ফোর্ড, প্যুজো, অস্টিন, মার্সিডিজ, ফেরারী, ফিয়াটের সঙ্গে দুই যুগ
ওহাইও, আমেরিকা। অধ্যাপক রুমি শাম্মীন দেশে আসবেন বলে ব্যাগ গোছাচ্ছেন। তাঁর কিশোরী মেয়ে সুনামি দেখছে ঘুরে ঘুরে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ব্যাগের ভেতর একটা গাড়ি। একটু অবাক হয়েই বাবার কাছে জানতে চাইল, কার জন্য নিয়ে যাচ্ছো গাড়িটা? অধ্যাপক রুমি মুচকি হেসে বললেন, তোমার টিপু চাচার জন্য। উত্তর শুনে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল সুনামি।
মেয়ের অবস্থা দেখে অধ্যাপক একটু ভড়কে গেলেন। ভাবলেন ব্যাপারটি এক্ষুনি খোলাসা করা দরকার। একটা চেয়ার টেনে বসলেন মেয়ের মুখোমুখি।
বলতে লাগলেন, 'এটা কিন্তু খেলনা গাড়ি নয়, আবার রেপ্লিকাও বলতে পারবে না। এগুলোকে বলা হয় স্কেল মডেল। একদম হিসাব করে আসল গাড়িটার ১৮ ভাগের ১ ভাগ, ৩৪ ভাগের ১ ভাগ বা ৬৪ ভাগের ১ ভাগে এগুলো বানানো হয়। স্কেল মডেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে আসল গাড়ি কোম্পানি যেমন মার্সিডিজ, ফোর্ড বা ফিয়াটের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়, অর্থমূল্যও গুনতে হয়। তাদেরকে অবশ্যই লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান হতে হয়। কোন মডেলের কয়টা স্কেল মডেল কার বানাবে তা-ও উল্লেখ করতে হয়।'
তবুও কপালের ভাঁজ সমান হলো না সুনামির। আসলে টিপু চাচার মতো বয়স্ক মানুষটা কেন গাড়ির পেছনে ছুটছে এখনো, সে উত্তরটাই তো পাওয়া গেল না।
ব্যাপারটা বুঝেই বুঝি অধ্যাপক রুমি যোগ করলেন, 'তোমার টিপু চাচাকে তো চেনোই, চোখ বন্ধ করে তিন ঘণ্টা টানা গান শুনে যেতে পারে। ওয়েস্টার্ন মিউজিকের অরিজিনাল সব সিডি পাবে তার কাছে, তা দামে যতই হোক আর সংখ্যায় তা হাজারের বেশি। তারপর তাঁর প্লেন সংগ্রহের বাতিকও আছে। আর গাড়ির ব্যাপারে তো পাগলই বলতে পারো। বয়সটা এখানে ব্যাপার নয়, সারা পৃথিবীতেই স্কেল মডেল সংগ্রাহকদের সবাই বলতে পারো আংকেলরা বা মাঝবয়সীরা।'
এই এতক্ষণে পুরোটা সাফ হলো সুনামির কাছে।
ওমর ফারুক টিপু বলছিলেন: 'এখন তো সুনামিই মনে করিয়ে দেয় রুমিকে প্রতিবার দেশে আসার সময়, টিপু চাচার গাড়ি নিয়েছ তো? রুমি প্রায় ডজনখানেক গাড়ি এনে দিয়েছে আমাকে। আসার আগে আমাকে বলে লিংক পাঠাও, মানে কোন গাড়িটা এবার চাই?'
লেখক: আপনি গাড়ি কিভাবে নির্বাচন করেন?
