মহামারির ভেতর আরেক উদ্বেগ: ঘুম আসে না!
নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে একজন মানুষ ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা আরও প্রকট। ভাইরাস থেকে মুক্তি লাভ করলেও এ ভোগান্তি থেকে যায় দীর্ঘদিন।
তাদের উদ্দেশ্যেই ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার কেইক স্কুল অফ মেডিসিনের ক্লিনিকাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং ঘুম বিশেষজ্ঞ ডা. রাজ দাশগুপ্ত বলেন, "আপনি একা নন। করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বজুড়েই ঘুমের সমস্যা তীব্র করে তুলেছে"।
ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটির জরিপ অনুসারে, করোনা মহামারির এ সময়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষের ঘুম নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো ঘুমের সমস্যা কাটাতে এড়িয়ে চলতে হবে এসব নিয়ম-
অতিরিক্ত 'স্ক্রিন টাইম'
এই বদভ্যাসটির কথা জানে সবাই, বোঝেও। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, চাইলেও কেউ যেন একে ঠিক প্রতিরোধ করতে পারছে না। সারাদিন ডিভাইসের ভেতর থেকেও ঘুমের আগে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটারে একবার অন্তত চোখ না বুলালে আমাদের যেন ষোলকলা পূর্ণ হয় না। অথচ এই যে, ক্ষণিকের চোখ বুলানো, এর ফলে স্ক্রিনের এই নীল রশ্মি (ব্লু লাইট এফেক্ট) আমাদের স্নায়ুর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
স্ক্রিনের নীল আলো শরীরে মেলাটোনিনের স্তরকে দমিয়ে রাখে। সারাদিন শেষে যখন অন্ধকার হয়ে আসে তখন এই হরমোন সক্রিয় হতে থাকে। ঘুমের জন্য এই "স্লিপ হরমোন" এর উচ্চ মাত্রা দরকার । রাত ২টা-৪টার সময় মেলাটোনিন সবচেয়ে কার্যকর থাকে।
ফলে ঘুমের অন্তত এক ঘন্টা আগে সব ধরনের ডিভাইসের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। যতটা সম্ভব ঘরকে অন্ধকার রাখতে পারলে ভাল। এমনকি ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি শোয়ার ঘরের বাইরে চার্জ দেয়া উচিত।
নিশাচর পেঁচার জীবন!
কর্মব্যস্ত জীবনের চাপ, আর রাত জেগে স্মার্টফোনের পর্দা স্ক্রল করে যাওয়া- সব মিলিয়ে আমাদের ঘুমের স্বাভাবিক সময় বিলম্বিত হচ্ছে। দেরিতে ঘুমানোর ফলে মানুষ সকালেও সময়মত উঠতে পারছে না। এই রুটিনেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলো ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে 'ডিলেইড স্লিপ ফেজ সিনড্রোম' বা 'নাইট আউল সিনড্রোম' বলা হয়। কারণ 'সকাল বেলার পাখি' হয়ে উঠা আমাদের আর হচ্ছে না, আমাদের জীবনযাপন প্রণালী মেলে নিশাচর পেঁচার সাথে ।
দেহের জৈবিক ঘড়ি (বায়োলজিকাল ক্লক) এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না।
শরীরের সমস্ত হরমোন, তাপমাত্রা, খাওয়া ও হজম এবং ঘুমের চক্র-সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় বায়োলজিকাল ক্লকের সময়সূচী অনুসারে। ঘুমের প্রাকৃতিক সময়টুকু স্বাভাবিক না থাকায় বায়োলজিকাল ক্লক তার ছন্দ মেলাতে পারছে না।
রাতের শিফটে কাজ করেন এমন কিছু পেশাজীবির ওপর পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে হৃদরোগ, আলসার, হতাশা, স্থূলতা এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে; তাছাড়া এদের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনা এবং আহত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
আবার অনেকেই আছেন যারা অন্যান্য দিনে নিয়ম মেনে চললেও ছুটির দিনে সামান্য হেরফের করেন । অন্য এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত ঘুমের সময়ে কেউ যদি ৯০ মিনিটের ব্যবধান নিয়ে আসেন, তাহলেও বছর পাঁচেকের ভেতর তার কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
দুপুরের আয়েশি ঘুম আর নয়
আয়েশ করে দুপুরে লম্বা একটা ভাতঘুম দিতে কার না ভাল লাগে! ইংরেজিতে আরও রসিয়ে একে বলা হয় 'বিউটি স্লিপ'। কিন্তু সাবধান! ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি বলছে, কোন ভাবেই দিনের এই অন্তর্বর্তীকালীন ঘুম যেন ৪৫ মিনিটের উর্ধ্বে না হয়।
সময় সম্পর্কে সাবধানতার একটি কারণ হলো, আমরা সাধারণত ঘুমের ৩০-৪০ মিনিটের ভেতর 'গভীর ঘুম দশা'য় প্রবেশ করি। দিনের বেলা হওয়ায় সেই দশায় প্রবেশের পরও আপনি ঘুমটা সম্পূর্ণ করতে পারবেন না। কর্মক্ষেত্র বা বাসা, কোন না কোন কাজে ফিরতেই হবে। পাশাপাশি দেহঘড়ির সময়েও গড়বড় শুরু হয়ে যাবে যা আপনার রাতে ঠিক সময়ে ঘুম আসা পরিহার করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত ১৫-২০ মিনিটের হালকা তন্দ্রা উপকারী। এটি ক্লান্তি হ্রাস করে, সৃজনশীলতা বাড়ায়, সতর্কতা বৃদ্ধি করে, জ্ঞান বাড়াতে সাহায্য করে এবং মেজাজ ভাল রাখে। ডা. দাশগুপ্তের পরামর্শ হলো- ভাতঘুম যদি দিতেই হয় তাহলে দুপুর ২টার ভেতর সেরে ফেলুন তা।
সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা
আচ্ছা ধরুন, আপনি জিমে গিয়ে ট্রেডমিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, কোন ব্যায়াম করছেন না। তাহলে কোন লাভ হবে? হবে না তো। ঠিক তেমনি, ঘুম না আসলে আমরাও অনেক সময় সিলিংয়ের দিকে বৃথা তাকিয়ে থাকি। এতে ঘুমের কোন উপকার হয় না।
অনিদ্রায় ভোগা মানুষদের আরেকটি পরিচিত অথচ সেকেলে পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে - ভেড়া গোনা! এখন ঘুম বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে লাভ নেই। ২০ মিনিটেও যদি ঘুমে দু'চোখের পাতা এক না হয়, তবে ঘর বদল করে দেখতে পারেন। যে ঘরে আলো আরেকটু কম, সেখানে চেষ্টা করে দেখুন।
বারেবারে সময় দেখা
ঘুম না আসলে আমাদের আরেকটি বদভ্যাস হলো, একটু পর পর ঘড়ি দেখা আর সময়ের হিসেব কষা।
এর ফলে উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায় আমাদের। 'এখনো ঘুমাতে পারলাম না, সকালে সময়মত কীভাবে উঠব'-এসব দুশ্চিন্তা ঘুম আসতে আরও বিলম্ব ঘটায়।
এলকোহল গ্রহণ
হ্যা, প্রথমে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্নতা লাগবে কিন্তু বিশ্বাস করুন ঘুমের আগে বিয়ার, ওয়াইন বা অ্যালকোহল পান করা আপনার ঘুমের একেবারে সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়বে।
অ্যালকোহল অ্যাসিটালডিহাইড তৈরি করে দেহে উদ্দীপনা বাড়িয়ে তোলে।
কেউ যখন ঘুমের আগে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন করে, তা পরবর্তী চার ঘন্টার ভেতর ঐ ব্যক্তির দেহে অ্যাসিটালডিহাইডে রূপান্তরিত হয়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
ডা. দাশগুপ্ত আরও বলেন, "অ্যালকোহল শরীরে অ্যান্টি-ডাইইউরেটিক (এডিএইচ) হরমোনকে বাধা দেয়, যার ফলে রাতে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসতে পারে। এটিও নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের অন্তরায়"।
