ব্রিটনি পরিবারে নারীদের বন্দীত্বের দীর্ঘ অন্ধকার ইতিহাস
যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানার ছোট্ট শহর কেন্টউড যদি কোনো কারণে বিখ্যাত হয়, তার একটি কারণ, এটি জনপ্রিয় পপ তারকা ব্রিটনি স্পিয়ার্সের জন্মভূমি। এই শহরের স্থানীয় জাদুঘরটি এক সময় ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজে ব্যবহৃত একটি বাড়ি।
ব্রিটনি পরিবারের এই বাড়ি প্রথমে পরিত্যক্ত ঘোষিত হলেও, ফে গেহরিঙ্গার নামে এক নারীর প্রচেষ্টায় তা আবার আলোর মুখ দেখে। বাড়িটিকে বদলে ছোটখাটো এক জাদুঘরে রূপ দেন তিনি; নাম রাখা হয় 'কেন্টউড হিস্টোরিক অ্যান্ড কালচারাল মিউজিয়াম'।
কিন্তু কিউরেটর গেহরিঙ্গারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাড়িটির মধ্য থেকে মৃত বাড়ির গুমোট ভাব আজও কাটেনি।
ফে গেহরিঙ্গার ব্রিটনির মা-বাবার একজন পারিবারিক বন্ধু। 'ফেম ফ্যাটালে' ট্যুরে ব্রিটনি স্পিয়ার্সের গায়ে জড়ানো 'পরীর ডানা' কিংবা পপ তারকার টিনেজ বয়সের পুরো বেডরুম সেটের মতো নিদর্শনসমূহ তিনি জড়ো করেছেন এই জাদুঘরে।
কিন্তু কেন্টউডে ঘুরে এবং গেহরিঙ্গারের কথা শুনে মনে হতেই পারে, তিনি সোনালি যুগের অদম্য, তুখোড় কোনো তারকার নয়, বরং প্রয়াত কারও স্মৃতি আগলে বসে আছেন। অথচ যার স্মৃতিচারণ করছেন, তিনি মাত্র ৩৯ বছর বয়সী এক নারী এবং এখনো জীবিতও বটে! আর সেই নারী অবশ্যই ব্রিটনি স্পিয়ার্স।
জাদুঘরের দেয়ালে টানানো ব্রিটনির ছবির সঙ্গে ফ্রেমে বাঁধানো আরও অন্য এক নারীর চেহারার মিলের কথা জানালেন জাদুঘরের কিউরেটর। এমা জিন স্পিয়ার্স নামে ওই নারী ছিলেন ব্রিটনির দাদি। ১৯৬৬ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে শটগানের গুলিতে তিনি আত্মহত্যা করেন!
জিনের মৃত্যু ছিল পরিবারের, বিশেষত ব্রিটনির বাবা জেমি স্পিয়ার্সের জন্য একটি বড় আঘাত।
ব্রিটনি স্পিয়ার্সের ১৩ বছরের কনজারভেটরশিপের অবসান এবং এর পেছনের অজানা তথ্য জানার পর কেন্টউডের অন্য অনেকের মতো চমকে উঠেছিলেন গেহরিঙ্গারও। তবে স্থানীয় লোকজনেরা ব্রিটনি ইস্যুতে কথা বলতে নারাজ। গত দশ বছরে অসংখ্য প্রতিবেদক এখানে তথ্য অনুসন্ধান করতে এসেছেন; তাদের মধ্যে হুমকির শিকার হয়েছেন অনেকেই।
এবার হয়তো পাঠকেরা আন্দাজ করতে পারছেন, কেন ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হলো এতক্ষণ! কারণ, ব্রিটনি স্পিয়ার্সই একমাত্র নারী নন যাকে পরিবারের পুরুষেরা অন্ধকারে রেখেছে। নারীদের বন্দী করে রাখার ও নানাভাবে নিপীড়ণের পূর্ব 'ঐতিহ্য' আছে ব্রিটনি পরিবারের!
মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগেই আদালতের রায়ে দীর্ঘ কনজারভেটরশিপ থেকে রেহাই পেয়েছেন ব্রিটনি। এই মুহূর্তে মুক্ত জীবনের স্বাদ নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু গেহরিঙ্গার মনে করেন, ব্রিটনির বাবা-মা খারাপ মানুষ নন। তবে হলিউডের প্রভাব তাদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে।
ব্রিটনির বাবা জেমি স্পিয়ার্স বছরের অধিকাংশ সময় কেন্টউডেই কাটান। এখানকার প্রতিবেশিরাও জেমির পক্ষ নিয়েছেন সহজেই। এমনকি কেউ কেউ ব্রিটনিকেই 'বখে যাওয়া' মেয়ে বলে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু জেমির সৎভাই জন মার্ক স্পিয়ার্স জানান, তাদের বাবা জুন অস্টিন স্পিয়ার্স ছিলেন একজন জঘন্য মানুষ, যিনি নিজের তিন স্ত্রী ও ১০ সন্তানের সঙ্গে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার ও গালিগালাজ করতেন।
ব্রিটনির চাচা মার্কের ভাষ্যে, 'স্পিয়ার্স পরিবারের পুরুষেরা খুবই খারাপ। এতগুলো বছর ধরে নারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার পরেও তারা টিকে আছেন।'
তিনি আরও জানান, জুন অস্টিন তার ছেলেমেয়েদের হিংস্রভাবে মারধর করতেন। সে কারণেই তার প্রথম দুই স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। শুধু তাই নয়, তিনি এমা জিন ও মার্কের মাকে মানদেভিলা দ্বীপে ফেলে দিয়ে আসেন, যেখানে এক সময় দেশের কুখ্যাত একটি মানসিক হাসপাতাল ছিল। তাই ব্রিটনির ঘটনায় মার্ক অবাক হননি।
জেমির সৎবোন ও ব্রিটনির ফুফু লি অ্যান স্পিয়ার্স র্যাদার মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে বাবার হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন। ১৬ বছর বয়সে তিনি ঘর ছাড়েন। তিনি বলেন, 'এরপর আমি আর ঘরে ফিরে যাইনি। বাবা আমাদের ভাইবোনদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে চাবুক মারতেন। তাকে বাবা বলতেই ঘেন্না লাগে আমার। আমি দোয়া করি, তিনি যেন নরকে জ্বলেপুড়ে মরেন!'
লি আরও জানান, তার বাবা তাদের মাকে কিছুদিন লিথিয়াম মাদক নিতেও জোর করেন এবং তাকে পাগলাগারদে দেওয়ার চেষ্টা চালান। 'যখন শুনলাম ব্রিটনিকেও লিথিয়াম দেওয়া হয়েছিল, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, এটা সত্যি হওয়ার পেছনে কারণ আছে! কারণ এই পরিবারের সবাই তো এরকমই,' বলেন লি।
জন মার্ক ও লি অ্যানের মনে তাদের মায়ের আত্মহত্যা নিয়েও সন্দেহ আছে। এমনটাও হতে পারে, তাকে খুন করা হয়েছে। কারণ কেউই জানে না সেদিন আসলে কী ঘটেছিল। তাছাড়া খবরটা পত্রপত্রিকায় বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল বলেই এই সন্দেহ থেকে গেছে।
এমা জিন যদি আত্মহত্যা করেও থাকেন, সেজন্যও দুই ভাইবোন তাদের বাবা জুন অস্টিন স্পিয়ার্সকেই দায়ী করেন। লি অ্যানের ভাষ্যে, 'এক অর্থে বলা যায়, আমার বাবাই পিস্তলের ট্রিগারটা টেনেছিলেন।'
লি অ্যান বলেন, 'স্পিয়ার্স পরিবারের পুরুষদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। ব্রিটনিকে ধন্যবাদ, সে একজন ভালো আইনজীবী বেছে নিয়েছিল। এ কারণেই মামলাটা জিততে পারল। তার বাবা জেমি ঠিক একই কাজ তার সঙ্গে করেছেন, যেমনটা তার পূর্বসূরিরা করেছিলেন আমার মা ও এমা জিনের সঙ্গে। তার মানে, তারা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও ধ্বংস করবেনই। তবে আমার মনে হয়, ব্রিটনি এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। সে খুবই ভালো মনের মানুষ।'
-
সূত্র: নিউইয়র্ক পোস্ট