টিপু: পুরোনো গাড়ির প্রতি আমার আগ্রহ বেশি—তা সে মার্সিডিজের হোক বা ফোর্ডের। গাড়ির কাঠামো-বৈচিত্র্যও আমাকে আকর্ষণ করে। যেমন পোর্শের গাড়িগুলোর ইঞ্জিন থাকে পেছনদিকে আবার মার্সিডিজের গাড়িগুলোর আছে গাল উইং ডোর (সি গালের পাখার মতো) ইত্যাদি।
এছাড়া ইতিহাস জড়িয়ে আছে এমন গাড়িও আমাকে আকৃষ্ট করে। প্রিন্সের সিলভার অ্যারো কনসেপ্ট কার সংগ্রহ করার কারণ যেমন মাত্রই ৫টি গাড়ি তৈরি হয়েছিল ওই মডেলের। জাপানের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রিন্স ১৯৩৩ সালে তৈরি করেছিল সিলভার অ্যারো। পাঁচটির তিনটি ধ্বংস হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর বাকি ২টি আছে দুজন আমেরিকান সংগ্রাহকের কাছে। গাড়িটির প্রতি আকৃষ্ট হতে এই তথ্যগুলো কাজ করেছে।
কোনো গাড়ি সংগ্রহ করার আগে আরো বিশেষভাবে যেটা খেয়াল করি সেটা হলো ডিটেইলিং। ভালো স্কেল মডেলগুলো হুবহু আসলটির মতো হয়, মানে গাড়িটির ইঞ্জিন থেকে শুরু করে স্টিয়ারিং, সিটবেল্ট, ওয়াইপার, গ্রিল, বনেট, ডোর, ডোর হ্যান্ডেল সব একইরকম হয় এবং যেটা যেভাবে ঘোরা বা চলার কথা সেভাবেই মুভ করে।
লেখক: গাড়ির খবর পান কোথায়?
টিপু: এখন তো ইন্টারনেটে অনেক খবর ভাসে। বিশ্বজুড়ে স্কেল মডেল কালেক্টরদের অনেক সংগঠন আছে। তাদের ফেসবুক পেইজ বা গ্রুপ আছে। সেগুলোয় সংগ্রাহকরা নানান খবর আদানপ্রদান করেন। আমাদের দেশের প্রথম ফেসবুক গ্রুপটির নাম স্কেল মডেল কালেক্টরস অব বাংলাদেশ। আনোয়ারুল মাজহার এর প্রতিষ্ঠাতা। মো. ইকতেদার আহমদ ২০০৫ সালের দিকে আমাকে গ্রুপটির কথা বলে। তারপর থেকে গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিতই গাড়ির খবরাখবর আদানপ্রদান হতে থাকে। তবে একেবারে শুরুর দিক, মানে ২০০০ সালে দোকানে দোকানে ঘুরে গাড়ি দেখে তারপর তা সংগ্রহের চেষ্টা করতাম।
লেখক: আপনার কাছে এখন কতগুলো স্কেল মডেল আছে?
টিপু: শতাধিক। আত্মীয়স্বজনরা হাসাহাসি করে বলে, ছেলের বিয়ে দিয়েছ অথচ পাগলামি যায় না। আসলে পাগলামি যাওয়া-আসার কিছু নেই, আমি মানুষটিই এমন। যার প্রেমে পড়ি তাকে শেষ পর্যন্ত আগলে রাখি।
লেখক: স্কেল মডেল কারের দাম কেমন?
টিপু: মায়েস্তো, উইলি, হটহুইল এলিট, বুরাগো, অটোআর্ট নামের স্কেল মডেল বা ডাই কাস্ট মডেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আছে। মায়েস্তো বা বুরাগোর তৈরি গাড়িগুলির দাম তুলনামূলক কম, ৪ বা ৫ হাজার। আবার সিএমসি নামের এক নির্মাতা আছে, তাদের তৈরি গাড়ির দাম লাখ টাকাও হয়।
টিপু ভাই প্রথমে নারিন্দা গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পড়েছেন। তারপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে।
নারিন্দা স্কুলে তখন তিনি ক্লাস থ্রি কী ফোরের ছাত্র। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির কাছে একটি লাল রঙের হুডখোলা গাড়ি দেখলেন। গাড়িটার গ্রিলের ওপর একটা ছুটন্ত ঘোড়ার ছবি আঁটা। গাড়িটা চোখের সামনে ভাসতে থাকল। বাড়ি ফিরে বড় ভাইকে গাড়িটার বর্ণনা দিলেন। বড় ভাই খুঁজে পেতে দুই সপ্তাহ পরে জানাল, এটা ফোর্ড কোম্পানির মাসটাং আর মাসটাং হলো ঘোড়ার একটা প্রজাতি।
আরো পরে টিপু ভাই জানতে পেরেছিলেন, গাড়িটা রোজ গার্ডেনের মালিক হুমায়ুন সাহেবের পরিবারের। আর সব শিশুদের মতোই টিপু ভাইয়েরও প্লেন আর গাড়িতে আগ্রহ তৈরি হয় ছোটবেলাতেই। একবার বাবা-মায়ের সঙ্গে নিউমার্কেট গেছেন, একটা পুলিশ কার দেখে খুব করে চাইলেন। কিন্তু বাবা রাজি হলেন না কিনে দিতে। সেই থেকে পুলিশ কারের ওপর তার অভিমান, বড় হয়েও আর সংগ্রহ করেননি।
তবে রাজশাহী কলেজিয়েটে পড়ার সময়ের একটা সংগ্রহ অভিযানের গল্প শোনালেন। পঁচাত্তর বা ছিয়াত্তর সাল হবে সেটা। ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এসেছেন। বেড়াতে গিয়েছেন ফুপুর বাসা ধানমন্ডিতে। সেখানে আলমাস সুপার শপের পেছনে সাগর সম্ভার নামেও একটা দোকান ছিল। সে দোকানে বইপত্রের সঙ্গে পাওয়া যেত খেলনা গাড়িও।
টিপু দেখল, একটা বাক্সে ছয়টি ক্লাসিক বা ভিনটেজ কার (১:৬৪ স্কেল) রাখা। ঘোড়ার গাড়ির মতোই দেখতে বলে ফিটন কারও বলা হয় এগুলোকে। কোনোটি ফোর্ডের তৈরি, কোনোটিবা প্যুজোর অথবা অস্টিনের। দারুণ সুন্দর গাড়িগুলি। টিপু আর কোনোদিকে নজরই দিতে পারছে না। প্রতিটি গাড়ি ৩৫ টাকা করে দাম। টিপু হিসাব করে দেখল তার কাছে তিনটি গাড়ি কেনার টাকা আছে।
সে অনেক ভেবেচিন্তে দোকানিকে বলল, আংকেল আমি আপনাকে তিনটি গাড়ির দাম দিয়ে যাচ্ছি, আপনি কিন্তু কারুর কাছে এগুলো বিক্রি করবেন না। মাসখানেক পরে এসে বাকি গাড়িগুলির দাম দিয়ে যাব।
তারপর ঈদ এলো, সালামি পেল টিপু। গুনে দেখল ১২ টাকা জমেছে। তা নিয়ে আবার দৌড়ে গেল দোকানটিতে ঈদের দুদিন পর। দোকানিকে ১২ টাকা দিল আর বলল, আপনি ভাববেন না, টাকা ঠিক জোগাড় করে ফেলব।
কিন্তু দোকানি এবার উল্টোরথ টানল, বলল, গাড়িগুলি তুমি নিয়ে যাও, জোগাড় হলে টাকা দিয়ে যেও। হাতে চাঁদ পেয়ে খুশিতে নেচে উঠেছিল টিপু।
