ধ্বংসের পথে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র
এক সময় মৎস্য সম্পদে ভরপুর ছিল রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদের বড় বড় মাছ আকৃষ্ট করত সবাইকে। কিন্তু সেসব এখন কেবলই গল্প। হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হচ্ছে না।
শুধু তা-ই নয়, বিলুপ্তি ঘটছে মিঠা পানির অনেক প্রজাতির মাছের। যেগুলো এক সময় এ হ্রদে প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন হতো। যদিও প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিলুপ্তির পথে থাকা মাছগুলোর অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে হ্রদ খননসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গত কয়েক বছর ধরে সরকারকে সুপারিশ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। যদিও সেগুলো বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
হ্রদের মাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। বিএফডিসি বর্তমানে যে মাছ থেকে রাজস্ব আদায় করছে তার ৯২ ভাগই হল ছোট মাছ। যেগুলো কেচকি, চাপিলা আর মলা মাছ।
বিএফআরআই’র গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ছোট মাছের উৎপাদন বাড়লেও বিপরীতে কমছে কার্প জাতীয় মাছ।
কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে ১৯৬০ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কর্নফুলী নদীতে বাঁধ দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এ বাঁধের কারণে কর্ণফুলী, চেঙ্গী, কাচালং, মাইনী, রেইংখ্যং নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদের। যার পানি খাগড়াছড়ি জেলা ছাড়াও ভারতে মিজোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
বিএফডিসি’র তথ্য মতে, ১৯৬৫ সালে কাপ্তাই হ্রদ থেকে বাণিজ্যিকভাবে মাছ আহরণ শুরু হয়। ১৯৬৫-৬৬ অর্থ বছরে আহোরিত মাছের মধ্যে ৮১ ভাগ ছিল কার্প জাতীয় আর ১৯ ভাগ ছিল ছোট মাছ।
বর্তমানে এ কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন কমে দাড়িয়েছে ৫ ভাগে। আর ছোট মাছের উৎপাদন ৯৫ ভাগ। ক্রমান্বয়ে ছোট মাছ বাড়ছে আর কার্প জাতীয় মাছ কমছে।
বিএফআরআই গবেষণার তথ্য, হ্রদ সৃষ্টির প্রথম দিকে হ্রদে ৭৫ প্রজাতির মাছ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ৬৭ প্রজাতির মাছই ছিল দেশীয় আর বাকী ৮ প্রজাতির ছিল বিদেশি মাছ।
এ সব মাছের মধ্যে ৬ প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটেছে। সেগুলো হলোÑ সীলন, দেশি সরপুটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মোহিনীবাটা ও দেশি পাঙ্গাস। বিলুপ্ত প্রায় ৬ প্রজাতির মাছ। যেগুলো দেশি মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলসা আর সাদা ঘনিয়া। ক্রমান্বয়ে কমছে ৬ প্রজাতির মাছ। যেগুলো রুই, কাতলা, মৃগেল, বাঁচা, পাতি পাবদা আর বড় চিতল।
বিভিন্ন সময়ে কাপ্তাই হ্রদে কয়েক প্রজাতির মাছের পোনা ছাড়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বন্যার কারণে পুকুর থেকে ভেসে আসা মাছগুলোর মধ্যে গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, কার্পিও, রাজপুটি, তেলাপিয়া, মোজাম্বিকা তেলাপিয়া, গিফট তেলাপিয়া, মহাশোল,আফ্রিকা মাগুর, বিগহেড কার্প আর থাই পাঙ্গাস।
বর্তমানে হ্রদে প্রাধান্য বিস্তারকারী মাছের মধ্যে রয়েছে, কেচকি, চাপিলা, কাটা মইল্যা, তেলাপিয়া, কালিবাউস, আইড়, বাটা, ফলি আর দেশি মলা।
