দ্রুত টিকা বিতরণে গণিত বিশেষজ্ঞদের দেখানো কৌশল
আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক জগৎ গণিতের এক জটিল ভাষায় লেখা, এমন উক্তি করেছিলেন বিজ্ঞানী গ্যালিলিও। কোভিড-১৯ মহামারি যেন সেই সত্যকে গণিতের দুনিয়ায় নতুন করে আলোকপাত করেছে। মহামারি প্রতিরোধে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য পরিসংখ্যানবিদ।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীর দল প্রকাশ্যে সম্মুখসারির যোদ্ধা হলেও, গাণিতিকদের সরাসরি সম্পৃক্ততা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব কমই উপলদ্ধি করেন।
চলতি বছর প্রচণ্ড ব্যস্ততায় সময় কাটছে তাদের। এপর্যন্ত তারা গুরুত্বপূর্ণ সব ইঙ্গিত দিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায়। যেমন; নতুন করোনাভাইরাস কতটুকু সংক্রামক, আমাদের কতটুকু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিৎ, আক্রান্ত ব্যক্তি কতক্ষণ ধরে ভাইরাস ছড়াতে পারেন বা ইউরোপ থেকে আসা মাত্র একটি জীবাণুর সূত্র ধরে কীভাবে তা নিউইয়র্ক হয়ে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে, কীভাবে সংক্রমণের ঊর্ধগতি সমান্তরাল করে আরও লাখো জীবন বাঁচাতে হবে- এসব কিছুই তারা তুলে ধরেছেন।
অত্যাধুনিক কম্পিউটার তাদের তৈরি গাণিতিক মডেলের সাহায্যেই দিয়েছে নির্ভরযোগ্য আভাস। নানা রকম পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে গণিত বিশারদেরা যেসব মডেলিং করেছেন তারই বদৌলতে নানা দেশের রোগ প্রতিরোধ প্রশাসন করোনাভাইরাসের বায়ুবাহিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হয়। গণিতের কল্যাণেই জানা গেছে, কতক্ষণ বাতাসে নিঃশ্বাস থেকে নির্গত জীবাণুর সূক্ষ্মকণা ভেসে বেড়াতে পারে।
বাজারে বেশ কয়েকটি টিকা অচিরেই আসার ঘোষণায় বিশ্ববাসী অনেকটা নির্ভার হলেও, গণিতজ্ঞদের চোখে কিন্তু ঘুম নেই। তাদের সামনে এখন ভ্যাকসিন বিতরণ মডেল তৈরির পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ। এই বিষয়ে এমন অনেক সিদ্ধান্ত আছে যা নেওয়া অস্বস্তিকর হলেও- এব্যাপারে তাদেরকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীজুড়ে ৪২টি করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এসব ট্রায়ালের ফলাফল বিশ্লেষণ করার গুরুদায়িত্বও গণিতজ্ঞদের কাঁধে।
প্রথমেই কারা টিকা পাবেন, সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। ফলপ্রসূ টিকা সিংহভাগ মানুষ সবার আগে পেতে চাইলেও, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বাজারে সীমিত সংখ্যক ডোজ পাওয়া যাবে। এজন্যেই নির্ধারণ করা প্রয়োজন টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকার। এমন নির্ণয়ের উপর নির্ভর করছে লাখ লাখ মানুষের জীবন। বিবেকের চাপটা তাই সহজেই অনুমান করা যায়।
কোভিড-১৯ টিকা তৈরির গবেষণায় মানবদেহে ৫০টির বেশি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে। এতগুলো ট্রায়ালের তথ্য বিশ্লেষণ করে টিকা বণ্টন মডেল তৈরি করা সহজ কাজ নয় বলে জানান গণিতজ্ঞ ইভা লী। তিনি জর্জিয়া ইনস্টিটিউড অব টেকনোলজির সেন্টার ফর অপারেশন্স রিসার্চ অ্যান্ড হেলথ কেয়ার শাখায় কর্মরত। ইতোপূর্বে তিনি জিকা, ইবোলা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা বিতরণের কৌশল তৈরির কাজ করেছেন। বর্তমানে তার ধ্যানজ্ঞান শুধু কোভিড-১৯।
তিনি বলেন, ''করোনাভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার চাইতে অনেক বেশি প্রাণঘাতি। আগের কোনো জীবাণুই আমাদের দিকে এত বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়নি।''
