রাসায়নিক কীটনাশকের কবল থেকে মুক্তি দিতে পারে প্রাকৃতিক কীটনাশক ‘পাইরেথ্রাম’
প্রতিদিন সকালে কেনিয়ার গ্রেট রিফট ভ্যালিতে জন্মানো সাদা রঙের পাইরেথ্রাম ফুল তুলতে যান একদল মানুষ। মানুষের জন্য ফুলটা নিরীহ। কিন্তু ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের জন্য পাইরেথ্রাম এক বিভীষিকার নাম। ফুলটির হলুদ কেন্দ্রে থাকে এক ধরনের প্রাকৃতিক বিষ, যা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কীটপতঙ্গের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
পাইরেথ্রিন আবিষ্কৃত হয় পারস্যে, ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এ ফুলে পাইরেথ্রিন নামে একটি উপাদান থাকে, যা প্রাকৃতিক কীটনাশক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পরজীবী কীটপতঙ্গ, পিঁপড়া ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর জাবপোকা মারতে এই প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করেন অনেক দেশের কৃষকরা। রাখালরা গবাদি পশুকে মাছিসহ অন্যান্য পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পশুর গায়ে পাইরেথ্রিনের মলম মাখিয়ে দেয়।
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণের মাধ্যমে কীটপতঙ্গকে চলৎশক্তিহীন করে ফেলে পাইরেথ্রিন। পোকামাকড়ের ওপর পাইরেথ্রিনের স্প্রে ছিটালে প্রথম ৩০ সেকেন্ড পোকামাকড় মাতালের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করে, তারপর ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়।
বাড়িতে ক্রিসেনথেমাম সিনেরেরিফোলিয়াম, ওরফে পাইরেথ্রাম গাছ লাগিয়ে ক্ষতিকর বেলেমাছির উপদ্রব থেকে মুক্তি পেতে পারেন। প্রতি বছর এই বেলেমাছির কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। বেলেমাছির কামড়ে মুখে ফুসকুঁড়ি ওঠে। সময়মত চিকিৎসা না করালে এই ফুসকুঁড়িতে মানুষ মারাও যেতে পারে।
ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে পাইরেথ্রিন। ফি-বছর মশার কামড়ে অসুস্থ হয়ে বিশ্বজুড়ে ৪ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পাইরেথ্রিন থেকে তৈরি মশার কয়েল ধূপের মতো ধোঁয়া ছড়ায়। এ কয়েলের ধোঁয়া মশার জন্য প্রাণঘাতী হলেও মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।
কেনিয়ার কৃষি কর্মকর্তা মেইনা কিবেত বলেন, 'পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীটনাশক হলো পাইরেথ্রিন। এটি প্রাকৃতিক, অরগানিক এবং এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এছাড়াও এটি ব্যবহারবান্ধব।'
কেনিয়ার বহু মানুষ পাইরেথ্রাম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পাইরেথ্রাম মাত্র দু-সপ্তাহের মধ্যে জন্মায়। ফুল তোলার পর এগুলো শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়।
কেনিয়ার পাইরেথ্রিন শিল্পের ইতিহাস
১৯৭০ ও '৮০-র দশকে পৃথিবীর প্রধান পাইরেথ্রাম উৎপাদনকারী দেশ হয়ে ওঠে কেনিয়া। ১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে দেশটিতে এ ফুল নিয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনকারীরা। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে কেনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ফসল হয়ে ওঠে পাইরেথ্রাম। পৃথিবীর ৭০ শতাংশ পাইরেথ্রামই তখন আসত কেনিয়া থেকে। দেশটির প্রায় ২ লক্ষ কৃষক এ ফুল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত তখন।
১৯৫৩ সালে স্বাধীনতা লাভের পর কেনিয়ার কাছে পাইরেথ্রামের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। আজও কেনিয়ার স্কুলে জাতীয় পাঠ্যতালিকার আওতায় পাইরেথ্রামের চাষবাস সম্পর্কে পড়ানো হয়।
১৯৮০-র দশকে কেনিয়ায় পাইরেথ্রামের উৎপাদন তুঙ্গে ওঠে। তবে ১৯৯০-এর দশকে শিল্পটি ক্রমেই লোকসানের মুখ দেখতে দেখতে একসময় সম্পূর্ণ ধসে পড়ে।
কেনিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাইরেথ্রাম বোর্ড অফ কেনিয়া বেসরকারি কোম্পানিকে বাজারে ঢুকতে দিত না। ফলে অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে টক্কর দিতে পারছিল না কেনিয়া। পাইরেথ্রাম বোর্ডও পাইরেথ্রাম চাষিদের টাকা দিতে পারছিল না। এক পর্যায়ে কৃষকদের টাকা দেওয়াই বন্ধ করে দেয়। বাধ্য হয়ে অনেক পাইরেথ্রিয়াম চাষি পেশা বদলে ফেলেন। এর ফলে ধসে পড়ে কেনিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতি।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
২০১৮ সালে পাইরেথ্রিয়াম চাষিদের পাওনা মেটায় পাইরেথ্রিয়াম বোর্ড। অনেক রাসায়নিক কীটনাশকই নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন আবার প্রাকৃতিক কীটনাশক তৈরির জন্য পাইরেথ্রামের চাহিদা বাড়ছে। ফলে ধীরে ধীরে আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে পাইরেথ্রাম শিল্প।
কেনিয়ার মধ্যাঞ্চলের উঁচু অঞ্চলের পরিবেশ পাইরেথ্রাম চাষের জন্য আদর্শ। এছাড়া খাড়া ঢালেও অনায়াসে পাইরেথ্রাম জন্মানো যায়।
কেনিয়ার এসব উঁচু অঞ্চলের মাটি যেমন উর্বর, তেমনি সূর্যের আলোও পাওয়া যায় বিস্তর—ফলে পাইরেথ্রামের ফলন হয় খুব ভালো। এ অঞ্চলের কড়া রোদে ফুল খুব তাড়াতাড়ি শুকায়।
পাইরেথ্রাম চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কেনিয়ার অনেক চাষিই আলু চাষ শুরু করেছিলেন। ২০১৯ সালে তারা আবার পাইরেথ্রাম চাষের সুযোগ পান। এখন এ ফুল চাষ করে দুই মাসে তারা যে পরিমাণ টাকা আয় করেন, আলু চাষ করে সেই টাকা কামাতে এক বছর লেগে যেত। পাইরেথ্রাম এসব কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, সচ্ছলতা এনেছে তাদের পরিবারে। তাদের মাথা থেকে ঋণের বোঝা নেমে গেছে পাইরেথ্রাম চাষের কল্যাণে। তাদের সন্তানরা ভালো খাবারদাবার পাচ্ছে, স্কুলে যেতে পারছে। তাদের পথ ধরে তরুণ, এমনকি শিশুরাও এখন পাইরেথ্রাম চাষি হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
তবু পাইরেথ্রাম চাষের পথে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে। এক একর জমিতে চাষের জন্য ২২ হাজার বীজ লাগে, খরচ পড়ে ৮৫০ ডলার। কেনিয়ার বহু কৃষকেরই এত টাকা জোগাড় করার সামর্থ্য নেই। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে পাইরেথ্রিন অন্য উদ্ভিদকে পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেও খোদ পাইরেথ্রাম ফুলই থ্রিপস পোকার আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। এই পোকা পাইরেথ্রামের সমস্ত পানি ও পুষ্টি উপাদান খেয়ে ফেলে। পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে, রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার করে পাইরেথ্রামকে ভালো রাখা যায়। কিন্তু সেই স্প্রে কেনার সামর্থ্যও কেনিয়ার কৃষকদের নেই। এছাড়াও পাইরেথ্রাম চাষ করে টাকা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান।
হুমকির মুখে থাকা জীববৈচিত্র্যের ত্রাতা হতে পারে পাইরেথ্রাম
কেনিয়ার পাইরেথ্রিন শিল্প যেহেতু ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তাই এ শিল্প আরও বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বজুড়ে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যাপক সমালোচনার মুখে আছে। সারা বিশ্বে মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য রাসায়নিক কীটনাশককে দায়ী করা হয়। রাসায়নিক কীটনাশকের কারণে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে অনেক জলাধারের পানি ও মাছ। এসব পানিতে ভাসমান প্ল্যাঙ্কটন ও মাছ খেয়ে মারা যাচ্ছে বহু পাখি। কিছু কীটনাশক টিকটিকি, ইঁদুর, খরগোশ, হরিণসহ অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্যই ক্ষতিকর। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মশাখেকো প্রাকৃতিক শিকারীকে বিষাক্ত করে ফেলে রাসায়নিক কীটনাশক। এর ফলে বেড়ে গেছে মশাবাহিত রোগের হার।
এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে পাইরেথ্রিন। সূর্যের আলো ও উত্তাপে এটি প্রাকৃতিকভাবেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফসলে প্রয়োগ করার চব্বিশ ঘণ্টা পর পরিবেশবান্ধব পাইরেথ্রিন মাটিতে মিশে যায়। রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে পাইরেথ্রিন থেকে তৈরি প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করলে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা পেতে পারে জীববৈচিত্র্য, বিষের হাত থেকে রক্ষা পাবে ফসল।
-
সূত্র: ন্যাশনালজিওগ্রাফিক.কম