বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড মেনে দেশে পিপিই তৈরির নেপথ্যে যারা
বুয়েটে পড়ার সময় রুমমেট ছিলেন মিজান ও ফোরকান। কিন্তু এখন কর্মসূত্রে মিজান থাকেন মার্কিন মুল্লুকের ডালাসে আর ফোরকান ঢাকায়। এই দুই বন্ধুর সংলাপের মধ্য দিয়েই শুরু হয় দেশে প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে পিপিই বা জীবাণুরোধী পোশাক তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা।
দেশজুড়ে জরুরি ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় পিপিই, মাস্ক এবং ভেন্টিলেটর সংকট দেখা দেবে- এমন আশঙ্কা ছিল ওই সংলাপের মূল বিষয়। পাশাপাশি নিজেদের করণীয় নিয়েও তারা কথা বলেন।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের উদ্যোগ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশজুড়ে অনানুষ্ঠানিক লকডাউন ঘোষণা করার একদিন আগে এমন আলোচনা হয় এই দুই প্রকৌশলীর মাঝে।
এই আলোচনার ওপর ভিত্তি করেই স্প্রেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়ামের কর্মরত ফোরকান বিন কাশেম বুয়েটের বর্তমান এক প্রফেসর এবং ৮৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সংগঠন 'ফোরাম-৮৬'-এর সভাপতি রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রফিক এরপর 'ফোরাম-৮৬'-এর যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি রশিদকে এই উদ্যোগে জড়িত করেন।
দেশের এই সংকটকালে, প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী হিসাবে দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড মেনে পিপিই তৈরি করতে সাহায্য করতে পারবেন বলে তারা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। শুধু তাই নয়, সহজেই কম খরচে তৈরি করা যায় অথচ কার্যকর চিকিৎসা সেবা দিতে সক্ষম, এমন ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র) তৈরির সিদ্ধান্তও নেন তারা। এসব ভেন্টিলেটর দেশের যে কোনো স্থানে ব্যবহার করা যাবে।
তবে প্রথমে যখন তারা বিশ্বমানের পিপিই তৈরির সিদ্ধান্ত নেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে দেশে পাঠান ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। এর একদিন পরই মুশফিক নামে তাদের ৮৮তম ব্যাচের এক বন্ধু স্বাস্থ্য বিভাগে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সনদপ্রাপ্ত পিপিই'র নমুনা সংগ্রহ করেন।
মুশফিক এসব নমুনা সুলতান নামে এক তৈরি পোশাক কারখানা মালিক বন্ধুকে দেন। সেই অনুসারে সুলতান খুব তাড়াতাড়ি আরও ১০টি পিপিই নমুনা হিসেবে বানিয়ে তা দেখানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে নিয়ে যান।
নমুনা দেখে মহাপরিচালক জানান, (স্বাস্থ্য কর্মীদের) পেশাদারি দায়িত্ব পালনের সময় পরিধেয় পিপিইতে ভিন্ন এক ধরনের ফ্যাব্রিক ব্যবহার করতে হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সুলতানের কারখানায় ওই ধরনের ফ্যাব্রিক ছিল না।
ইঞ্জিনিয়ার ফোরকান জানান, এই ঘটনায় আমরা দারুণ মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের মাঝেই দেখা দেয় আশার আলো।
'সৌভাগ্যবশত মহাপরিচালকের অফিসে সেদিন এক তরুণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভিজিটিং কার্ড দেখে আমাকে চিনতে পারেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে জানান, কয়েক বছর আগে তিনি শিক্ষানবিশ হিসেবে স্পেকট্রামে কাজ করেছেন। বর্তমানে ওই তরুণ একটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী। তার কোম্পানি দেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের শীর্ষ এক কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত। আরএমজি কোম্পানিটি পিপিই রপ্তানি করে। দেশে পিপিই রপ্তানিকারী এমন কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম।'
এই ঘটনার পরের দিনই আমরা নতুন উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আগের দিনের পরিচিত তরুণটি এবার ফ্যাব্রিকের চালানের ব্যবস্থা করে দেন। সেই ফ্যাব্রিক দিয়েই আর্মার পলিমার লিমিটেডের কারখানায় উৎপাদন করা হয় মানসম্মত পিপিই।
ব্যবহারের পর সঠিক পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করা হলে এই পিপিই পরপর তিনবার ব্যবহার করা যাবে।
এরই মাঝে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই চার ইঞ্জিনিয়ার অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর বুয়েটের নানা ব্যাচ থেকে পাস করা প্রকৌশলী এবং স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকর্মীরা ওই উদ্যোগে যোগ দিতে এগিয়ে আসেন। তারা সকলে মিলে অর্থ সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পিপিই উৎপাদন এবং তা দেশের যেখানে যেখানে প্রয়োজন সেখানে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছেন। অর্থায়নের উৎস সংগ্রহেও নানা সংস্থা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু হয়।
প্রথমেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় রোটারি ক্লাব অব মেট্রোপলিটন ঢাকা এবং ইনস্টিটিউড অব আর্কিটেক্টস। ওই অর্থ দিয়ে আর্মার পলিমার, স্কয়ার টেক্সটাইল এবং সারাহ গার্মেন্টস- এই তিনটি কোম্পানির কারখানায় উৎপাদন শুরু করা হয়।
শুধু উৎপাদনই নয়, পিপিই সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতেও দিন-রাত কাজ করছেন অনেকে। ইঞ্জিনিয়ার ফোরকান জানান, লকডাউনের মাঝে স্পেকট্রাম লজিসটিকসে কর্মরত ছেলেরা এসব পিপিই কারখানা থেকে সংগ্রহ করে দেশের নানা জায়গায় পৌঁছে দিতে কঠোর পরিশ্রম করছেন। এ পর্যন্ত আমরা দুই হাজার ২০০ পিপিই পৌঁছে দিতে পেরেছি। আশা করছি খুব শিগগির আরও ১৪০০ পিস পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
আপাতত দেশের ৬০টি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্পেকট্রাম কর্মীরা পিপিই পৌঁছে দিচ্ছেন। এর মাঝে কুমিল্লার দেবীদ্বার জেলা হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট, বিএসএমএমইউ, এনআইসিভিডি, খুলনা মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বারডেমসহ সারা দেশের আরও অনেক হাসপাতাল রয়েছে।