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক হাউইয়ার্ড ফোরম্যান বলেন, ''পোলিও এবং গুটিবসন্তের ক্ষেত্রে বহুকাল আগে আমরা সম্পূর্ণ নতুন ভ্যাকসিন দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি চালিয়েছি। এভাবে হঠাৎ করে বাজারে আসা নতুন টিকা বণ্টনের অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই কম। তাই অনেক বেশি সতর্ক ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, এর আগের প্রায় সকল টিকা অন্তত কয়েক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খুব ধীরে ধীরে বাজারে আনা হয়েছে।''
সম্ভাবনা আর বিপদ পরিমাপে তাই গণিত পেয়েছে নজিরবিহীন হিসাব-নিকেশের চ্যালেঞ্জ। তথ্য-উপাত্ত অনুসারে এত তথ্য সন্নিবেশ করাও সহজসাধ্য নয়।
নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিলতাও উল্লেখ করা উচিৎ। আমরা জানি, কোভিড-১৯ রোগে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা সবচেয়ে বেশি হয়। পাশপাশি যাদের অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস এবং অ্যাজমার মতো রোগ রয়েছে তাদের জন্য গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি থাকে। অথচ রোগটি বেশি ছড়াচ্ছে তুলনামূলক স্বাস্থ্যবান তরুণ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে। তারা আক্রান্ত হলেও জীবাণুর কারণে কম ক্ষতির শিকার হন। তাই গণিতজ্ঞদের সামনে এখন ভ্যাকসিন মডেলিং প্রস্তুতে পরস্পরবিরোধী দুটি রাস্তা খোলা; মৃত্যু ঠেকানো নয়তো সংক্রমণ প্রতিরোধ।
টিকা বিতরণের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তাদের এই সিদ্ধান্তের যেকোনো একটি বেঁছে নিতেই হচ্ছে। গণিতের বিশুদ্ধ যুক্তির সঙ্গে মানবিক আবেগের এখানেই সংঘাত কেন্দ্র।
বেশিরভাগ পরিসংখ্যানবিদ মৃত্যুহার কমাতে বয়স্কদের মধ্যে টিকাদানে প্রাধান্য দিতে হবে বলে মনে করেন। অন্যদিকে, সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে তরুণদের টার্গেট করার কোনো বিকল্প নেই। মহামারি মোকাবিলায় এটি বিশুদ্ধ গাণিতিক জটিলতা আর মানবিক মূল্যবোধ্যের সহাবস্থান।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ মার্ক লিপসিচের মতে, ''সমস্যাটি নিয়ে যেভাবেই ভাবুন, ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন আর উত্তর সামনে আসে। বয়স্কদের আগে টিকা দিলে মৃত্যু কমবে। তারপর হয়তো আমরা তরুণসহ তুলনামূলক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে পারব। বর্তমান অবস্থায় সেটাই হয়তো সবচেয়ে ভালো সমাধান।''
সাম্প্রতিক এক মডেল ভিত্তিক গবেষণায়- যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, স্পেন, জিম্বাবুয়ে, ব্রাজিল ও বেলজিয়াম এই ছয়টি দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। ওই গাণিতিক বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে মৃত্যুহার কমানোটাই আগে দরকার বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে তীব্র শ্রেণি বৈষম্য রয়েছে, সেখানে কীভাবে টিকা কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন আমেরিকানসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে- তা এখনও গবেষণাধীন। এই সমস্যা নিরসনে আরও বেশ কিছু নতুন ধরনের আর্থ-সামাজিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে বিশ্লেষণে ব্যস্ত গনিতের জন্য নিবেদিত পণ্ডিতের দল।
পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী নানা অঞ্চলে সংক্রমণ হার অনুসারে নির্দিষ্ট এলাকায় টিকা পৌঁছে দেওয়ার অবকাঠামোগত ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার সমাধান নিয়েও তারা দিনরাত মাথা খাটিয়ে চলেছেন।
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন