‘কীভাবে বাঁচব, খাবার পাবো কোথায়’
বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়ট তার 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড' কবিতায় লিখেছেন, 'এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ'। অর্থাৎ এপ্রিল হচ্ছে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মাস। টিএস এলিয়টের এই লাইনটিই যেন ফিরে এসেছে ৭২ বছর পর। নোবেলজয়ী এলিয়টের ১৯৪৮ সালে লেখা কবিতার লাইনটির মতো করেই ধুঁকছে পুরো বিশ্ব। করোনাভাইরাসের প্রকোপে অসহায় হয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়া।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাস তার ভয়াবহতা দেখানোর জন্য যেন এপ্রিলকেই বেছে নিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে দাপট দেখিয়ে আসা করোনাভাইরাস চলতি এপ্রিলে সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে। বিশ্বব্যাপী লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
এমন অবস্থায় করোনার বিস্তার রোধে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই লকডাউন অবস্থায়। বাংলাদেশেও একই চিত্র। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ হাজার ৯৪৮ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ১০১ জন। ভাইরাসটির বিস্তার রোধে দেশের সবখানেই লকডাউন অবস্থা।
অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ এরপর অফিস-আদালত। রাস্তাঘাটে যানবাহনের আধিক্য কমেছে অনেক। সব মিলিয়ে স্থবিরতা নেমে এসেছে সবখানে। কিন্তু এই স্থবিরতা থাবা বসিয়েছে অনেকের পেটে। কর্মহীন হয়ে পড়া অনেক মানুষ তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেরই প্রশ্ন কীভাবে চলবে তাদের জীবন।
দিন এনে দিন খাওয়া মানুষরা সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত। বাইরে বের হওয়ার সুযোগ না থাকায় তাদের উপার্জনের পথ প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক, বাসের চালক, বাস কন্ডাকটর, বাসার গৃহ পরিচারিকা; এ সব কাজ করা মানুষ ঘোর সঙ্কটে পড়ে গেছেন। মুদি দোকানদারদের অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে।
আরিচায় বাড়ি রাশেদা খাতুনের। অল্প বয়সেই বাবা-মা বিয়ে দেন তাকে। স্বামী মো. বাছেদের ছোট্ট ভিটেটি বিলীন হয়ে যায় নদী ভাঙনে। উপায় না পেয়ে ঢাকার পথে ছোটেন দু'জন। রাশেদা গৃহ পরিচারিকার কাজ করবেন আর স্বামী রিকশা চালাবেন, এমন পরিকল্পনা এটে ঢাকার গাড়িতে চেপে বসেন দু'জন। সেভাবেই চলছিল তাদের জীবন। কিন্তু করোনার ছোবলে সব থমকে গেছে।
অঘোষিত লকডাউনের কারণে মানুষের বাসায় গিয়ে কাজ করার উপায় নেই রাশেদার। ঠেলাগাড়ি চালানো মো. বাছেদেরও কাজ নেই। দু'জনই এখন ঘরে বসে। কীভাবে সংসার চলবে, কোনোভাবেই মাথায় আসছে না তাদের। মাঝের এই সময়টা না হয় চালিয়ে নেওয়া গেল, কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে কীভাবে বাঁচবেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন তারা। নিজেদের অবস্থা জানাতে গিয়ে রাশেদা এক পর্যায়ে কেঁদেই ফেলেন।
মিরপুর দুই নম্বরে একটি বাসায় কাজ করা রাশেদা খাতুন বললেন, 'আমাদের এখন কোনো কাজ নেই। আমার স্বামীও ঘরে বসা। কোনো আয় নেই। এভাবে চলতে থাকলে কীভাবে বাঁচব, খাবার পাব কোথায়? পরিবারে আরও মানুষ আছে, সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে তো টাকা লাগবে। সেই টাকার জন্য কাজ করা দরকার। কিন্তু এখন তো বাইরে যাওয়ারই সুযোগ নেই। এসব চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।'
শেফালী আক্তারও গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন। তার স্বামী দিনমজুর। মাটি কাটা, মানুষের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তিনি। তাদের সন্তান চারজন, সব মিলিয়ে ছয় জনের সংসার। কর্মহীন হয়ে পড়ায় খাবারের ব্যবস্থা করতে নাভিশ্বাস অবস্থা তাদের। সহায়তা মিললেও সেটা যথেষ্ট নয়। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া খাবার কয়েকদিনেই শেষ গেছে বলে জানালেন তিনি। দু'মুঠো খাবারের জন্য গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে লাইনে।
শেফালী বলছিলেন, 'কাজ করার মানুষ আছে আমার পরিবারে। কিন্তু কাজ করার সুযোগ তো নেই। এই ভাইরাসের কারণে মানুষ তাদের বাসায় কোনো কাজের লোক রাখছে না। আমি যেতে পারছি না। মাঝে মাত্র দুই দিন কাজ করেছে আমার স্বামী। কিন্তু দু'দিনের আয়ে তো পুরো মাস চলে না। কীভাবে দিন যাবে, বুঝতে পারি না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন এই অবস্থা দ্রুতই কেটে যায়। আবার যেন কাজে ফিরতে পারি। না হলে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরে যেতে হবে।'
মুদি দোকানদারদেরও দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। জাকির হোসেনের দোকান মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচা বাজারের পাশে। সরকার থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখার নিয়ম করে দেওয়ায় বেচা-কেনা কমে গেছে অনেক। জাকিরের আয় নেই বললেই চলে। পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে ব্যবসার পুঁজিতে হাত দিতে হচ্ছে তাকে।
জাকির হোসেন নতুন আলোর অপেক্ষায়। না হলে যে অন্ধকারে পড়ে যাবে তার পরিবার। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জাকির বলে ওঠেন, 'অবস্থা ভালো না ভাই আমাদের। বেচা-কেনা অনেক গেছে। দুইটা পর্যন্ত আর কত বেচা যায়! আগের দিনে ১০-১২ হাজার বিক্রি হতো। এখন ৩ হাজারও হয় না। এখানে আর কয় টাকাই লাভ হয়! এ দিয়ে বাজার-সদাই করে বাঁচা-পড়া খুব কঠিন। এমন চললে মারা পড়তে হবে, আর কোনো উপায় নাই।'
এখন রাস্তাঘাটেও ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। রাস্তায় বেরোনো বেশিরভাগ যানবাহন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এমন অবস্থায় মাঝ দড়িয়ায় পড়ে গেছেন রিকশা-ভ্যান চালকরা। রিকশা চালকরা রাস্তায় বের হতে পারলেও ভ্যান চালকদের সেই সুযোগ নেই। কারণ মালামাল বহন করতে ভ্যানের দরকার হলেও এখন সেই কাজ তেমন নেই বললেই চলে।
বশির নামের এক রিকশাচালক জানালেন, তার অনেক দিনের জমানো মাটির ব্যাংকটি ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলেছেন। বাড়িতে মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে তার। ঢাকায় যত ঝড়ই বয়ে যাক, তাদের খরচ পাঠাতেই হবে বশিরকে। সপ্তাহের হিসেবে বাড়ি টাকা পাঠান বশির। গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাংকে জমানো টাকা থেকে বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি।
দুই বছর আগে গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় রিকশা চালাতে আসা বশির কথাগুলো বলার আগেই চোখের পানি ছেড়ে দিলেন, 'ঢাকায় আসতে চাইনি। কিন্তু পরিবারের খরচ চালানোর জন্য রিকশা চালানো ছাড়া উপায় ছিল না। পরিবার ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না। আবার পরিবারকেও তো বাঁচাতে হবে। কিন্তু করোনায় কিছুই পারছি না। খ্যাপ অনেক কমে গেছে, নেই বললেই চলে'
এমন অবস্থায় মাটির ব্যাংকটি ভাঙা ছাড়া উপায় ছিল না বশিরের। আবার ভয়, এভাবে আর কত পথ পাড়ি দিতে পারবেন। বশির বলেন, 'দেড় বছর ধরে জমানো ব্যাংকটা ভেঙে ফেলেছি। সেখান থেকে বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছি। পরিবারকে বুঝতে দেইনি। কিন্তু আর কয় সপ্তাহই বা এভাবে চালাতে পারব। সামনে শুধু অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। মা, স্ত্রী, সন্তানের মুখগুলো সামনে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাই। সেটাও পারছি না, বাড়ি ফিরে ওদের কী খাওয়াব?'
ওদের কী খাওয়াব, এই প্রশ্নটাই বশিরকে গাইবান্ধা থেকে ঢাকা এনেছে। রাশেদা খাতুনকে টেনে এনেছে মানিকগঞ্জ থেকে। জাকির হোসেন, শেফালী আক্তারদের ঢাকাবাসী হওয়ার উদ্দেশ্যও অভিন্ন। কিন্তু জীবনের চাকা ঘোরাতে ঢাকা এসে এরা সবাই এখন করোনাভাইরাসের থাবায় বন্দি। কবে মুক্তি মিলবে, তা কেউ জানে না।