পশ্চিমা ভুল প্রচারের শিকার ভারতবর্ষের এই মহারাজারা
রত্নখচিত ইমারত, প্রাসাদ ও ঐশ্বর্যপূর্ণ দরবার ছাড়াও ভারতীয় মহারাজারা ছিলেন শাসনকার্যে পারদর্শী। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনকালে রাজপরিবারের শাসকদেরকে সাধারণত হাতির বিশাল পাল, অতিকায় প্রাসাদ এবং দামি গাড়ির অধিকারী থেকে শুরু করে যৌনতা ও আমোদপ্রিয় মানুষ হিসেবে দেখা হতো।
বর্ণবাদ ও স্টেরিওটাইপিংয়ের শিকার এসব মহারাজা কি ছিলেন কেবলই ব্রিটিশদের কৌতূহলের বিষয়বস্তু?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ভারতের ঐতিহাসিক মানু পিল্লাই।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশরা 'দেশি' রাজকুমারদের পতিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন। সরকারি শাসনের চেয়ে তুচ্ছ যৌনতা এবং অভিনব পোশাকে বেশি আগ্রহী- এমনভাবে চিত্রায়িত করা হতো তাদের।
যেমন ধরুন, একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসার এক মহারাজাকে 'দানবীয়, বেশ স্বাস্থ্যবান ও দেখতে ঘৃণ্য' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কানে দুল ও গলায় মালা পরতেন বলে তাকে নর্তকীর সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন ওই অফিসার।
ভারতীয় মহারাজাদের সাজসজ্জার এ সংস্কৃতি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ভিন্ন হওয়ায় এগুলোকে পুরুষতান্ত্রিকতার বিপরীত হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
কয়েক দশক ধরে বজায় ছিল এসব স্টেরিওটাইপ ভাবনা। ১৯৪৭ সালে লাইফ ম্যাগাজিন একটি পরিসংখ্যানমূলক পরীক্ষণের মাধ্যমে ঘোষণা করে, গড়ে একজন মহারাজা '১১টি উপাধি, তিনটি ইউনিফর্ম, ৫.৮ জন স্ত্রী, ১২.৬ জন সন্তান-সন্ততি, পাঁচটি প্রাসাদ, ৯.২টি হাতি এবং ৩.৪টির বেশি রোলস রয়েস গাড়ির অধিকারী' ছিলেন।
পরিসংখ্যানের সংখ্যাগুলো বিভ্রান্তিকর হলেও এটি আদতে হাস্যকর ও বিনোদনমূলক। এ প্রতিবেদনের জন্য পর্যবেক্ষণ করা ৫৬২টি 'রাজ্যের' অধিকাংশই ছিল উপমহাদেশের ক্ষুদ্র অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। এমনকি রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিকও ছিল না সেসব অঞ্চল।
তবে ভারতীয় উপমহাদেশের দুই-পঞ্চমাংশ জুড়ে বিস্তৃত এ অঞ্চলগুলোতে এমনসব শাসক ছিলেন, যারা ছিলেন তাদের ওপর আরোপিত স্টেরিওটাইপের ঊর্ধ্বে।
উদাহরণ হিসেবে কোচিনের মহারাজার কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির প্রতি আগ্রহী। অন্যদিকে, গোন্ডালের শাসক ছিলেন প্রশিক্ষিত ডাক্তার।
এছাড়া, বড় রাজ্যগুলো মদ ও যৌনতায় মেতে থাকা 'টিন-পট' স্বৈরশাসকেরা শাসন করতেন না। বরং সেগুলো শাসিত হতো গুরুতর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের হাতে।
তবে তাদের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগের মধ্যে কিছু সত্যতাও রয়েছে। একজন স্কটিশ রেজিমেন্টের সামনে নিজের সৈন্যদেরকে কিল্ট (পুরুষের পরিহিত এক ধরনের স্কার্ট) এবং গোলাপী আঁটসাঁট পোশাক পরিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন এক মহারাজা। এছাড়া আরেক মহারাজা বিশ্বাস করতেন, তিনি পাঞ্জাবি হলেও আদতে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে পুনর্জন্ম লাভ করেছেন।
এ ধরনের অতিরঞ্জিত কাজ শুধু ভারতের রাজকুমাররা করতেন, এমন নয়; বরং ব্রিটিশ রাজা থেকে শুরু করে ভারতীর উপমহাদেশে প্রেরিত রাজনীতিবিদদের অনেককেই অস্বাভাবিক কিছু কাজ করতে দেখা গেছে। এমনকি ভাইসরয় লর্ড কার্জন একবার সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় টেনিস খেলেছিলেন বলে জানা যায়।
পারতপক্ষে, মহারাজাদের যেভাবে 'আত্মকেন্দ্রিক বেকুব লোক' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তা পুরোপুরি সত্য নয়।