বিএফআরআই’র তথ্য মতে কাপ্তাই হ্রদে চারটি স্থানে রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন স্থান চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে বর্তমানে চেঙ্গী নদী আর রাইংখ্যং নদীর চ্যানেলের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। নদীর তলদেশ ভরাট আর নদীর প্রবাহ কমায় এ অবস্থা হয়েছে।
কাচালং নদী ও মাইনী নদীর সংযোগ এলাকায় আর কর্নফুলী নদীর বরকল এলাকার জগন্নাথছড়া এলাকায় প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে কিছু রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হয় তবে এগুলোও নষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ও সংগীত শিল্পী রঞ্জিত দেওয়ান (৬৮) বলেন, কাপ্তাই হ্রদের স্বর্ণযুগ হারিয়ে গেছে। হ্রদের মাছের কথা বললে বর্তমান প্রজন্ম অবাক হবে। ১৯৬৪-৬৫ সালে বড় বড় রুই কাতলের প্রতিটির ওজন ছিল ১৫-২০ কেজি। সে সময় যে মাছগুলো পাওয়া যেত সেগুলো এখন চোখেও পড়ে না। আমাদের চোখের সামনে হ্রদের মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বাড়ছে। বিভিন্ন পন্থায় মাছ শিকার হচ্ছে। কোনটিরই নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে থাকলে মনে হচ্ছে এক সময় শুধুই পানি আর পোকা থাকবে। মাছ পাওয়া যাবে না।
বিএফআরআই কাপ্তাই হ্রদে কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ করার কথা বললেও এ কথা মানছেন না জেলেরা। অবাধে ব্যবহার হচ্ছে এ জাল। বাজারেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে এ জাল।
এছাড়া প্রজননকালীন সময় তিন মাস বন্ধ রাখা এবং এরপর আহরণ শুরুর দিকে এক মাস মশারী কাপড়ের জাল বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। কার্প জাতীয় মাছের পোনা জালে উঠলে তা ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করলেও এ কথা মানছে না কেউ। হ্রদের জাঁক দিয়ে ফাঁদ পেতে মাছ শিকার নিষিদ্ধ করতে বলেছে বিএফআরআই।
সংস্থাটির রাঙামাটি কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিএম শাহিনুর রহমান বলেন, দূষণের কারণেও হ্রদে মাছের ক্ষতি হচ্ছে। হ্রদের পাশে বিভিন্ন বাজারের ময়লা আবর্জনা, হ্রদের পাড়ে গড়ে উঠা বাসা বাড়ি থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা পড়ছে পানিতে। এছাড়া পর্যটকরা পলিথিন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পরিবেশ বিরোধী জিনিস হ্রদে ফেলার কারণে মাছের ক্ষতি করছে। কাপ্তাই হ্রদ খননের ব্যাপারে বার বার সুপারিশ করা হলেও এটি খননের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বিএফডিসি রাঙামাটি জেলার সাবেক ব্যবস্থাপক কমান্ডার আসাদুজ্জামান বলেন, বিশাল হ্রদ খননে কঠিন ব্যাপার মনে হতে পারে। কিন্তু বস্তুত সেটা নয়। চেঙ্গী, মাইনী, কাচালং, কর্নফুলী, রাইংখ্যং নদীর চ্যানেলগুলোকে খনন করতে হবে। খননের আগে অবশ্যই জরিপ করতে হবে। চ্যানেলগুলো অবস্থান শতভাগ নিশ্চিত হবার পর খনন কাজে যেতে হবে। না হলে তখন চ্যানেলগুলো তো খনন হবেই না উল্টো হ্রদের তলদেশ আরো ভরাট হবে। কারণ হ্রদের পানির নিচে হাজারো পাহাড় ডুবে আছে। ভুল জরিপে এসব পাহাড় খননের তালিকায় পড়লে বিপদ হবে।
বিএফডিসি রাঙামাটির বর্তমান ব্যবস্থাপক বলেন, অবৈধ জাল, জাক দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে তাদের প্রতিনিয়ত কাজ করতে হচ্ছে। পোনা মাছ শিকার থেকে বিরত রাখতে জেলেদের সচেতনত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, এটি একটি বড় প্রকল্প। তবে হ্রদ খননের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। প্রাথমিক কাজগুলো অনেক পর্যায়ে এগিয়ে গেছে। সরকার কাপ্তাই হ্রদ খননে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে।