‘বজরা- দ্য হাউজবোট’: টাঙ্গুয়ার হাওরে বিলাসবহুল নৌকা ভ্রমণ
একসময় কুষ্টিয়ার শিলাইদহে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের জমিদারি এস্টেট। পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবিগুরু অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এখানে। আর এই কুঠিবাড়িতেই ছিল রবিঠাকুরের প্রিয় বজরা নৌকা। প্রায়ই এই নৌকায় রাত্রিযাপন করতেন তিনি; অবসরে ঘুরে বেড়াতেন পদ্মা-গড়াই নদীর বুকে।
এই বজরায় বসেই নদীর শান্ত টলটলে পানি ও বাংলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকেছেন কবি, লিখেছেন অসংখ্য বিখ্যাত কবিতা ও গল্প।
রবি ঠাকুরের সেই প্রিয় বজরা নৌকায় অনুপ্রাণিত হয়ে একদল ব্যাকপ্যাকার- সাদিফুজ্জামান দিগন্ত, নাইমুল হাসান এবং রায়হান রিয়াদ সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ফিরিয়ে এনেছেন বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী বজরা নৌকা।
চলতি বছরের মে মাস থেকেই হাওরের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে চলতে শুরু করেছে তাদের 'বজরা- দ্য হাউজবোট'।
সুনামগঞ্জের সাহেববাড়ি ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা, মেহগনি কাঠে তৈরি 'বজরা'র সৌন্দর্য্য মুহূর্তেই পথচারীর নজর কেড়ে নেওয়ার মতো।
৭১ ফুট লম্বা, বাদামি-নীলে মেশানো 'বজরা' এখন ব-ট্রাভেলার্স নামের একটি ট্যুর গ্রুপের অধীনে। সাদিফুজ্জামান দিগন্ত এই গ্রুপের পরিচালক।
নদীমাতৃক এই দেশের নদী তীরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা একসময় বর্তমানের চাইতে অনেক ভিন্ন ছিল। দেশের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা অসংখ্য নদীপথে যে যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটিই একসময় পণ্য পরিবহনের মূল উপায় ছিল।
এখনও দেশের নদীপথে বহু মানুষ যাতায়াত করে এবং পণ্য পরিবহন করা হয়। কিন্তু এর বাইরেও যোগাযোগের নানা মাধ্যম চলে আসায়, নদীপথে যোগাযোগ যেন অতীতের এক ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বজরাও তেমনই এক অতীত। একসময় নদীপথে দূর-দূরান্ত পাড়ি দিতো বজরা নৌকা। ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য বজরা ছিল এক আভিজাত্যের প্রতীক।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে দিগন্ত বলেন, "২০ শতক পর্যন্তও বজরা নৌকা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। আমরা ভ্রমণপিপাপুদের ঐতিহ্য ও বিলাসিতার সংমিশ্রণে এক অনুভূতি দেওয়ার কথা মাথায় রেখে 'বজরা' তৈরি করেছি।"
'বজরা- দ্য হাউজবোট' এ পা রাখতেই আপনি এর কাঠের ফ্রেমে বসানো অ্যাক্রিলিকের দরজার ভেতর দিয়ে লবি ও হলওয়েসহ ভেতরটা সম্পূর্ণ দেখে নিতে পারবেন।
দুই পাশেই রয়েছে বসার ব্যবস্থা, ভেতরের ঘরগুলো কাঠ ও স্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক শিট দিয়ে ঢাকা।
বজরার লবিতে বসে আপনি সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে হাওরের নির্মল সৌন্দর্য্য এবং দূরের পাহাড়ের সারি...সব মিলিয়ে আপনাকে নৈসর্গিক অনুভূতিই দিবে। এমন একটা জায়গায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কিংবা এক কাপ চা হাতে নিজের প্রিয় বই খুলেও বসা যায়!
বজরা'র ছোট উপকক্ষগুলো থেকে কেবিনগুলো আলাদা করা। প্রতি পাশে তিনটি করে কেবিন থাকায় মোট ১৮ জন মানুষ সেখানে জায়গা করে নিতে পারবেন। ছোট্ট-আরামদায়ক কেবিনের ভেতর ম্যাট্রেসে শুয়ে আয়েশ করে দেখা যাবে হাওরের সৌন্দর্য্য। ভোরবেলা ঘুম ভাঙবে হাওরের শান্ত পরিবেশে, চোখ মেলে দেখতে পাবেন দূরে মেঘালয়ের পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেদের আনাগোনা!
"বজরা চওড়ায় ১৪ ফুট এবং এর প্রতিটি কেবিনে একটি করে জানালা আছে; যে জানালা দিয়ে ভ্রমণের পুরো সময়টা আপনি হাওরের সৌন্দর্য্য দেখতে পারবেন। হাউজবোটে জেনারেটর থাকবে, যা দিয়ে অতিথিদের প্রতিটি কেবিনে একটি করে এলইডি লাইট, ছোট ফ্যান এবং তিন-পোর্টের চার্জিং সকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে", বললেন নাইমুল।
টাঙ্গুয়ার হাওরে যারা ভ্রমণ করেছেন, তারা জানেন যে সেখানে ছোট্ট ওয়াশরুমে যাওয়ার কি বিড়ম্বনা!
এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বজরা'র মালিকেরা তাদের হাউজবোটে ওয়াশরুমের জন্য যথেষ্ট জায়গা রেখেছেন; যেখানে হাই-কমোড এবং ওয়াশবেসিনও থাকছে।
বজরা'র ৩০ ফুট লম্বা বাথরুমে অতিথিদের পোশাক বদলের জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
দিগন্ত বলেন, "অনেক বছর ধরেই এখানে যারা ভ্রমণ করতে আসেন, তাদের অভিযোগ ছিল নৌকার ভেতরে সহজে চলাফেরা করা যায়না কেন। তাই আমরা বজরার নকশা এমনভাবে করেছি যে এটার ভেতরে মানুষ সহজেই চলাফেরা করতে পারবেন। এটির ৪০-৪৫ ফুট লম্বা হলওয়ের ছাদ ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা, তাই এই নৌকার ভেতর আপনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন।
ভ্রমণ-খরচ বিত্তান্ত
বজরা সুনামগঞ্জের সাহেববাড়ি ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে। এই হাউজবোটে দুই দিনের প্যাকেজে থাকছে তিন বেলা খাবার, বিকালের নাস্তা, আনলিমিটেড চা এবং পানি। হাওরে আসার দিন সকালের নাস্তা থেকে ধরে পরদিন সন্ধ্যায় ঘাটে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আপনি তাদের এই সেবা পাবেন।
এছাড়াও, বজরায় হাওরের মাছ ও হাঁসের মাংস রান্না, টাটকা শাকসবজি এবং নানা পদের ভর্তা খাওয়ার সুযোগও থাকছে। এর বাইরে, আলোচনা সাপেক্ষে আপনার পছন্দমাফিক খাবারের মেনুও তারা তৈরি করে দিবে।
দুই দিনের ট্রিপে বজরা টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে ঘুরে বেড়াবে এবং রাতে এটি জাদুকাটা নদীতে ভিড়ানো থাকবে।
পরদিন বজরা তাদের অতিথিদের বারিক্কা টিলা, ওয়াচ টাওয়ার এবং চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য্যের শহীদ সিরাজ লেক ঘুরিয়ে দেখাবে।
বজরায় লাইফজ্যাকেট এবং টিউবের ব্যবস্থাও আছে। তাই আপনি চাইলেই সেখান থেকে হাওরের পানিতে সাঁতার কাটতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন।
সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে বজরায় ৪০ ঘণ্টার ট্রিপের জন্য ১২ সদস্যের একটি দলের প্রতিজনের খরচ পড়বে ৬,০০০ টাকা। তবে ১৫-২০ জনের দলের ক্ষেত্রে খরচ কমে ৫,০০০ টাকায় দাঁড়াবে।
সপ্তাহের সাধারণ দিনগুলোতে মৌসুমভেদে বজরায় থাকার খরচ কমে আসতে পারে। চাহিদা বেশি থাকায়, বজরায় থাকতে চাইলে অন্তত কয়েক সপ্তাহ আগেই আপনাকে বুকিং দিতে হবে।
নির্মল বাতাস আর স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য
টাঙ্গুয়ার হাওর এমন একটি স্থান, যেখানে ভ্রমণের কথা আপনার সারা জীবন মনে থাকবে। আর তা যদি হয় বজরার মতো বিলাসবহুল কোনো নৌকায়, তাহলে তো কথাই নেই!
শহুরে ব্যস্ত জীবন থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইলে এবং পরিবার-পরিজন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে চাইলে; টাঙ্গুয়ার হাওর এক আদর্শ জায়গা। সুনামগঞ্জের এই পর্যটন শিল্পকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে 'বজরা'।
'বজরা' সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে ভিজিট করুন তাদের ফেসবুক পেজ 'Bojra - The house boat'