শরীরচর্চা না করা (কিংবা ভুল সময়ে করা)
শরীরচর্চার অভাব ঘুম না আসার পেছনে অনেক বড় অবদান রাখে! যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করে তাদের ঘুম আসার প্রবণতা, যারা করে না তাদের চাইতে দ্বিগুণ- ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন এই মত দিয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার বিষয়টিও দুর্বল ঘুমের সাথে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়।
আবার একদম ঘুমের আগ দিয়ে ব্যায়াম করাও সমীচীন নয় বলে মনে করেন ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটির বিশেষজ্ঞরা।
পরিমিত ব্যয়াম দেহে তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে, আমাদের আরও জাগ্রত করে তোলে। এছাড়া শরীরচর্চার ফলে দেহে এন্ডোরফিনের নিঃসরণ হয়-এটিও আমাদের ঘুমের পরিবর্তে সজাগ করে তোলে।
তবে ঘুমের আগে সামান্য ইয়োগা বা স্ট্রেচিং এ কোন বাঁধা নেই। এসব পেশীর শিথিলকরণে সহায়তা করতে পারে।
ঘুমের ওষুধ সমাধান নয়
একটি গবেষণায় দেখা গেছে গত বছরের মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে মানুষের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার হার ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘুম নিয়ে আসতে এটি একেবারেই ভাল সমাধান নয়।
ঘুমের ওষুধে আসক্তি হয়ে গেলে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। স্মৃতিশক্তি হ্রাস, আগ্রাসী মনোভাব, হতাশা এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা আসাও অবান্তর নয়।
ডা. দাশগুপ্ত এখানেও মেলাটোনিনের প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, "মেলাটোনিন একটি প্রাকৃতিক যৌগ যা স্বাভাবিক উপায়ে রাতে শরীর থেকে নিঃসরিত হয়। ঘুমের ওষুধ মেলাটোনিনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, দীর্ঘমেয়াদে এটি অনিদ্রার মত উপসর্গ তৈরি করে"।
'স্লিপ হাইজিন' মেনে চলা
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যেমন ব্যক্তিগত সুরক্ষা বা পার্সোনাল হাইজিন মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হয়, তেমনি সুষম ঘুমের জন্যও বিশেষজ্ঞরা বলেন কিছু নিয়ম মেনে চলতে।
ঘুমের আগে কিছু নির্দিষ্ট কাজের ছক তৈরি করুন। কুসুম গরম পানির স্নান, বই পড়া, হালকা মেজাজের সংগীত, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যয়াম বা যোগব্যায়াম, ধ্যান -আপনার যা করতে ভাল লাগে সেটিই নির্বাচন করুন।
আপনার বিছানা-বালিশ যেন আরামদায়ক হয়। ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখুন। ঘুমের জন্য ৬০ থেকে ৬৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট সবচেয়ে ভাল।
শোবার ঘরে টিভি দেখবেন না বা কাজ করবেন না।
অনিদ্রা থাকলে দুপুরের পর থেকে নিকোটিন, কফি, ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি, সোডার মতো উদ্দীপক পানীয় এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত মশলাদার খাবার আপনার পেট এবং ঘুম উভয়ের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। বিকল্প হিসেবে ক্যামোমাইল টি নিতে পারেন, এই ভেষজ চা শিথিলকরণে সহায়তা করে।
এসব টিপস অনুসরণের পরেও যদি ঘুমের সমস্যা না কাটে তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
- সিএনএন অবলম্বনে