রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: এখনো কান্না ভেসে আসে
২৪ এপ্রিল ২০১৩। সকাল ৮:৪৫। ঢাকার অদূরেই, সাভার বাসস্ট্যান্ড। পাশেই বহুতল ভবন- রানা প্লাজা। ভেতরে কাজ করছিলেন পোশাক শ্রমিকরা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভবনটি ধসে পড়ল। মাটির নিচে দেবে গেল কয়েক তলা। কিছু অংশ ধসে পড়ল পাশের এক ভবনের ওপর।
পৃথিবীর ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম ওই শিল্প দুর্ঘটনায় কম-বেশি ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। বিপরীতে, মানবতার এক উজ্জ্বল উদাহরণের দেখা পেয়েছিল বিশ্ববাসী। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার অভিযানে নেমেছিলেন অনেক সাধারণ মানুষ।
রানা প্লাজা ভবনে ছিল কয়েকটি পোশাক কারখানা। ছিল একটি ব্যাংক এবং একাধিক অন্যান্য দোকান। জানা যায়, ভবনটিতে আগে থেকেই ফাটল থাকলেও কর্তৃপক্ষ সেটি উপেক্ষা করাতেই ঘটেছিল ওই ট্র্যাজেডি।
এখনো ওই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন কিছু শ্রমিক। তাদেরসহ নিহতদের আর্তনাদে এখনো ভারি হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ বাতাস। কান পাতলে শোনা যায় আহতদের ফোঁপানো কান্না।
রেশমা এখন
ওই ঘটনার ১৭ দিন পর, ১০ মে ধ্বংসস্তূপ থেকে রেশমা বেগম নামে এক মেয়েকে জীবিত উদ্ধার করার মতো অনেকটা অলৌকিক ঘটনারও সাক্ষী হয় এ দেশের মানুষ। কোনো রকম খাবার বা পানি ছাড়াই ওই ধ্বংসস্তূপে তিনি কীভাবে বেঁচে ছিলেন, সে এক বিস্ময়!
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে জানা যায়, রেশমা এখন ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল 'ওয়েস্টিন ঢাকা'য় কাজ করেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতে সাধারণ ছুটির কারণে এই মুহূর্তে ঢাকার কালাচাঁদপুর পশ্চিম পাড়া এলাকার ভাড়া বাসায় দিন কাটছে তার। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে রেশমার জীবন আমূল বদলে গেছে। স্বামী আতাউর রহমান রাব্বি ও কন্যা রেদওয়ানা ইসলাম রেবাকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার।
রেশমা বলেন, 'গার্মেন্ট কারখানায় যখন কাজ করতাম, দিনে দুইবেলা খাবার জুটানোই কঠিন হয়ে পড়ত। এখন ভালোই আছি। তবে আরেকটু ভালো থাকার আশা করছি।'
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, 'দেশের সব মানুষ যদি একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে, তাহলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও আমরা জিততে পারব।'
ক্রন্দন বাজে কানে
ঘটনা ৭ বছর আগের। তবু সেই সময়টি যেন থমকে আছে ট্র্যাজেডিটি থেকে বেঁচে যাওয়া আন্না খাতুনের কাছে। আহত সেদিনের সেই কিশোরী এখন ২১ বছরের তরুণী। প্রাণে বেঁচে গেলেও সব স্বপ্ন তার কেড়ে নিয়েছে ওই দুর্ঘটনা। তাকে চিরদিনের জন্য বসিয়ে দিয়েছে হুইলচেয়ারে।
সেদিনের দুর্ঘটনায় তার ডান হাতের ওপর ভেঙ্গে পড়েছিল একটা বীম। দুর্ঘটনার দুইদিন পর হাত কেটে তাকে উদ্ধার করা হয় ধ্বংসস্তূপ থেকে। চিকিৎসা চলাকালে, প্রাণ বাঁচাতে তার ডান পা-ও কেটে ফেলে দিতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা।
আন্নার বাবা বাদশাহ মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত আমার মেয়ে। এখন ছোট্ট একটা ঘরে বন্দি ওর পৃথিবী। বাথরুমে যাওয়া, গোসল করার মতো ছোটখাট কাজেও নিজের যত্ন নেওয়ার সক্ষমতা ওর নেই।'
আন্নার মতো আরও অনেকের জীবনগতিই প্রায় থমকে দিয়েছে ওই দুর্ঘটনা।
রেশমা ও আন্নারা তবু ভাগ্যবতী, অন্তত প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। ওই দুর্ঘটনা যাদের জীবন কেড়ে নিয়েছে, তাদের স্বজনরা নিশ্চয়ই এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি হয়তো ফুরিয়ে গেছে অনেকের। তবু বোবাকান্নার শব্দ একটু কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যায়!