পরিত্যক্ত গ্লাভস বাড়াচ্ছে ঝুঁকি
খাইরুল আলম (৪৫)। ময়মনসিংহ শহরের একজন ব্যবসায়ী। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে প্রায়ই ঘর থেকে বের হতে হয়।
কয়েকদিন আগের কথা। তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে মোটরসাইলসহ বের হয়েছেন। মাথায় হেলমেট, শরীরে রেইন কোট, মুখে মাস্ক আর হাতে সাদা রঙের গ্লাভস পরেছেন। পরিচ্ছন্ন পোশাক আর প্রস্তুতিই বলে দিচ্ছে- চলমান করোনাভাইরাসের প্রকোপ নিয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন।
কথা হলো তার সঙ্গে। ব্যবহারের পর হাতে পরে থাকা গ্লাভসগুলো কী করেন, জানতে চাইলে বললেন, 'বাসায় ঢোকার আগে ডাস্টবিনে ফেলে দেই।'
যেহেতু ব্যবহারের পর গ্লাভসগুলো মেডিকেল বর্জে পরিণত হয় এবং এ ধরনের বর্জ ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, সে নিয়ম সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কি-না জানতে চাইলে বললেন, 'না, আমি এ রকম নিয়ম সম্পর্কে এই প্রথম শুনলাম!'
খায়রুল আলমই একমাত্র ব্যক্তি নন, স্বাস্থ্য সেবা খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া বেশির ভাগ মানুষই মেডিকেল বর্জ ধ্বংস সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আবার স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্টরাও সব ক্ষেত্রে সে নিয়ম যথাযথ পালনও করেন না। বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনাপাড় এলাকায় খায়রুল আলমের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র উঠে আসে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে সম্প্রতি ময়মনসিংহসহ সারা দেশে বেড়েছে হ্যান্ড গ্লাভসের যত্রতত্র ব্যবহার। ভাইরাসটি থেকে নিজেকে বাঁচাতে মানুষ গ্লাভস পরছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো ধ্বংস না করে ডাস্টবিনসহ যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই গ্লাভসগুলো ভাইরাসের সংস্পর্শে আসে এবং সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা না হয়, তাহলে সেগুলোর মাধ্যমে অন্য মানুষের সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঝুঁকিতে রয়েছেন সবচেয়ে বেশি। আর এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণার ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চিকিৎসা বর্জ (ব্যবস্থাপনা ও পক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা-২০০৮-এ সকল ধরনের মেডিকেল বর্জ শ্রেণিভিত্তিক ভাগ করে ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। সেখানে রোগের জীবাণু বহন করে এমন দ্রব্যকে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশনা রয়েছে।
এর পরও দেখা যায়, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ময়মনসিংহের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগই এ নিয়ম মানছে না। তারাও গ্লাভসসহ মেডিকেল বর্জ ডাস্টবিনে ফেলছে।
ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার পর গ্লাভসগুলো পরিচ্ছন্ন কর্মীর হাত ধরে শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থান করে নিচ্ছে ময়লার ভাগারে। যদি গ্লাভসে জীবাণু থেকেই থাকে, তাহলে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়।
নাগরিকরা যত্রতত্র ফেলার কারণে গত কয়েকদিনে নগরে পরিত্যক্ত গ্লাভসের পরিমাণ বেড়ে গেছে উল্লেখ করে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু বলেন, এগুলো সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
'তবে কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নাগরিকরা আইন মানছেন না।'- যোগ করেন মেয়র। তিনি জানান, করোনাভাইরাস সতর্কতার প্রচারণার সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে লিফলেট বিতরণ করবেন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম না মেনে গণহারে গ্লাভসের ব্যবহার করোনা ভাইরাসের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাই এখনই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ তাদের।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়র মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলিমুল ইসলাম বলেন, সাধারণ মানুষের গ্লাভস ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। শুধু যারা হাসপাতালে বা করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করবেন, তারা ব্যবহার করবেন। না জেনে যে কেউ এটি ব্যবহার করলে ভাইরাসটি ছড়ানোর নতুন মাধ্যম খুঁজে পাবে।
তিনি বলেন, মেডিকেল বর্জ ব্যবস্থাপনার জন্য আইন রয়েছে। না জেনে যত্রতত্র ব্যবহার আইনের লঙ্ঘন। আর যাদের গ্লাভস ব্যবহার একান্তই জরুরি, তাদের এটি ধ্বংসের পদ্ধতি জানতে হবে।
তিনি পরামর্শ দেন, গ্লাভস ব্যবহারের পর ব্লিচিং পাউডার মেশানো পানিতে এক ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে তারপর পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন এ বি এম মসিউল আলম বলেন, এটি একটি নতুন সমস্যা। অনেকে সচেতনতার নামে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছেন। তারা গ্লাভস পরে কাজ করছেন, সেই হাতেই আবার শরীরের বিভিন্ন স্থান স্পর্শ করছেন।
তিনি বলেন, 'অনেকে গ্লাভস পরা হাত দিয়ে চা খাচ্ছেন। পরে গ্লাভসটি যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছেন। এতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের চেয়ে বিস্তারের সুযোগ বেশি তৈরি হচ্ছে।'
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ যে সকল সংস্থা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করছে, তাদের এই বিষয়ে প্রচারণা চালাতে তিনি অনুরোধ জানান।
সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে মেডিকেল বর্জ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে নব বর্জ ব্যবস্থাপনা লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হাসনাত ইপু বলেন, ময়মনসিংহের বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মেডিকেল বর্জ ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী নয়। এটি পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ আহমদ জানান, চিকিৎসা বর্জ (ব্যবস্থাপনা ও পক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮-এর আলোকে জেলায় ছাড়পত্র নেওয়া বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা মাত্র সাতটি। বাকিগুলোর কোনো বর্জ ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নেই। তারা ডাস্টবিনেই মেডিকেল বর্জ ফেলছে। এ ব্যাপারে আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নেব।