ঘুমাতে যাওয়ার নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা কেন জরুরি?
শৈশবের স্মৃতি যতটুকু মনে করতে পারি, একটা দৃশ্য আমার চোখে ভাসে। আমার ভাই আর আমি আমাদের খেলনা পুতুল দিয়ে খেলছি। একসময় আমরা পুতুলগুলোকে বিছানায় শুইয়ে দিতাম। ঠিক যেমনটি আমাদের শুইয়ে দিতেন বাবা-মায়েরা। শিশু পুতুলগুলোকে নাহয় ঘুমোতে দিলাম। কিন্তু আমরা প্রাপ্তবয়স্করা (অর্থাৎ শৈশবের আমরা)? খুশি খুশি সিদ্ধান্ত নিতাম যে আমরা সারারাত জেগে থাকব।
জীবনের কী সব আঁকাবাঁকা মোড়! তখন সারারাত জাগতে চাইতাম। আর পরিণত বয়সে এসে এখন ঘুমাতে চাই। পাঁচ সন্তানের মা হিসেবে সবাইকে ঘুম পাড়ানোর পেছনে অনেক বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয় আমাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেও যেন ঘুমাতে পারি সেজন্য বোধয় শক্তিটা অনেক বেশিই ব্যয় ফেলি।
আমাদের জীবনের ব্যস্ত বছরগুলোতে, অর্থাৎ ক্যারিয়ার এবং পরিবার গড়ার সময় কাজে এতটা নিমগ্ন থাকতে হয় যে একটু কোয়ালিটি সময়ের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকি। তখন ঘুমকে মনে হয় একটা সাদা পাখনাওয়ালা বন্ধু যে কিনা অধরা!
আমাদের মাঝে অনেকে প্রায়ই ক্লান্ত অনুভব করেন (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তঙ্ক দ্য ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন বলছে প্রাপ্তবয়স্করা প্রতি সপ্তাহে সাত দিনের মাঝে গড়ে তিনদিন নিদ্রালু থাকেন)। অন্যদিকে বিখ্যাত 'টাইম ডায়েরি' গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্করা (এমনকি ব্যস্ত ব্যক্তিরাও) পরিমাণগত দিক থেকে পর্যাপ্ত ঘুম ঘুমানোর সুযোগ পান।
কয়েক বছর আগে আমি উচ্চ বেতনধারী (ছয় অঙ্কের বেতন) এবং সন্তান আছে এমন নারীদের এক হাজার এক দিনের ওপর একটি টাইম ডায়েরি জরিপ করেছিলাম। ফলাফলে দেখলাম, তারা দৈনিক গড়ে ৭.৭ঘণ্টা ঘুমাতে পারছেন। এমনকি বড় বড় কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারাও (সিইও) দৈনিক সাত ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পান।
তাহলে পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া স্বত্ত্বেও আমরা কেন এত ক্লান্ত অনুভব করি?
জরিপগুলোর এই গড়ের হিসাবের আড়ালে অনেক সমস্যা লুকিয়ে আছে। দেখা যায়, অনেকের ঘুম নিয়মিত ও যথাসময়ে না হয়ে বরং অগোছালো হয়; অনেকে রাতে হয়তো কম ঘুমাচ্ছে আবার অনেকে মাত্রাতিরিক্ত।
যাদের শিশু সন্তান আছে কিংবা যাদের একেক সময় একেক শিফটে কাজ করতে হয় (যেমন নার্সদের), তাদের জন্য এটি সাধারণ ঘটনা। দেখা যায় একদিন হয়তো বেশি ঘুম হচ্ছে, পরদিন হয়তো কাজের চাপে ঘুমানোর সময়টাই পাচ্ছেন না।
পর্যাপ্ত পরিমাণের চেয়ে কম কিংবা বেশি ঘুমানোর কারণে কোনো কোনো দিনে অবসাদ আনতে পারে, কাজের শিডিউলে আনতে পারে বিশৃঙ্খলা- যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তির মানসিক অবস্থা এবং উৎপাদনশীলতার ওপর।
উদাহরণস্বরূপ, শনিবারদিন সকালে দেরিতে উঠলেন বা দুপুরে ঘুমালেন। পরে দেখবেন সেদিন রাতে আপনার ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আপনার রবিবারে কাজে যাবার জন্য হোক বা অন্য কারণে হোক সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। যার ফলে রাতে দেরিতে ঘুমানোর পরেও সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার দরুন আপনার পর্যাপ্ত ঘুম হলোনা। অর্থাৎ সপ্তাহের শুরুটাই করলেন আপনার শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুম দিয়ে। আবার রবিবারে দেরিতে ঘুমাতে গেলেন এবং পরেরদিন সোমবারে ভোরে উঠে পড়লেন। এভাবে করে নির্ঘুমহীনতা যত বাড়ছে, আপনার ঘুমের দায় তত পুঞ্জিভূত হচ্ছে।
ঘুমের ক্ষেত্রে এই ঋণ বা দায়ের কোনো ক্ষমা নেই। আপনার শরীর চেয়ে বসলে আপনাকে ঘুমাতেই হবে।
মঙ্গলবারের রাতে ঘুমের সাথে যুদ্ধে হেরে কাজ করতে করতে কিংবা টিভি দেখতে দেখতেই সোফায় ঘুমিয়ে পড়লেন। বুধবারে আপনার সন্তানকে শোয়াতে ঘিয়ে আপনি নিজেই ঘুমিয়ে পরলেন। বৃহস্পতিবারে এত ঘুমালেন যে কখন এলার্ম বেজেছিল আপনি টেরই পাননি। পরদিন শুক্রবারে ভাব্লেন আজ তো বন্ধ্র দিন একটি গবেশি ঘুমাই। পরে দেখলেন রাতে ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে যার কারণে পরদিন শনিবারে দেরিতে উঠতে হলো। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সপ্তাহজুড়ে একই চক্র।
সারাদিন নিদ্রালু হয়ে থাকার প্রতিরোধ হিসেবে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে নেওয়া উত্তম। প্রায় সকল প্রাপ্তবয়স্কদের চাকরি কিংবা পারিবারিক কাজের জন্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে উঠতে হয় বলে তাদের সকালে ওঠার সময়টা অনেকটা অপরিবর্তনশীল। তাই এক্ষেত্রে তারা আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার সময়টা প্রয়োজনমতো করে নিতে হবে।
অর্থাৎ আপনার প্রয়োজন 'শয়নকাল'—ঘুমাতে যাওয়ার নির্দিষ্ট একটি সময়। যদি একান্তই কোনো গুরুতর সমস্যা না থাকে, তবে আপনার অবশ্যই একটি শয়নকাল নির্ধারণ করে রাখা উচিত। প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হলে, সারাদিন প্রয়োজনীয় শক্তি তো পাবেনই, কাজের উৎসাহও পাবেন।
কীভাবে 'শয়নকাল' নির্ধারণ করবেন?
এটি সাধারণ একটি গাণিতিক সমস্যা।
অধিকাংশ দিনে আপনার কয়টার সময় ঘুম থেকে ওঠা প্রয়োজন তা ঠিক করুন। উদাহরণস্বরূপ, সাপ্তাহিক কর্মদিবসগুলিতে আমার সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দিতে ভোর সাড়ে ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়।
এরপর আপনার কয় ঘণ্টা ঘুম লাগবে তা হিসাব করুন। এই যেমন আমার সাড়ে সাত ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। আপনার কয় ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন তা নিয়ে নিশ্চিত না হলে, আমার মতো আপনিও সাড়ে সাত ঘণ্টা ধরতে পারেন। আবার হিসাবে ফিরে যাওয়া যাক। দৈনিক সাড়ে সাত ঘণ্টার ঘুম ঘুমিয়ে ভোর সাড়ে ছয়টায় উঠতে হলে ঘুমাতে হবে রাত ১০টায়। যাদের আট ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন এবং সকাল আটটার আগে না উঠলেও চলে, তারা একটু দেরিতে ঘুমাতে পারেন।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে ৩০মিনিট বিশ্রাম করুন।
এই অভ্যাসটি খুব সাধারণ মনে হতে পারে, তবে প্রকৃতপক্ষে এটি আপনার জীবন বদলে দিতে পারে।
আমার সাম্প্রতিক বইটির জন্য পরিচালিত গবেষণার অংশ হিসেবে আমি ১৫০ জন ব্যক্তিকে নয় সপ্তাহ যাবত শয়নকাল পর্যবেক্ষণ করতে বলি। প্রজেক্টটি শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পরে তাদের জিজ্ঞাসা করি যথেষ্ট বিশ্রান্ত অনুভব করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম পাচ্ছেন কি না। শুরুতে পর্যাপ্ত ঘুম প্রাপ্তদের সংখ্যা প্রজেক্ট শেষে গিয়ে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি পাচ্ছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে স্কোর বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৩ শতাংশ।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, 'পর্যাপ্ত ঘুম কাজের ক্ষেত্রে আমার নিজের সবচেয়ে ভালো স্বত্ত্বাকে বেড় করতে পেরেছে। সপ্তাহে যা যা করার পরিকল্পনা থাকে সেগুলো করার পর্যাপ্ত শক্তি থাকে। এটি আমাকে খুশি করে।'
তবে মাথায় রাখা উচিত যে, নির্ধারিত শয়নকাল যে কোনো সময় বানচাল হয়ে যাবে না—এমনটি কিন্তু নয়। কোনো কোনো দিন কাজে অতিরিক্ত চাপ থাকতে পারে, না করা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দুশ্চিন্তা হতে পারে অথবা শিশু সন্তান রাতে কেঁদে উঠল বলে ঘুম কম হতে পারে। আবার অনেক সময় আমরা ইচ্ছা করেও ঘুমানোর চেষ্টা না করে জেগে থাকি। কিংবা বাড়ির কাজ শেষ করার পর নিরিবিলি পরিবেশে নিজের জন্য টুকিটাকি কাজ করতে ইচ্ছা হয়। অনেকের কাছে এটিই 'নিজের জন্য একমাত্র ফ্রি-টাইম!'
আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয়, ইশ! রাত ১১টার আগের সময়টা যদি ধীরগতিতে যেত! তবে আপনি যদি এই 'ফ্রি-টাইম' আরেকটু দীর্ঘ হয়ে পেতে চান, অর্থাৎ একটু দেরিতে ঘুমাতে চান দুটো জিনি স্মরণে রাখতে পারেন।
প্রথমত, আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। রাত জাগার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকলে নিশ্চয় জাগবেন। শয়নকাল নির্ধারণ করা কেবল একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাতে করে নির্বোধভাবে নির্ঘুম রাত না কাটে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ব্যস্ত সময় থেকে আমরা নিজেদের জন্য 'মি-টাইম' বের করতে পারি। অর্থাৎ নিজের শারীরিক কিংবা মানসিক যত্ন নিতে সময়ে করে নিতে পারি। সবচেয়ে ভালো হয় প্রতি সপ্তাহে কাজ এবং পারিবারিক দায়িত্ব থেকে একদিন বিরতি নিলে। পুরো একটি দিন সংসারের যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে ছুটি নেন। এই সময়ে পছন্দের কোনো বই পড়তে পারেন অথিওবা অন্যন্য শখের কাজ করতে পারেন।
এত করে আপনি নিশ্চিতে ঘুমাতে পারবেন, সাথে সময়টাও উপভোগ করতে পারবেন। তবে এটা পারবেন, যদি শয়নকাল নির্ধারণ করে রাখেন। হয়তো এটি মজার কোনো কাজ বলে মনে হচ্ছেনা। কিন্তু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়াই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সুবিধাজনক। ব্যাপারটিকে বরং এভাবে দেখুন—প্রাপ্তবয়স্করা একটু আগেই ঘুমাতে যায়। তাহলে মনে হবে শয়নকাল অনুসারে ঘুমাতে যাওয়া মজার একটি কাজ।
- হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ থেকে অনূদিত