তারপর অনেক অনেক দিন চলে গেছে। বড় হয়ে চাকরিও করতে লাগলেন। গানের ঘোর লাগা মন তাঁর। এলিফ্যান্ট রোডে রিদম নামের একটি ওয়েস্টার্ন মিউজিক স্টোরেরও পার্টনার। যেতে যেতে দিন নিরানব্বই সালে এসে ঠেকল।
ফেরারি দেখে ফিদা
গুলশানে রুমী আহমাদ ও তাঁর আরো দুই বন্ধুর একটা মিউজিক শপ ছিল নাম সাউন্ডস্কেপ। সেখানে কাজ করতেন টিপু ভাই। একদিন একটা কাজ নিয়ে রুমি আহমাদের ঘরে গেলে টেবিলের ওপর একটি ফেরারি কার দেখতে পেলেন। মডেল জানলেন এফ ৪০। এগুলোকে যে স্কেল মডেল বলা হয় সেটাও জানা হয়েছিল সেবারই।
পরে রুমী ভাই থাইল্যান্ড থেকে একটা ল্যাম্বরগিনি (স্কেল মডেলের) এনে দিয়েছিলেন টিপু ভাইকে। তারপর থেকে গুলশান-১-এর ডিসিসি মার্কেট আর শুটিং ক্লাবের কাছে এটসেটরা নামের দোকানে যেতেন সময় পেলেই। ডিসিসি মার্কেটে সিঁড়ির ওপরের দুটি দোকানে বেশি পাওয়া যেত স্কেল কার। তখন ডিরেক্ট ইম্পোর্টার কেউ ছিল না ঢাকায়, কলকাতায় ছিল। সেখান থেকে লাগেজ পার্টি গাড়ি আনত। তবে বৈচিত্র্য বেশি থাকত না। মার্সিডিজ, ফেরারি বা ল্যাম্বরগিনিই পাওয়া যেত বেশি। এটসেটরার গাড়িগুলো মানে ভালো ছিল, তাই দামও হতো বেশি। টিপু ভাইয়ের পকেটে পরিস্থিতি থাকত মিডিয়াম মানের। তাই মায়েস্তো, উইলি বা বুরাগোর তৈরি গাড়িগুলোই বেশি সংগ্রহ করতে পারতেন।
শুরুতে স্পোর্টস কার বা সুপার কারের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন। তবে ট্রান্সফরমার মুভিটি দেখার পর থেকে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকল সুপার কার দেখলেই। মনে হতো এই বুঝি দরজা-জানালাগুলো খুলে বেরিয়ে এসে একটা দানো হয়ে দাঁড়াবে। তবে সেডান বা ফ্যামিলি কারে তাঁর আগ্রহ বহাল থাকল আগের মতোই।
টিপু ভাইয়ের কাছে এখন একশরও বেশি স্কেল কার আছে। নতুন করে একটি গাড়ি রাখার আলমারিও বানিয়েছেন। গাড়ি এখন যতটা না কেনেন তারচেয়ে বেশি উপহার পান। প্রবাসী বন্ধুরা দেশে ফেরার সময় উপহার হিসাবে গাড়িই আনে। আত্মীয়-স্বজনরাও জন্মদিনে গাড়ি বা প্লেন উপহার দেয়। গত মাসে রুমি শাম্মীনের আনা গাড়িটির এখনো প্যাকেট খোলা হয়নি। রাখার জায়গাও নেই। টিপু ভাই ১:১৮ স্কেলের (মূল গাড়ির আঠারো ভাগের ১ ভাগ) গাড়ি বেশি সংগ্রহ করেন।
প্রদর্শনশালা
টিপু ভাইয়ের গাড়ির প্রধান শো কেসে ৮টি তাক। একেবারে ওপরের তাকটি ছাদ ছুঁই ছুঁই। টিপু ভাই টুলের ওপর উঠে যে গাড়িটি প্রথম নামিয়ে আনলেন সেটি এলভিস প্রিসলি (কিং অব রক অ্যান্ড রোল) চালাতেন। নাম ক্যাডিলাক এল ডোরাডো (কলম্বিয়ার হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণের শহর এল ডোরাডো, যা খুঁজে পেতে পাগলপারা ছিল স্প্যানিশরা)।
১৯৫২ ছিল ক্যাডিলাকের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর আর সে বছরই এলডোরাডোর প্রথম প্রজন্ম বাজারে আসে। তারপর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মোট ১২ প্রজন্ম এলডোরাডোর। এলভিস চালাতেন ১৯৫৯ সালের মডেলটি। এর টেইল লাইট ছিল বুলেটের মতো আর পেছন থেকে দেখাত চোখা। এতে গান শোনার ব্যবস্থা ছিল চমৎকার।
উল্লেখ্য, মার্কিন জেনারেল মোটরসের (জিএম) বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণকারী শাখা হলো ক্যাডিলাক। ১৯০২ সালে ক্যাডিলাক প্রথম গাড়ি প্রস্তুত করে। অবশ্য তখন ক্যাডিলাক ছিল হেনরি ফোর্ড কোম্পানির মালিকানাধীন। জিএম এর মালিকানা নেয় ১৯০৯ সালে।
১৯০৩ সালে নিউইয়র্ক মোটর শোতে ক্যাডিলাক প্রথম যে গাড়িটি প্রদর্শন করে সেটি ছিল এক সিলিন্ডারবিশিষ্ট ১০ অশ্বশক্তির। দাম ধরা হয়েছিল ৮৫০ ডলার। হাভেভাবে যেমন কথাবার্তায়ও ক্যাডিলাকের ভাব খুব।
১৯০৫ সালে ক্যাডিলাকের স্লোগান ছিল—'ইউ ক্যান কিল আ হর্স বাট নট আ ক্যাডিলাক'। ১৯১১ এসে স্লোগান দিল—'এভরি ক্যাডিলাক ইজ আ দেওয়ার ট্রফি' ( ব্রিটিশ রয়্যাল অটোমোবাইল ক্লাব থেকে গাড়িতে নতুন উদ্ভাবনার জন্য দেওয়ার ট্রফি দেওয়া হয়)। ১৯১২ সালে ক্যাডিলাক এ ট্রফি লাভ করে ইলেকট্রিক স্টার্টার ও ইলেকট্রিক লাইটের জন্য। দেওয়ার ট্রফি পেয়ে ক্যাডিলাক স্লোগান দিতে শুরু করে, 'স্ট্যান্ডার্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড', যা আজো বহাল আছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চার লক্ষ গাড়ি বিক্রি করেছে ক্যাডিলাক।
তারপর টিপু ভাই একটা ফেরারি দেখালেন যেটি স্পোর্টস কারের দম দেওয়া ফ্যামিলি কার। এর নাম ২৫০ জিটি। বেশ গতিতে অনেক বেশি পথ পাড়ি দিতে পারে বলে এটি জিটি বা গ্র্যান্ড ট্যুরার। ১৯৫৪ সালে এটি প্যারিস মোটর শোতে প্রথম দেখানো হয়। শিল্পী এরিক ক্ল্যাপটন গাড়িপ্রেমী ছিলেন। তাঁর গ্যারেজে ১৯৬৪ মডেলের একটি জিটি ২৫০ লুসোও ছিল। ইতালীয় শব্দ লুসোর অর্থ লাক্সারি। এরিক বলতেন, তাঁর সংগ্রহের সেরা গাড়িটি হলো লুসো।
ইতালীয় গাড়ি নকশাকার প্রতিষ্ঠান পিনিন ফারিনা গ্র্যান্ড ট্যুরারের নকশা করেছিল। ১৯২৮ সালে ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাতিস্তা পিনিন ফারিনা স্ত্রীর পরিবারের সহায়তা নিয়ে পিনিন ফারিনা গড়ে তুলেছিলেন। ফেরারির সঙ্গে তাদের দীর্ঘ সখ্য। এছাড়া আলফা রোমিও, প্যুজো, ফিয়াট, জিএম-এর জন্যও পিনিন ফারিনা নকশা তৈরি করে। বাস, বিমান, ইয়ট, ট্রামের নকশাও করে প্রতিষ্ঠানটি। গ্র্যান্ড ট্যুরার ২৫০-র জন্য পিনিন ফারিনা অন্তত নয়টি ভিন্ন ভিন্ন নকশা তৈরি করেছিল। সমানতল আর উপবৃত্তাকার গ্রিলের জন্য গাড়িটির সম্মুখভাগ উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। উল্লেখ্য, এর আগের প্রায় সব গাড়ির গ্রিল হতো ডিম্বাকার।
এরপর টিপু ভাই যে গাড়িটা নামালেন সেটির সঙ্গে অভিনেতা নিকোলাস কেইজের যোগ আছে। ব্লকবাস্টার অ্যাকশন মুভি গন ইন সিক্সটি সেকেন্ডসে (২০০০) অভিনয় করেছিলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি আর নিকোলাস কেইজ। ছবিটির জন্য ফোর্ড কোম্পানি মাস্টাং ১৯৭১ মডেলকে মডিফাই করে নাম দেয় এলিনর। ২৫০ ঘণ্টা খাটাখাটনি দিয়ে এতে যুক্ত করা হয় ডেডবোল্ট ডোর লকস, অন-বোর্ড ফার্স্ট এইড কিট, ২৪-ভোল্ট ইলেক্ট্রিক্যাল সিস্টেম, ইন্ডিভিজুয়াল লকিং রিয়ার ব্রেকস ইত্যাদি। চলচ্চিত্রটির জন্য মোটমাট ১২টি এলিনর তৈরি করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ৩টিকে পরে নিলামে তোলা হয়েছিল যার একটির দাম উঠেছিল ২০০৯ সালে দুই লাখ ১৬ হাজার ৭০০ ডলার। আরেকটির দাম উঠেছিল ২০১৩ সালে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার।
পরের গাড়িটি গডফাদার মার্লোন ব্রান্ডোর। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা গডফাদার পার্ট ওয়ান বানিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে। কপোলা নিজেও ছিলেন গাড়িবাজ বা কার গাই। ক্যাডিলাক, লিমুজিন, আলফা রোমিওসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি এ ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন কপোলা। তবে প্যাকার্ড লেবারন গাড়িটিই বেশি আগ্রহী করে তুলেছিল টিপু ভাইকে। এর ডোরগুলিকে বলা হয় সুইসাইড ডোর, কারণ এ দরজা সহজেই খুলে লাফিয়ে পড়া যায় অথবা কাউকে গাড়ির ভিতর হত্যা করে ঠেলে বের করে দেওয়া যায়।
এরপর দেখলাম মার্সিডিজ বেনজের ফাইভ হান্ড্রেড কে। যার ডাক নাম মহারাজা। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের কোনো এক রাজার জন্য বিশেষভাবে তৈরি হয়েছিল মহারাজা। রাজার ছিল মৃগয়ার নেশা। এক-দুই সপ্তাহের জন্য তিনি বেরিয়ে পড়তেন। ততদিনের জন্য তো প্রস্তুতি দরকার। তাই গাড়িটির ছিল তিনটি স্পেয়ার চাকা, পাদানিতে শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র রাখার বিশেষ ক্যাবিনেট তৈরি করা হয়েছিল আর অতিরিক্ত জ্বালানি রাখার জন্য বিশেষ রকমের গ্যালনও তৈরি করা হয়েছিল।
বাটারফ্লাই ডোর, জেমস ডিন ও ফিয়াট
ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ-র গাড়ি সংগ্রহের নেশা আছে। সবমিলিয়ে ৭ হাজার গাড়ির মালিক তিনি। তার মধ্যে রোলস রয়েস আছে ৬০০, ফেরারি আছে ৪৫০টি আর বেন্টলি ৩৮০টি। তাঁর সংগ্রহের মূল্য দাঁড়ায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সুলতান হাসানাল বলকিয়াহর ওই বিরাট সংগ্রহের একটি হলো মার্সিডিজের সিএলকেজিটিআর। খুললে গাড়িটির দরজাগুলো প্রজাপতির মতো পাখা মেলে, তাই এগুলোকে বলা হয় বাটারফ্লাই ডোর। টিপু ভাইয়ের সংগ্রহে আছে একটি সিএলকেজিটিআর স্কেল মডেল।
আরো আছে পোর্শের ৫৫০এ স্পাইডার। রেসিং স্পোর্টস কার গোত্রের গাড়িটি পোর্শে ১৯৫৩ সালে প্রথম তৈরি করে। প্রথম লটের ৯০টি স্পাইডারের একটি কিনেছিলেন হলিউডের নায়ক ও রেসিং ড্রাইভার জেমস ডিন।
১৯৫৫ সালে ডিনের বয়স তখন ২৪ মোটে। জায়ান্ট সিনেমার শুটিং ছিল প্রায় শেষ করে এনেছিলেন ডিন, যাচ্ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা রেসে অংশ নিতে। একটা চার রাস্তার মাথায় গিয়ে লেফট টার্ন নিচ্ছিলেন আর তখনই সামনে থেকে একটা ফোর্ড টিউডর তাকে প্রবলভাবে আঘাত করে।
ওইদিনই ডিন মারা যান, তবে রেখে যান অনেক স্মৃতি। তার একটি হলো বব ডিলান একবার গান গাইতে যাওয়ার সময় তাঁর থেকে একটি ওভারকোট ধার নিয়েছিলেন। ডন ম্যাকলিনের আমেরিকান পাই গানটিতে তার উল্লেখ আছে।
টিপু ভাইয়ের কাছে ফিয়াট ৬০০-এর স্কেল মডেলও আছে। ঢাকায় গাড়িটা আশি ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু ছিল। এটিকে বলা হতো গরিবের বড়লোকি গাড়ি।
১৯৪৮ মডেলের শ্যাভ্রল ফ্লিটমাস্টারও আছে টিপু ভাইয়ের কাছে যার দরজা আর প্যানেল ছিল কাঠের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইউএস আর্মি একটি জিপ তৈরি করেছিল যেটির ওজন ছিল মাত্রই সোয়া টন। ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে এটি দৌড়াতে পারত। এটিরও স্কেল মডেল আছে টিপু ভাইয়ের কাছে।
একটি বিশেষ সংগ্রহ
১৮৮৬ সালের জানুয়ারির ২৯ তারিখে কার্ল বেনজ গ্যাসীয় ইঞ্জিনচালিত একটি বাহনের পেন্টেন্ট (নতুন আবিষ্কারের সনদ) পেতে দরখাস্ত দিলেন। গবেষকরা এই মুহূর্তটিকেই অটোমোবাইল জন্মলাভের শুভক্ষণ ধরে থাকেন। ওই বছরের জুলাই মাসে সংবাদপত্রগুলো তিনচাকার গাড়িটির নাম দেন বেনজ পেটেন্ট মোটর কার যার পেটেন্ট নম্বর ৩৭৪৩৫।
বেনজের স্ত্রী মার্থা বেনজ গাড়িটি চালিয়ে বিশ্বের প্রথম অটোমোবাইল চালকের ইতিহাস গড়েন। এই গাড়িটির একটি স্কেল মডেল আছে টিপু ভাইয়ের কাছে। সেটি সংগ্রহের ইতিহাসও আকর্ষণীয়।
স্কেল মডেল কালেক্টরস গ্রুপের রুবেল রায় থাকতেন ইংল্যান্ডের লিডসে। সাত বছর আগে তাকে অটোমোবাইলটি সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়েছিলেন টিপু ভাই। সেইমতো সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখেছিলেন রুবেল।
পরে যখন দেশে ফিরলেন রুবেল, তখন আর টিপু ভাইয়ের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। রুবেল রায় ৭ হাজার টাকা দাম রেখে পোস্ট দিলেন। কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। শেষে ফিরে যাওয়ার আগে ৫০০০ টাকা দাম ধরেও সাড়া পেলেন না।
তখন টিপু ভাই রুবেল রায়কে জানালেন, এটি আমিই নিব, যেভাবে পারি টাকা জোগাড় করে আনছি।
শেষে টিপু ভাই ৭ হাজার টাকা নিয়েই গিয়েছিলেন, কিন্তু রুবেল রায় ৫ হাজার টাকার বেশি নিতে রাজি হননি। গাড়িটি সে থেকে আছে টিপু ভাইয়ের কাছে। এখন গাড়িটির অনেক চাহিদা, কারণ এটি আর সহজলভ্য নেই। নরেভ নামের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যতগুলো স্কেল মডেল তৈরি করেছিল সবই বিক্রি হয়ে গেছে।
আসল গাড়ি নাই
টিপু ভাইয়ের বাবা এফডিসি পাড়ায় খালেকদা নামে মশহুর ছিলেন। কলকাতা আর্ট কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে ক্যামেরা তুলে নিলেন হাতে। ছবি তোলা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। এফডিসি প্রতিষ্ঠা হলে তিনি সেখানে সিনেমার স্টিল ফটো তুলতেন। মরিস হান্ড্রেড নামের একটি গাড়ি ছিল তাঁর। একদিন তাঁর বাবা, মানে টিপু ভাইয়ের দাদা আব্দুর রশিদ গাড়ি চেয়ে পাঠালেন কোনো বিশেষ কাজে যাবেন বলে। কিন্তু খালেক সাহেবেরও সেদিন জরুরি কাজ ছিল।
পরে রাতে ফিরলে রশিদ সাহেব বললেন, 'গাড়িটা খুব দরকার ছিল রে আজ'। খালেক সাহেব দাঁতে জিভ কাটলেন। তাঁকে খুব দুঃখিত দেখাল।
পরের সপ্তাহেই খালেক সাহেব পিতার জন্য একটি ফোর্ড প্রিফেকট গাড়ি কিনে এনেছিলেন আর তা দেখে রশিদ সাহেব খুশি যেমন হয়েছিলেন, রাগও করেছিলেন। বলেছিলেন, 'আমরা কি দুটি গাড়ি পোষার মতো জমিদার হয়ে গেছি? তুমি কালই একটি বিক্রি করে দেবে।'
প্রিফেক্টটি পরে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান কিনে নিয়েছিলেন অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর জন্য। ততদিনে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ।
টিপু ভাই ঠিক সদুত্তর দিতে পারলেন না, কেন তার গাড়ি নাই। এতগুলো স্কেল মডেলের মালিক তিনি অথচ একটাও আসল গাড়ি নাই।
শেষে আস্তে আস্তে বললেন, 'কেন জানি কখনো আগ্রহ হয়নি। স্কেল মডেলগুলোই ভালো লাগে।'
নিজের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি রুমি আহমাদ, রুমি শাম্মিন, ছাড়াও শরীফ রহমান, সাকিউল আহসান পপি, তৈমুর আলী, রিয়াজ জালাল সাদউল্লাহ, সাজেদ গাজী, রুবাব মোমেন প্রমুখের সাহায্য পেয়েছেন।
এ গল্পের শেষ নেই
টিপু ভাইয়ের সংগ্রহে আরো যা যা আছে তা বলতে গেলে বই হয়ে যাবে। অনেকগুলো গাড়ি চৌকির উত্তর ও দক্ষিণ ধারে রাখা, মানে শো কেসে স্থান সংকুলান হচ্ছে না।
এরপরও কি সংগ্রহ চালিয়ে যাবেন? জিজ্ঞেস করতে টিপু ভাই বললেন, এর শেষ নেই। এ এমন নেশা যাকে ধরে তার আর রেহাই নেই। এই বয়সে তো কাজকর্মও কম, এ দিয়ে তাই সময়ও কাটে ভালো। পৃথিবীর অনেক বয়স্ক লোক আছে যারা স্কেল মডেল সংগ্রহ ও বিনিময় করে মধুর সময় পার করে। তাই যতই পাগলামি বলেন এর কিন্তু ভালো দিকও আছে। আরো গাড়ি আসছে, আগামীতে সময় পেলে দেখে যাবেন।