এই যেমন, দক্ষিণ ভারতে মহীশূরের রাজপুত্র চামারাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারের যে শুধু হাতির পাল ছিল, এমন নয়; বরং শিল্পায়নের দিকে ধাবিত একটি শাসন ব্যবস্থার সভাপতিত্বও করেছিলেন তিনি। এমনকি তার তৈরি করা বাঁধ ছিল সে সময় বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধগুলোর একটি।
এছাড়া, পশ্চিমে বরোদার মহারাজা সম্পর্কে এক সাংবাদিকের প্রতিবেদনে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। সেই মহারাজা তার ৫৫ জন প্রজার শিক্ষার জন্য তৎকালীন ৫ ডলার বরাদ্দ করেছিলেন; যেখানে ব্রিটিশরা এ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছিল প্রতি এক হাজার জন ভারতীয়ের জন্য।
এছাড়া স্কুল, অবকাঠামো এবং আরও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের জন্য 'মডেল রাজ্য' হিসাবে নাম করেছিল বর্তমান কেরালায় অবস্থিত ট্রাভানকোর। অষ্টাদশ শতকের 'দ্য ট্রাভানকোর কিংডম'সহ এর আশেপাশের রাজতান্ত্রিক অঞ্চলগুলোতেই ভারতের সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়।
এসব উন্নয়নমূলক এবং জনগণের জন্য উপকারী পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও রাজপুত্রদের হারেম, দামি গাড়ি ও যৌনতায় মত্ত থাকার বিষয়টিই বেশি প্রচারিত হতো। ভারতীয় রাজ-পরিবারের সদস্যেরকে এভাবে চিত্রায়িত করার মাধ্যমে নিজেদেরকে ন্যায়পরায়ণ ও সুশৃঙ্খল হিসেবে প্রচার করাই ছিল ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য। এছাড়া, বাদামি চামড়ার ভারতীয়দেরকে 'সভ্য' মানুষে রূপান্তরিত করার তথাকথিত বর্ণবাদী মিশন বৈধকরণেও ভূমিকা রাখত এসব তথ্য।
তবে, এসবের পরেও ভারতীয় মহারাজারা ব্রিটিশদের বিরোধিতা করা থেকে বিরত ছিলেন না।
ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সাহিত্যের উৎস ছিল বরোদা। 'উদ্ভিজ্জ ঔষধ'-এর মতো শিরোনামে ব্রিটিশবিরোধী সাহিত্য প্রকাশ করত এ রাজ্য। বরোদার রাজা সায়াজিরাও গায়কোয়ার ছিলেন ঔপনিবেশিক শাসনের একজন উল্লেখযোগ্য সমালোচক।
অন্যদিকে, জয়পুরের শাসকরা তাদের হিসাব জালিয়াতি করে ভারতীয়দের উপকারের উদ্দেশ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য রাজস্ব গোপন করে রাখতেন। এছাড়া, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টিকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন একাধিক শাসক।
বলে রাখা ভালো, ১৯২০-এর দশকে ভারতীয়দের নেওয়া এসব পদক্ষেপের ব্যাপারে লর্ড কার্জন প্রায় নিশ্চিত ছিলেন বলেও জানা যায়।
শুনতে অস্বাভাবিক লাগলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজপুত্রদের নায়ক হিসেবে দেখা হতো। উপমহাদেশের বৃহত্তর রাজ্যগুলোর এসব কৃতিত্ব জাতীয়তাবাদী নেতা, বিশেষত মহাত্মা গান্ধীর জন্য ছিল বেশ গর্বের।
কিন্তু ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে উপমহাদেশে মহারাজাদের এ রূপের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। নৈতিকভাবে শিক্ষা খাতে সুযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন দেখা দেয়। ভারত থেকে ব্রিটিশদের প্রত্যাহারের প্রাক্কালে, অনেক মহারাজা সহিংসভাবে দমনকারী হয়ে ওঠার মাধ্যমে নিজেরাই তাদের দীর্ঘকালের শাসনকে কলঙ্কিত করে তোলেন।
একবিংশ শতাব্দীতে রাজকুমারদের যে কুখ্যাতি প্রচলিত আছে, তার কারণ হিসেবে কেবল ঔপনিবেশিক স্টেরিওটাইপ নয়; বরং নিজেদের সহিংসতাও দায়ী।
কিন্তু ইতিহাস থেকে অন্তত এ শিক্ষা পাওয়া যায়, যা কিছুই আমরা জানি তা আদতে বেশ জটিল। এমনকি উপমহাদেশের আলোচিত মহারাজাদের ক্ষেত্রেও এটি সত্য।
-
সূত্র: বিবিসি