টিকা গ্রহণের পর কী করবেন আর কী করবেন না
হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে এখনো পিছিয়ে আছে বিশ্ব। ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়লেও সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন বহু মানুষ।
অনেকেই ভাবছেন, ভ্যাকসিন গ্রহণ করা মাত্রই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা এবং অন্যান্য সচেতনতা মেনে চলার প্রয়োজনও ফুরিয়ে আসছে। সত্যিই কি তাই? ভ্যাকসিন গ্রহণ করলেই কি আপনি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কোনো সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবেন?
প্রকৃত বাস্তবতা বেশ জটিল। পৃথিবীতে এখন টিকা গ্রহণকারী ও টিকাবিহীন মানুষেরা সহাবস্থান করছেন। এমনকি একই পরিবারের কিছু সদস্য টিকা নিলেও বাকিরা ঝুঁকিতেই থেকে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় টিকা গ্রহণকারীদের অবস্থান কী হতে পারে?
গত সোমবার (৮ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) ভ্যাকসিনেটেড মানুষদের জন্য নতুন এক নীতিমালা জারি করেছে। সেখানে পূর্ণাঙ্গভাবে টিকা গ্রহণকারীরা নিরাপদে ঘরোয়াভাবে জমায়েত হতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে, টিকা গ্রহণ না করলেও যদি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঝুঁকির হার কম থাকে, সেক্ষেত্রে টিকা গ্রহণকারীরা এ ধরনের পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে পারেন বলে বলা হয়।
তবে সিডিসির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের আগ পর্যন্ত টিকা গ্রহণ করলেও জনসমাগমে মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, ভীড় এড়িয়ে চলা, ঘরোয়া জমায়েতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুরক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
সিডিসির নীতিমালায় আরও বলা হয়, টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কম থাকলেও টিকার কার্যকারিতা কতদিন থাকবে কিংবা ভাইরাসের নতুন কোনো প্রকরণের বিরুদ্ধে তা সুরক্ষা দেবে কি না, বিষয়গুলো এখনো সুনিশ্চিত নয়।
তাই সবকিছু বিবেচনায় টিকা গ্রহণকারীদের বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
টিকা নিলে মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণভাবে টিকাদানের অন্তত দুই সপ্তাহ পর টিকা গ্রহীতারা মাস্ক পরিধান এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ছাড়াই ঘরোয়াভাবে পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ফাইজার ও মডার্নার দুই ডোজ টিকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজ টিকাই যথেষ্ট।
সিডিসি নীতিমালা অনুযায়ী, ভীড় বা জনসমাগমের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেটেড মানুষরাও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলবেন। সহজ কথায়, ঘরোয়া পরিবেশে কিছুটা ছাড় থাকলেও পাবলিক প্লেসে কোনো ছাড় থাকছে না। ভ্যাকসিন গ্রহণকারীরা সিনেমা দেখা থেকে শুরু করে, ডিনার পার্টি সবখানেই অংশ নিতে পারবেন। তবে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে।
বয়স্করা টিকা নিলেও শিশুদের সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত হবে?
এখন পর্যন্ত ১৬ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য কোনো ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, কিশোররা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো কোভিড সংক্রমণে ঝুঁকিতে থাকলেও কমবয়সী শিশুদের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ এবং ছড়ানোর ঝুঁকি বেশ কম পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রতিটি পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের নিজ নিজ সদস্যদের মাঝে ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত অনুযায়ী, পরিবারের বড়রা টিকা গ্রহণ করলেও শিশুদের সুরক্ষার জন্য যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুরা লক্ষণ ছাড়াই করোনা ছড়াতে পারে। স্কুল কিংবা ডে কেয়ার সেন্টারে শিশুদের পাঠানো হলে তা থেকে পরিবারের বড়দের মাঝেও সহজেই সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে কি যারা ভ্যাকসিন নেননি তাদের সঙ্গে মাস্ক ছাড়াই সাক্ষাৎ করা যাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বিধিমালা অনুযায়ী, একই পরিবারের সদস্যরা টিকা গ্রহণের পর যারা টিকা নেননি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে গুরুতর উপসর্গপূর্ণ কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি নেই।
যারা টিকা নেননি, তাদের মাঝে কি টিকা গ্রহণকারীরা সংক্রমণ ছড়াতে পারেন?
সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, টিকা গ্রহণকারীদের লক্ষণহীন সংক্রমণের ঝুঁকি ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এমনকি সর্দি জাতীয় ভাইরাল সংক্রমণও উল্লেখজনকভাবে হ্রাস পায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ও প্রমাণ তাদের হাতে নেই।
তাছাড়া, ভাইরাসের নতুন সব ধরনের কারণেও ভ্যাকসিনের পূর্ণ কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
টিকা নেওয়ার পর কোন কাজগুলো করব?
করোনার জন্য কোনো স্বাস্থ্যবিষয়ক রুটিন চেকআপ স্থগিত করে থাকলে টিকা গ্রহণের পর সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিন। সার্জারির মতো বিষয়, দন্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া, কোলোনস্কপি, ম্যামোগ্রাম ইত্যাদির প্রয়োজন থাকলে করিয়ে নিন।
শুধু স্বাস্থ্যবিষয়ক জিনিসগুলোই নয়, করোনার জন্য স্থগিত করে রাখা সবকিছুই শুরু করে দিন। তবে তা শুধুমাত্র যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণেরই পর।
ভ্রমণ করা যাবে?
ভ্রমণের বিষয়ে তেমন কোনো নীতিমালা জারি করেনি যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি)। তবে হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টে অবস্থান করার তুলনায় একে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ভ্রমণের তুলনায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষত, উচ্চ সংক্রমণ হার বিশিষ্ট এলাকায় বাস করলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
পরিবারের বয়স্কদের ভ্রমণ কি নিরাপদ?
পরিবারের বয়স্ক বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদী থাকলে তাদের ভ্রমণে উৎসাহ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই টিকা গ্রহণ এবং মাস্ক পরিধানসহ যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
টিকা গ্রহণের পরও কোন বিষয়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ?
টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিরা ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা, গল্পগুজব ও অন্যান্য কাজকর্ম করতে পারবেন। তবে বাইরে কোনো জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় নিশ্চিত করতে হবে।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো হলো রেস্টুরেন্ট, ব্যায়ামাগার, উপাসনালয় ইত্যাদি। এসব জায়গায় মাস্ক পরিধানে মানুষের সচেতনতা অপেক্ষাকৃত কম। তাই যতদিন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুহার কমে না আসছে, টিকা গ্রহণের পরও যথাযথ সুরক্ষা গ্রহণ জরুরি।
- সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল