়ানো হয়। মানুষকে খাওয়ানোর এ উদ্যোগটি নিয়েছে গাবতলী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল স্কুল।
স্কুলটিতে গৃহহীন শিশুরা লেখাপড়া করত। তবে এখন আরও অনেক মানুষকে আশা দিচ্ছে এই স্কুল।
দিনমজুর হাবিবুর রহমান ঢাকা এসেছিলেন একটু উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু মহামারির আঘাতে চুরমার হয়ে যায় তার সব আশা। রাস্তায় ঘুমাতে শুরু করেন তিনি।
তারপর একদিন ছিনতাইয়ের শিকার হলেন হাবিবুর। সমস্ত সহায়-সম্বল হারিয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে গেলেন তিনি। দুই দিন কেটে যায় উপবাসে। সব আশার আলো যখন নিভে আসছিল, তখনই একজনের কাছ থেকে শুনলেন এখানে বিনা-পয়সায় খাবার দেওয়া হয়।
অকূল সমুদ্রে পড়া হাবিবুরের সামনে যেন স্বর্গ ধরা দিল। গাবতলী বাস টার্মিনালে চলে এলেন তিনি। খুঁজে বের করলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল স্কুল। হাবিবুরের আশার সর্বশেষ আলো হয়ে মিটমিট করে জ্বলতে থাকল স্কুলটি।
দুই বেলা ভাত, ডাল ও সবজি—পরিমাণে বেশি না হলেও হাবিবুরের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট খাবার। ছোট্ট এই সাহায্যটুকুই এই কঠিন বিপর্যয়ের সময় হাবিবুরের জন্য বিরাট প্রাপ্তি।
মহৎ এই উদ্যোগ থেকে কেবল হাবিবুর একাই উপকৃত হননি। গত বছরের মার্চে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে স্কুল কমিটি প্রতিদিন দুইশোর বেশি মানুষকে দুই বেলা খাওয়াচ্ছে।
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রধান উপদেষ্টা আমিনুল ইসলাম বলেন, '২০২০ সালের মার্চে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পরই আমরা এই উদ্যোগ নিই।'
খাবার রান্না হয় সাবা ফাস্ট ফুড অ্যান্ড হোটেলের মালিক ও স্কুল সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বাড়িতে। তারপর খাবার পরিবেশন করা হয় তার হোটেলের সামনে।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্কুলটির সঙ্গে আছেন রোজিনা পরিবহনের কর্মী আমিনুল ইসলাম। প্রথমে কমিটির সদস্য ছিল পাঁচজন, পরে বেড়ে ২১ জন হয়।
আমিনুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, শুরুতে স্কুলের বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি দিনে তিন বেলা খাওয়ানো হতো। এ স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বাস টার্মিনালে কাজ করে বা রাস্তায় থাকে।
কোভিড-১৯ মহামারির আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল স্কুলে ৪০–৫০টি শিশু নিয়মিত পড়াশোনা করত। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বাস টার্মিনালের পাশে তাদেরকে পড়ানো হতো।
কোভিডের প্রাদুর্ভাবের পর এই শিশুরা বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। অনেকের স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে স্কুল কমিটি বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে।
আমিনুল ইসলাম জানান, দুপুরে সবজি, ডাল ও ভাত খাওয়ানো হয়; রাতে খাওয়ানো হয় ডিম খিচুড়ি।
উদ্যোগটি প্রথমে নেওয়া হয়েছিল স্কুলের আর্থিক-সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের খাওয়ানোর জন্য। শিক্ষার্থীদের অনেকেরই কোনো কাজ ছিল না। যা-ই হোক, কর্মসূচিটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। আরও অনেকে উপকৃত হতে থাকে এ উদ্যোগ থেকে।
মো. সাইফুল নামের এক বাস হেল্পার বলেন, 'বাসের চাকা ঘোরা বন্ধ হয়ে গেলে আমার আয়ও বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমি বাসে ঘুমাই আর এখানে দুই বেলা খাই।'
তবে এখানে কেবল খাবারই দেওয়া হয় না। এই খাবারের সঙ্গে আসে ছোট্ট একফালি আশার আলো।
মোহাম্মদ নয়ন নামে আরেক বাস হেল্পারকে দেখা গেল একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। বাকিদের সঙ্গে খেতে বসেননি তিনি। খাচ্ছেন না কেন, জানতে চাইলে নয়ন বলেন, 'আমি খেতে আসিনি। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। এখানে বসে খেলে কেউ যদি আমার ভিডিও করে, তাহলে গ্রামে আমার বাবা-মা দেখে ফেলতে পারে। আমার অবস্থা দেখলে তারা খুব কষ্ট পাবে।'
খাবারের বদলে আয়োজকদের কাছে কিছু অর্থসাহায্য চান নয়ন। আয়োজকরা তাকে হতাশ করেননি।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হানের বড়সড় অনুদানের কল্যাণে কর্মসূচিটির আকার বেড়েছে।
আবু রায়হানের মন্তব্য জানার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এক শ্রেণির মানুষের জন্য মহামারি ও লকডাউন কতটা নির্মম হতে পারে, তা যখন অনেকেই ভুলে গেছেন, ঠিক তেমন একটা সময়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন রায়হান।
খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি থেকে উপকৃতদের কয়েকজন জানালেন, গত বছর যখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে খাবার বিতরণ করতেন। এখন এ ধরনের সাহায্য বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি সাহায্যও খুব কম পাচ্ছেন তারা। অনেকসময় আবার সরকারি সহায়তার খবরও তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না। তাই এরকম সামাজিক উদ্যোগই এখন অনেক সুবিধাবঞ্চিতের আশার আলো।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আল-আমিন হাওলাদার বলেন, 'খাবার বিতরণের সময় আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি। যারা খেতে আসেন, তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রেখে বসানো হয়। তারপরই কেবল তাদেরকে খাবারের প্লেট দেওয়া হয়।'
সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্যে সমাজের সচ্ছলদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, 'এখন আমরা দিনে দুই বেলা খাবার দিই। তবে আরও অর্থসাহায্য পেলে আমরা খাবার তালিকায় মাছ আর মুরগি যোগ করতে পারব।'