গার্মেন্টসের নারী কর্মীদের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তুলতে ভিন্নধারার শিক্ষা কার্যক্রম
উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরনো মাত্রই একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সাধারণ চিত্র এটি।
তৈরি পোশাক শিল্পের খাতে বৈশ্বিক ভাবে পরিচিত নাম বাংলাদেশ। এইচ অ্যান্ড এম, ওয়ালমার্টের মতো ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য উৎপাদিত হয় এদেশেই। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী।
যদিও এখাতে কাজের পরিবেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, একইসাথে মজুরিও অনেক কম। একজন গার্মেন্টস কর্মী মাসে সর্বসাকুল্যে সাড়ে ৮ হাজার টাকা আয় করেন। তা সত্ত্বেও ২৩ বছর বয়সী ইয়াসমিনকে পরিবারের ভরণপোষণ যোগাতেই এ কাজ বেছে নিতে হয়।
ইয়াসমিনের ভাষ্যে, "সিদ্ধান্তটি খুবই কঠিন ছিল।"
তবে ২০১৭ সালে গার্মেন্টস খাত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের জন্য নেয়া উদ্যোগ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের 'পাথওয়েজ ফর প্রমিজ' প্রোগ্রামে ভর্তি হন ইয়াসমিন।
২০১৩ সালে ঢাকায় রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১০০'র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তারপরই সুবিধাবঞ্চিত প্রতিভাধর নারীদের খুঁজে বের করা ও শিক্ষাপ্রদানের লক্ষ্যে 'পাথওয়েজ ফর প্রমিজ' নামের ভিন্নধারার শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর আগে যাদের প্রয়োজন তাদের এক বছরের প্রস্তুতির সুযোগ দেয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ক্যামব্রিজ ও মাসাচুসেটসের অফিস এ প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ১৮টি দেশের শিক্ষার্থীদের ভর্তি সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব পালন করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা কামাল আহমেদ বলেন, "তারা নিজেদের গন্ডিতে উদাহরণ তৈরির মাধ্যমে যে ভূমিকা রাখছে এবং অন্যান্যদের উৎসাহিত করছে তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অন্যান্য সদস্যদের পথপ্রদর্শন করে। "
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক বেশিরভাগ নারীর জন্য অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো অর্থ। পাথওয়েজ ফর প্রমিজ কার্যক্রমে অংশ নেয়া নারীরা যে সময় পড়াশোনার জন্য সেসময়টুকু গার্মেন্টসে কাজ করতে পারছেন না, তা পুষিয়ে দেয়ার জন্য তাদের মাসপ্রতি কিছু অর্থ সাহায্য করা হয়। প্রকল্পটি এর আওতাধীন গার্মেন্টস কর্মীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও মান উন্নয়নের বদ্ধপরিকর তা এর মাধ্যমেই প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।
কামাল আহমেদ আরও বলেন, "এসব নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলেও তাদের পরিবার তাদের ওপর নির্ভরশীল। একারণে পরিবার থেকে উপার্জনের প্রয়োজনে পড়াশোনার অনুমতি দেয়া হয়না।"
২০১৬ সাল থেকে এ শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তি হওয়া প্রায় ৪৭০ জন শিক্ষার্থীর ৪৩০ জন শিক্ষার্থীই অ্যাক্সেস অ্যাকাডেমি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। অ্যাক্সেস অ্যাকাডেমি প্রোগ্রাম উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির আরেকটি পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম। প্রথম পর্যায়ে ভর্তি হওয়া ২৫ জন শিক্ষার্থী ২০২০ সালের মে-তে পাস করে বের হয়েছেন ।
এ প্রকল্পের নৃত্যকলা, সঙ্গীত ও পারফর্মিং আর্টের শিক্ষক মাসুদ রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের একটি গুরূত্বপূর্ণ অংশ শিল্পকলা, এটি শিক্ষার্থীদের জীবনের বিশেষ বাধা মোকাবেলার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। ।
তিনি বলেন, "তারা একেবারেই সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী। বেড়ে ওঠার পরিবেশের কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়ে থাকে। পারফর্মিং আর্ট বা পরিবেশন শিল্পকলা তাদের জড়তা কাটিয়ে বহির্মুখী হয়ে উঠতে, যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধিতে ও নিজেদের প্রকাশ করতে সহায়তা করে। কোনো জড়তা ও ভয় ছাড়াই নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার নতুন উপায় খুঁজে পাচ্ছে তারা।"
মাসুদ রহমান জানান, তার একজন শিক্ষার্থী তালিবানের আক্রমণের ভুক্তভোগী ছিল। তারপর থেকে সেই শিক্ষার্থী নতুন মানুষজনের কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভয় পেত। এই কোর্সের পর তিনি অপরিচিত মানুষজনের সামনে উপস্থাপনা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সাবলীল হয়ে ওঠেন।
"অনেক শিক্ষার্থীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যপট বদলে দিতে সাহায্য করেছে পারফর্মিং আর্টের কোর্স।"
এ শিক্ষা কার্যক্রমের একজন প্রশিক্ষক হ্যানাহ কিম শিক্ষার্থীদের নানা প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারগুলোর দিকে আলোকপাত করেন।
"বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থাভাবের সমস্যা এবং এক্ষেত্রে সহয়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কতো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে সে গল্প শুনেছি। একারণেই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্তির মতো প্রকল্পের প্রয়োজন আছে।"
মহামারির সময়ে বিশ্বেবিদ্যালয়টির কাজ আরও গুরূত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, একইসাথে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে নারীদের ওপর কোভিড-১৯ মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়েছে। জোরপূর্বক বিয়ে ও লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের হারও বেড়ে গেছে বহুগুণে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) গত এপ্রিলে আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, লকডাউন জারি থাকলে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনার সংখ্যা লাখ লাখ বেড়ে যাবে।
বিশ্বজুড়ে মহামারির কারণে বাল্যবিবাহ বন্ধের চেষ্টাও ব্যহত হচ্ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এরফলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা অতিরিক্ত আরও ১ কোটি ৩০ লক্ষ বেড়ে যেতে পারে।
অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলর মতো এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও মহামারির কারণে গত মার্চ থেকে আবাসিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তত জানুয়ারি পর্যন্ত অনলাইনেই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
কামাল আহমেদ জানান, অনেক শিক্ষার্থীই নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারছে না, তাদের অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নেই, অনেকে নিজ সম্প্রদায়ে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবেও ভুগছেন।
"এক দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের জন্য নিরাপদ ও স্বাধীন জায়গা ছিল। একারণেই বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য হৃদয়বিদারক।" বলেন তিনি।
২০২২ সালে পাস করে বের হওয়ার কথা সাবিনা ইয়াসমিনের। মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নারীদের সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করেছে পাথওইয়েজ ফর প্রমিজ ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন। নিজস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে মাসিকের সময় ব্যবহৃত পণ্য বাংলাদেশে আরও সহজলভ্য করে তোলাই তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য।
"আমি দেশের গার্মেন্টস ক্ষেত্রকে নারীদের জন্য আরও নিরাপদ ও উন্নত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ শুরু করতে চাই।" বলেন ইয়াসমিন।
- অনুবাদ: রাফিয়া তামান্না