ভারতের অদৃশ্য বিপর্যয়: গ্রামীণ দরিদ্র এলাকায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়
হিমালয়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে ঘেরা পাহাড় কি মহানগরের ভিড়ভাট্টা আর কংক্রিটের জঞ্জাল থেকে লোভনীয় নয়? আবার পাহাড়ের কোলে প্রত্যন্ত এলাকায় মহামারি কালে নিরাপদেও থাকা যাবে। এসব সাতপাঁচ ভেবেই দিল্লিতে বাবুর্চির চাকরি ছেড়ে নেপাল সীমান্তের কাছে ভারতের উত্তরাখণ্ড প্রদেশে খাঁকারি নামের নিজের পাহাড়ি গ্রামে ফিরে আসেন ললিত উপ্রেতি(৩৪)।
শুধু নিজের নয়, পরিবারের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেও এই গ্রামে ফেরা ললিতের। ভেবেছিলেন সকলেই নিরাপদ থাকতে পারবেন এবার।
ললিতের গ্রামে ফেরার মাস দুয়েক পর গত সাত আগস্ট একটি স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করে খাঁকারি গ্রাম পঞ্চায়েত।
''বিষয়টা কী তা- জানতেই আমি সেখানে অংশ নেই। তাছাড়া, আমার শরীরে কোনো উপসর্গ ছিল না। তাই ভাবলাম গিয়ে একটু দেখে আসাই যাক'' বলছিলেন ললিত। তিনি জানান, বর্ষাকালে দেখা দেওয়া নানা রোগ-ব্যাধিসহ কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তেও- স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মীরা সোয়াবের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সেদিন।
সোয়াবের মাধ্যমে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করার পরই বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে ললিতের। কারণ, গ্রামের যে চারজন পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছিলেন, তাদের মধ্যে তার নামও ছিল।
''গ্রামে এসে সংক্রমিত হব? কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। আমাদের গ্রামটি অনেক প্রত্যন্ত, স্থানীয় বাজারও অনেক দূরের পথ। তাই সাধারণত নিজেদের দরকারি তরি-তরকারি, শাক-সবজি গাঁয়েই ফলানো হয়।''
সংক্রমণ ধরা পড়ার রাতেই হালকা জ্বর এবং পেট খারাপের সমস্যাসহ এ যুবককে স্থানীয় একটি কোয়ারেন্টিন স্থাপনায় নেওয়া হয়।
ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ অবস্থায় ভাইরাস প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে- এমন ভীতি ও শঙ্কা বাড়ছে।
প্রথম থেকে চলা আসা এই শঙ্কা বাস্তবে পরিণত হওয়ার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে এখন। খাঁকারির মতো অসংখ্য প্রত্যন্ত গ্রাম, ছোট শহর আর মফস্বলে দুর্বার গতিতে সংক্রমণ বিস্তারের এক অধ্যায় শুরু হয়েছে।
''খাঁকারি খুবই ছোট এক পাহাড়ি গ্রাম। প্রত্যন্ত এ এলাকায় যদি হানা দিতে পারে; তবে ভারতের কোনো গ্রামই ভাইরাসের আওতামুক্ত নয়। চারজনের সংক্রমণ ওই সময় ধরা না পড়লে- আজ কী অবস্থা দাঁড়াত, তা যখন ভাবি তখন রাতের ঘুম উড়ে যায়'' বলছিলেন খাঁকারি গ্রাম প্রধান রাজন সিং নেগি।
তাদের মরতে দেওয়া হবে:
গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের সংখ্যা প্রায় ৬০ কোটি। বিপুল এ জনসংখ্যা স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা যথাযথ চিকিৎসা ছাড়া চলমান মহামারিতে অদৃশ্য এক বিপর্যয়ের শিকার হবে- এমন ভয় বাড়ছে দেশটির জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। প্রত্যন্ত এলাকায় সংক্রমণের তীব্রতায় অসংখ্য মৃত্যুর শঙ্কা করছেন তারা।
শঙ্কার যৌক্তিক কারণও বহুযুগ ধরে জানা। প্রান্তিক তথা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবার অনুপস্থিতি। ভারতের (চতুর্থ) জাতীয় স্বাস্থ্য পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গ্রামে বসবাসকারী মাত্র ২৫ শতাংশ নাগরিকের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে।
ভারতের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে থাকেন। অনেকেই আক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে। স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ এবং আর্থিক সংগতি না থাকায়, তাদের চিকিৎসাও পরিবারের দ্বারা অধিকাংশ সময় অবহেলিত হয়। তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে তাই সঙ্গত কারণেই গুরুতর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ভারতের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ জয়প্রকাশ মুলিইল- এর মতে, ভারতের অর্ধেক জনসংখ্যা বা প্রায় ৬৭ কোটি মানুষ নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তিনি আরও জানান, এ অবস্থায় বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগা গ্রামীণ বয়স্কদের অধিকাংশই- সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ পাবেন না।
''দুরারোগ্য ব্যাধি আক্রান্ত এবং বয়স্কদের ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আর্থিক অনটনের কারণে পরিবারের সদস্যরাও বয়স্ক ব্যক্তির জ্বর-সর্দির মতো করোনার মৃদু উপসর্গ দেখা দিলে- সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হাসপাতালে নেবেন না। এক কথায় বলা যায়, তাদের মরতে দেওয়া হবে। গ্রামীণ জনপদে গড় আয়ু যেখানে ৬৫ বছর, সেখানে এটাই হচ্ছে নির্মম বাস্তবতা'' জানান জয়প্রকাশ।
এই মৃত্যুগুলি বিশাল ভৌগলিক জেলায় ছড়িয়ে পড়বে। কিছু কিছু জেলার আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার বা তার বেশি। সেই তুলনায় লন্ডনের আয়তন মাত্র ১৫২৭ বর্গকিলোমিটার।
জয়প্রকাশ জানান, ''যেহেতু ভারতের বিস্তীর্ণ প্রত্যন্ত এলাকায় ভাইরাসের তাণ্ডব চলবে- তাই অসংখ্য মানুষের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মতো, মানবিক দুর্যোগের খবর জানা যাবে অনেক দেরিতে। কিছু ক্ষেত্রে সঠিক পরিসংখ্যানটি অজানাও রয়ে যেতে পারে।''
ভাইরাস নিয়ে অন্ধবিশ্বাস সহায়ক হবে বিস্তারে:
ইতোমধ্যেই সংগঠিত অনেক ঘটনায় প্রমাণ হয় যে, পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে কোয়ারেন্টিনে থাকার ভয়ে, আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা দিলেও- তা গোপন করবেন দিনমজদুর শ্রেণির গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। সংক্রমিত হওয়ার কথা জানাজানি হলে, তাদের আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে, পরিবার অনাহারে থাকবে- এমন শঙ্কাতেই তারা বিষয়টি গোপন রাখবেন। পাশাপাশি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে সামাজিক অন্ধ-বিশ্বাসও তাদের সংক্রমিত হওয়ার খবর প্রকাশে অনুৎসাহিত করবে।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য- উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্মীপুর খেড়ি জেলার শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার রবীন্দ্র শর্মা বলেন, ''এ রাজ্যের অনেক গ্রামে টেস্টিং ভ্যান নিয়মিত গেলেও, মানুষ সেখানে হাজিরা দিচ্ছে না সংক্রমণ ধরা পড়ার ভয়ে। অসম্মানের ভয়ে বা সামাজিকভাবে পরিবারসহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় থেকেই অধিকাংশ ব্যক্তি নিজেদের উপসর্গ লুকাচ্ছেন।''
দেশটির আরেক প্রান্ত বা দক্ষিণ ভারতের কেরালায়; গ্রামীণ সংক্রমণ নিয়ে অধিকাংশ মানুষই উদ্বিগ্ন। এ রাজ্যের ভালাদ নামের প্রত্যন্ত গ্রামে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান এবং শেষকৃত্যে যোগ দেওয়া একটি পরিবার থেকে অন্য ২৩৬ জনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথমদিকে, সমগ্র ভারতে সংক্রমণ প্রতিরোধে রোল মডেল ছিল কেরালা। কিন্তু, এ ঘটনায় রাজ্যটির সে অর্জনও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।
গ্রামাঞ্চলে ভীতি:
শহরের চাইতে গ্রামে মহামারির প্রভাব ভিন্নতর হবে, বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ভারতের বড় শহরগুলোতে বর্তমানে ভাইরাসের বিস্তার অব্যাহত গতিতে বাড়ছে। ৮০ শতাংশ চিকিৎসক এবং ৬০ শতাংশ হাসপাতালই অবস্থিত নগরাঞ্চলে; তাই কোভিড-১৯ এর দানবিক হুমকির সঙ্গে সিংহভাগ স্বাস্থ্য কর্মী ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে- অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতেও সমর্থ হচ্ছেন তারা।
জনসংখ্যা ঘনত্বের দিক থেকে এগিয়ে থাকা; উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ২০ কোটি। পাশের রাজ্য বিহারের অধিবাসীদের সংখ্যা ১০ কোটি ৪০ লাখ। এদুটি রাজ্যেই গ্রামে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।
বিহার হচ্ছে; ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলির একটি। রাজ্যটির এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। ২০১৯ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য চিত্র প্রকাশনায় বলা হয়, রাজ্যটির প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য রয়েছেন মাত্র ৪ জন চিকিৎসক আর হাসপাতালের একটি শয্যা। সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরও, এর আগে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা (নন-কোভিড) ভাইরাস জনিত জ্বর এবং ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় হিমশিম খেয়েছে।
উত্তর প্রদেশে ১৩৫টি হাসপাতাল শুধুমাত্র কোভিড রোগীদের নিয়ে কাজ করছে, বলে জানায় রাজ্যটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু, গণহারে করোনা পরীক্ষায় উদ্যোগের অভাব এবং গ্রামীণ জনগণের অনীহা পরিস্থিতি নাজুক করে তুলেছে।
লক্ষ্মীপুর খেড়ি জেলার নভগাওয়া গ্রামের কৃষক অমর জিৎ সিং জানান, কিছুদিন আগে তার যকৃতে ইনফেকশন ধরা পড়লে- তিনি তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিপুল ভোগান্তির শিকার হন। কিন্তু, কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট না থাকায়, তাকে জেলা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি।
''প্রথমেই আমাকে স্থানীয় একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিলে। সেখানে করোনা টেস্টের কোনো উপকরণ ছিল না। তারপর গেলাম সামাজিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে- সেখানেও একই অবস্থা। আর এই টেস্টের রিপোর্ট না থাকার অজুহাতেই জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করেনি।''
আগামী কয়েক সপ্তাহে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ মাত্রায় উন্নীত হওয়ার প্রমাদ গুণছেন কিছু চিকিৎসক। এইমস রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি ডঃ হরজিৎ সিং ভাট্টি বলেন, ভারতে গণহারে করোনা টেস্টের উদ্যোগ শুধু নগরাঞ্চলে শক্তিশালী করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে তেমন কিছুই বদলায়নি।
গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কয়েক দশকের অবহেলা এবং অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ- আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে বড় ধরনের একটি বিপর্যয় তৈরি করবে বলেও- এসময় তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
''একে তো গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পর্যাপ্ত জনবল নেই তার উপর সেখানে জনবল বাড়াতে সরকারের কোনো পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। ভারতে মহামারি এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে বাকি। এ অবস্থায় মহামারিকে তুচ্ছ করে দেখার- সরকারি উদাসীনতার ফলাফল খুব বিপজ্জনক হতে পারে" ভাট্টি বলছিলেন।
চলতি সপ্তাহে ভারতে প্রতিদিনের দৈনিক সংক্রমণের রেকর্ড ৬৭ হাজারের ঘরে। মৃতের সংখ্যাও ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় গ্রামীণ স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা নিয়ে দেশটির বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান