৪৬৭ দিনের আন্দোলনে কৃষকদের দৃঢ়তার সামনে যেভাবে হার মানলেন মোদি
কৃষক আন্দোলনের সামনে অবশেষে হার মানতে বাধ্য হলো মোদি সরকার। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই আন্দোলন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা আন্দোলনের ডাক দিলেও তাদের সঙ্গে যোগ দেয় উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার, মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা। টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রায় ৬০০ কৃষক মারা যান। এদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। আহত হন কয়েক হাজারের বেশি কৃষক। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কিংবা ভারতে করোনার তীব্র প্রকোপও এই আন্দোলনকারীদের দমাতে পারেনি।
আন্দোলনের শুরু থেকেই পাঞ্জাবের শিখ কৃষকদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। অবশেষে শিখ ধর্মপ্রধান গুরু নানকের জন্মজয়ন্তীর দিন বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা দিলেন নরেন্দ্র মোদি। কৃষকদের খেপিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যে সম্ভব নয় তা দেরীতে হলেও মোদি মেনে নিয়েছেন। আর তাই সংসদে সর্বাধিক প্রতিনিধি পাঠানো উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবসহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগমুহূর্তে কৃষকদের মন জয়ের এই চেষ্টা।
ভারতের ১৩০ কোটি জনগোষ্ঠীর ৫৮ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতিতে কৃষিখাত গুরুত্বপূর্ণ হলেও ক্ষমতাসীনরা দীর্ঘদিন করপোরেট প্রতিনিধির মতোই আচরণ করেছেন। সাধারণ মানুষের পরিবর্তে বরাবর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিতর্কিত তিন কৃষি আইনেও মিলেছে তার প্রতিফলন।
কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও ভারত কৃষিবান্ধব হতে পারেনি। দেশটিতে প্রতিবছর গড়ে ১২ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেন। সরকারের দাবি ছিল, কৃষি আইন বাস্তবায়িত হলে কৃষকদের অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হবে। তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেই দাবি বরাবরই উড়িয়ে দিয়েছেন।
কৃষক নেতাদের বক্তব্য, এই আইন বাস্তবায়িত হলে শুরুতে কৃষকরা বেশি দাম পেলেও একসময় পুরো বাজারে আম্বানি কিংবা আদানির মতো গুটিকয়েক শীর্ষ ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। মুক্তবাজারে প্রান্তিক কৃষকরা অচিরেই হারিয়ে যাবেন।
তবে সরকারবিরোধী এই কৃষি আন্দোলন একদিনে গড়ে উঠেনি। ক্ষমতায় থাকাকালে মনমোহন সিংও কৃষিখাত বাণিজ্যকরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু কৃষকদের বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, মোদি সরকারের কৃষিবিরোধী অবস্থান আঁচ করতে পেরে ২০১৬ সাল থেকেই ভারতের কৃষক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে।
২০১৭ সালে ভারতের ২৫০টি কৃষক সংগঠন মিলিতভাবে গড়ে তুলে অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি (এআইকেএসসিসি)। সংসদে কৃষি আইন প্রস্তাবের পর কমিটির ডাকে ২০২০ সালের ৯ আগস্ট 'করপোরেট ভাগাও, কিষাণ বাঁচাও' স্লোগানের মধ্য দিয়ে ভারতজুড়ে শুরু হয় সম্মিলিত কৃষক আন্দোলন। এরপর ৪৬৭ দিনের আন্দোলনে করপোরেট আগ্রাসন ও মোদি সরকারের স্বেচ্ছাচারীতার বিরুদ্ধে অটল থেকে বিক্ষোভ চালিয়ে গেছেন কৃষকরা।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো অল ইন্ডিয়ান কিষাণ কমিটিতে ধনী কৃষকদের সংগঠন ছাড়াও রয়েছে বামকেন্দ্রিক কৃষি সংগঠন। প্রতিটি সংগঠনের দাবি ও উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও কৃষি আন্দোলনে মোদির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই করেছে এসব সংগঠন।
শুধু সংগঠনগুলোই নয়, বিজেপি সরকারের ধর্মীয় মেরুকরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামেন হিন্দু, মুসলমান ও শিখ কৃষকরা। সম্মিলিত আন্দোলনের কারণেই যে নরেন্দ্র মোদি ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ভারতের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা
কৃষি আইন বিতর্কের পূর্বে ভারতের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে হবে। ভারতের প্রথম সবুজ বিপ্লবের সময় ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই)। সংস্থাটি উৎপাদন খরচের ৫০ শতাংশ লাভ ধরে ধান-গমের মতো খাদ্যশস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করে।
কৃষিপণ্য বেচাকেনার মূল কেন্দ্র হলো কিষান মান্ডি বা কৃষি বাজার। ষাটের দশক থেকে রাজ্য সরকারের অধীনে গঠিত এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেটিং রেগুলেশন কমিটি প্রতি রাজ্যের মান্ডিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মান্ডিতে এজেন্টরা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যে কৃষিপণ্য কেনাবেচার লাইসেন্স পান।
রাজ্য সরকারও এখান থেকে শুল্ক পেয়ে থাকে। অন্যান্য রাজ্যে কৃষি পণ্যের কেনাবেচা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এই মান্ডি।
কৃষি আইন নিয়ে বিতর্ক কেন
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন, কৃষিপণ্যের দাম নিরুপণে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি আইন ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সংশোধন আইন পাশ হয়। আইনগুলোর অনেক বিষয়ই পরস্পর সম্পর্কিত। কী কী কারণে আইনগুলো বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তা দেখে নেওয়া যাক।
১। কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন
কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন অনুসারে, সরকার নিয়ন্ত্রিত মান্ডিগুলোতে কৃষিপণ্য বিক্রির বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সরকারের দাবি, এর ফলে কৃষকরা মধ্যসত্ত্বভোগীদের থেকে বাঁচবে। এছাড়া আগে কৃষকরা অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যে অংশ নিতে পারতেন না। অথচ এই আইনের ফলে তারা সেই সুযোগ পাবেন। এই আইনে কৃষকদের ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির সুযোগ সৃষ্টির কথাও বলা হয়।
তবে আন্দোলনকারীদের দাবি, কৃষকরা এই আইন থেকে উপকৃত হবে না। মান্ডিগুলো বিলুপ্ত হয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষিখাতে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পণ্যমূল্য নির্ধারণের কথা বলা হলেও এই প্রতিযোগিতায় মধ্যম সারির ও ছোট কৃষকরা একসময় হার মানতে বাধ্য হবেন। ভারতের ৮৫ শতাংশ কৃষক প্রান্তিক হওয়ায় তাদের ফলনও কম। প্রান্তিক এই কৃষকদের করপোরেট বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দরাদরি করার সুযোগ থাকবে না। এছাড়া রাজ্য সরকার মান্ডির ক্ষমতা হারালে রাজস্ব সংগ্রহে ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি রাজ্যের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হবে।
২। কৃষিপণ্যের দাম নিরুপণে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি আইন
কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি আইন অনুসারে, কৃষকরা বড়মাপের খুচরা বিক্রেতা, ব্যবসায়ী বা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ফসল উৎপাদনের আগে বা পরে চুক্তি করতে পারবেন। ফলে কৃষকদের বাজার ঝুঁকি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু কৃষকরা সরাসরি চুক্তি করতে পারলেও বড় সংস্থাগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে আলাদা করে অসংখ্য চুক্তি করতে চাইবে না বলেই আন্দোলনকারীদের ধারণা। এখানেও মধ্যসত্ত্বভোগীর উদ্ভব ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
তবে কেন্দ্রীয় সরকার এর আগে ভারতে ১০ হাজার কৃষক-উৎপাদক সংস্থা গড়ে তোলার কথা জানিয়েছিল। এই কৃষক-উৎপাদন সংস্থাগুলোর কাজ হবে ক্ষুদ্র চাষীদের সাথে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দর কষাকষিতে সাহায্য করা।
৩। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে এর আগে খাদ্যশস্য মজুদের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করা ছিল। ফলে খোলাবাজারে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম বাজার সংকট তৈরির সুযোগ পেতেন না। এছাড়া, এই আইনের আওতায় সরকার জনসাধারণের রেশনের ব্যবস্থাসহ সরকারিভাবে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য কিনত।
নতুন সংশোধনী বিল অনুসারে খাদ্যশস্য, ডাল, তেলবীজ, পেঁয়াজ, আলু ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় থাকবে না। কেবলমাত্র যুদ্ধের মতো অস্থিতিশীল সময়ে পণ্য মজুদের সীমা থাকবে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা কৃষিখাতে আগ্রহী হবে বলে দাবি করে মোদি সরকার।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, এর ফলে পণ্য মজুদের মাধ্যমে বড় সংস্থাগুলো কৃষকদের ওপর ইচ্ছেমতো শর্ত আরোপ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবেন। এছাড়া জনগণের স্বার্থে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের ওপর সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর হবে না। ফলে খাদ্য নিরাপত্তাও অনিশ্চিত থাকবে।
কৃষি আইন পাশ ও আন্দোলনের সূত্রপাত
২০২০ সালের ৫ জুন ভারতের সংসদে কৃষি আইন প্রস্তাব তোলা হয়। নরেন্দ্র মোদি নতুন কৃষি প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করলে কংগ্রেসসহ বিরোধী ১২টি রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ জানায়। সংবিধান অনুযায়ী কৃষি বিষয়ক যেকোনো গবেষণা বা আইন রাজ্য সরকারের আওতাভুক্ত। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে বলে দাবি করেন তারা।
৯ আগস্ট 'করপোরেট ভাগাও, কিষাণ বাঁচাও' স্লোগানে ভারতজুড়ে আন্দোলনের ডাক দেয় অল ইন্ডিয়া কিষাণ কোঅর্ডিনেশন কমিটি। এর আগে কৃষি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জুলাইয়ে পাঞ্জাবে বিচ্ছিন্ন কিছু বিক্ষোভ হলেও এদিন থেকেই শুরু হয় সম্মিলিত কৃষক আন্দোলন।
ভারতের সংসদীয় উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় লোকসভায় প্রস্তাব উত্থাপন করে মোদি সরকার। ১৭ সেপ্টেম্বর লোকসভায় পাস হয় কৃষি অধ্যাদেশ। ২০ সেপ্টেম্বর ধ্বনিভোটে রাজ্যসভাতেও কৃষি অধ্যাদেশ অনুমোদন পায়।
এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকদের মধ্যে দেখা দেয় ক্ষোভ। ১৮ সেপ্টেম্বর অমৃতসরে রেললাইনের ওপর অবস্থান নেন কৃষকরা। শুরু হয় 'রেল রোকো' আন্দোলন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে আন্দোলন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের অনুমোদন পেয়ে কৃষি বিল পরিণত হয় কৃষি আইনে। এই ক'দিন আন্দোলন সীমিত পরিসরে থাকলেও এবার তা তীব্র রূপ ধারণ করে। পাঞ্জাবের কৃষকরা রেললাইনের ওপর অবস্থান নেওয়া ছাড়াও রিলায়েন্সের শপিং মল, পেট্রল পাম্প দখল করেন। রিলায়েন্সের পণ্য ও সেবা বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। পাঞ্জাবের নয় হাজার মোবাইল টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। আদানির শস্য মজুদাগারও দখল করেন কৃষকরা।
কৃষি আইন পাশের দিনই দিল্লি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় অল ইন্ডিয়া কিষাণ সমন্বয় কমিটি। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ২৫ ও ২৬ নভেম্বর দিল্লি ঘেরাও আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়।
কৃষক সংগঠনের সাথে অমিত শাহ বৈঠকে বসার আহ্বান জানালেও প্রথমে তারা রাজি হয়নি। পরবর্তীতে ৮ অক্টোবর প্রথম দফা ও ১৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসলেও মিলেনি কোনো সমাধান।
অবশেষে দিল্লি ঘেরাও
ভারতের সংবিধান দিবস ২৬ নভেম্বর শুরু হয় 'দিল্লি চলো' আন্দোলন। হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের কৃষকদের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের কৃষকরাও যোগ দেন। রামলীলা ময়দানে জড়ো হওয়ার জন্য ট্রাক্টর ও কয়েক মাসের খাবারসহ পায়ে হেঁটেই দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন কৃষকরা।
দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে পুলিশ জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের আটকাতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে দিল্লি পুলিশ কৃষকদের বুরারির নিরানকারি মাঠে বিক্ষোভের অনুমতি দেয়। নয়া দিল্লির বাইরে প্রধান সড়কগুলো দখল করে রাস্তায় অচলাবস্থার সৃষ্টি করেন লাখো বিক্ষোভকারী।
৩ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে কৃষক সংগঠনের দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার আলোচনাতেও মিলেনি সমাধান।
৮ ডিসেম্বর আন্দোলনরত কৃষকরা 'ভারত বন্ধের' ডাক দেন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় ভারত বন্ধ আন্দোলন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। রাস্তা অবরোধের পাশাপাশি বন্ধ রাখা হয় বাজার। কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকে অমিত শাহ কৃষি আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব আনলেও কৃষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে দিল্লিতে কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করলেও যাত্রীদের ভোগান্তির কারণে আন্দোলনরত কৃষকদের অপসারণের শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট। ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সুপ্রিম কোর্ট কৃষি আইন প্রয়োগ স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়।
দীর্ঘদিন সব শান্ত থাকলেও ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। আন্দোলনরত কৃষকরা ট্রাক্টর নিয়ে দিল্লিতে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। ট্রাক্টর উল্টে মৃত্যুবরণ করেন একজন কৃষক।
দিল্লির আন্দোলন চলাকালে বেশ কয়েকজন কৃষক কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করে আত্মহত্যা করেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পরবর্তী আন্দোলন
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে কৃষক বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আন্দোলনের ছয় মাস পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে ২৭ মে কালাদিবস পালন করেন কৃষকরা।
সেপ্টেম্বরে আবারও বেগ পায় আন্দোলন। উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনে প্রায় দেড় লাখ মানুষ যোগ দেন।
৩ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে সমাবেশে যোগ দেন কৃষকরা। সেখানে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র পরিদর্শনে আসেন। কিন্তু মন্ত্রীর গাড়ি কৃষকদের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগে শুরু হয় সংঘর্ষ। চার কৃষকসহ দুই বিজেপি কর্মীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কৃষকদের চাপা দেওয়ায় অজয় মিশ্রের ছেলের দিকে উঠে অভিযোগের আঙুল।
এতসব আলোচনার মাঝে ১৯ নভেম্বর কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন নরেন্দ্র মোদি। উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের আসন্ন নির্বাচনের কারণেই মোদি কৃষি আইন বাতিল করছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। তবে, কৃষক নেতারা জানিয়েছেন সংসদে সাংবিধানিকভাবে আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।
আন্দোলন নিয়ে যত বিতর্ক
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের বারবার বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী প্রমাণের চেষ্টা করেছে মোদি সমর্থকরা। পাঞ্জাবি কৃষকদের খালিস্তানি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কখনো এই আন্দোলনের সঙ্গে মাওবাদীদের সংশ্লিষ্টতাও টানা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও তারকারা এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন। পপ তারকা রিয়ানা, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, লেখিকা মিনা হ্যারিস আন্দোলনে কৃষকদের সংহতি জানান। কিন্তু এর বিরুদ্ধে টুইট করেন লতা মঙ্গেশকর, অক্ষয় কুমার, কঙ্গনা রানাউত, বিরাট কোহলি ও শচীন টেন্ডুলকারসহ বিভিন্ন ভারতীয় তারকা। সরকারের নির্দেশেই তারকারা এই টুইটগুলো করছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৃষ্ট বিতর্কে দুদলে ভাগ হয়ে যান নেটিজেনরা।
২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর গুরু নানকের ৫৫১তম জন্মবার্ষিকীতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এক ভিডিও বার্তায় কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে তার সরকার নয়াদিল্লির কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেন।ট্রুডোর বক্তব্যকে 'অযাচিত' উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ৪ ডিসেম্বর ভারতে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রদূত নাদির প্যাটেলকে জানানো হয় যে, এ ধরনের মন্তব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড আর গোয়ায় বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের জয় পরাজয় অনেকাংশেই উত্তরপ্রদেশের মতো জনবহুল আসনে নির্ভর করছে। এই মুহূর্তে কৃষকদের নারাজ করে আগামীবার যে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়, তা নরেন্দ্র মোদি ভালোমতোই জানেন।
কৃষকরা এই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল ক্ষমতার উৎস সাধারণ মানুষ। নিরবচ্ছিন্ন ন্যায্য আন্দোলনের সামনে স্বেচ্ছাচারী সরকারও ঝুঁকতে বাধ্য। তবে কৃষকদের আন্দোলন কেবলমাত্র কৃষি আইন বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। কেননা প্রকৃত অর্থেই কৃষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এখনও বহুপথ পাড়ি দিতে হবে।