সঞ্চয়িতা: রেস্তোরাঁ নয়, ঘরোয়া পরিবেশে মিলবে ঘরোয়া খাবার
ঢাকার অলি-গলিতে হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে দেখা মিলে কতশত ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে আমরা আসলে যাই সাজানো গোছানো একটি পরিবেশে গিয়ে গল্প আড্ডায় পছন্দের খাবার উপভোগ করতে। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে বিদেশি খাবারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। শুধু কি তাই! বাঙালি হলেও আমাদের মধ্যে বিদেশি খাবার নিয়ে চলে একরকম নিরব প্রতিযোগিতা। এমনকি নিজেদেরকে আধুনিক আদলে গড়ে তুলতে একশ্রেণির লোকের কাছে এই খাবারগুলোর রয়েছে বেশ কদর। খাবারের নামগুলোও লেখা থাকে বাহারি সব চাইনিজ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ নামে।
এতসবের ভিড়ে সংস্কৃতি প্রিয় কিছু বাঙালির মন পড়ে থাকে সেই শৈশবে। ছোটবেলায় আত্মীয়ের বাড়ি দাওয়াতে গিয়ে আদর আপ্যায়নের সাথে জম্পেস গল্প, সাথে ভাত-ভর্তা-সবজি-ডাল দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার তৃপ্তির অনুভূতির তুলনা হয়না কিছুতেই। কিন্তু ঘরের তৈরি খাবারের স্বাদ মিলবে কি রেস্তোরাঁয়?
আধুনিক ঢাকাতেই মিলবে এমন এক অচেনা আত্মীয়ের ঠিকানা। যিনি পেশায় একজন টেকসই ফ্যাশন ডিজাইনার ও সমাজকর্মী হলেও ভালোবাসেন মানুষকে নেমন্তন্ন করে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতে। বাঙালিয়ানা ভোজের আয়োজন, তাই এখানে খাবার থেকে ঘর সজ্জার সবকিছুতে থাকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছাপ। কিন্তু ঘরোয়া এই নেমন্তন্নে থাকবে না কোন প্রকার চাইনিজ, ইতালিয়ানের মতো বিদেশি খাবার। এমনকি থাকবে না কোন প্রকার মাংস ও মাছ জাতীয় খাবারের উপস্থিতি। কেননা এটি একটি সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী রেস্তোরাঁ।
পরিবেশ সচেতন ফ্যাশন ডিজাইনার ফায়জা আহমেদ নিরামিষভোজী রেস্তোরাঁ 'সঞ্চয়িতার' স্বত্বাধিকারী। তবে তিনি এটিকে রেস্তোরাঁ মানতে ও বলতে নারাজ। তার ভাষ্যমতে, "সঞ্চয়িতা শুরু করার পেছনে যে গল্প ও কারণ রয়েছে তা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে করা রেস্তোরাঁ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার এখানে খেতে আসা লোকেরা আমার ক্রেতা নয়। আমি তাদেরকে অতিথির মতো আপ্যায়ন করার চেষ্টা করি এবং সেই কম্ফোর্টটা দেই। আবার তথাগত রেস্তোরাঁর মতো চাইলেই যেকেউ আমার এখানে ঢুকে খাবারের জন্যে অর্ডার দিতে পারবেন না।"
"আমি নিজে একজন শিল্পী তাই আমার খাবার রান্না থেকে পরিবেশন সবকিছুতে সেই শিল্পের ছোঁয়া রেখেই কাজগুলো করে থাকি।"
শৈশব স্মৃতি থেকে সঞ্চয়িতার যাত্রা শুরু
শৈশবের স্মৃতিকাতর ফা্যজা আহমেদ প্রায় ভাবতেন সেদিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল! যেখানে মা-দাদুর কাছে বায়না ধরলে নারকেল মাখা মুড়ি পাওয়া যেত, বাড়িতে হরেক রকমের নাড়ু, লাড্ডু বানিয়ে বোতলে সাজিয়া রাখা হতো। এই চিন্তা থেকেই তিনি ২০১৬ সালে নিকেতনে 'ক্যাফে সঞ্চয়িতা' নামের একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন।
চা নিয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ সবসময়ই ছিল, তাই ক্যাফে সঞ্চয়িতাতে চা থাকবে না তা কি করে হয়! ক্যাফে সঞ্চয়িতা তে নানারকম চায়ের পসরার সাথে অন্যান্য নাস্তা আইটেম যেমন- পুরি, লাড্ডুও আছে। মাঝে মাঝে সেখানে ঘটা করে আয়োজন করা হয় চা-চক্র। চায়ের চুমুকে আড্ডার সাথে মৃদু সুরে বাজানো হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও বাংলা ক্লাসিক সব গান।
'সঞ্চয়িতা' চালু করার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে ফায়জা আহমেদ বলেন, "রেস্তোরাঁয় গিয়ে যেখব খাবার খাওয়া বা অর্ডারের কথা মানুষ খাওয়া বা অর্ডারের কথা ভাবতেই পারেনা, সেসব খাবারের চিন্তা থেকেই আমি সঞ্চয়িতা চালু করি। আমার এটা চালু করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি খাবারের ঐতিহ্যকে তুলে ধরা।"
"অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করতো খাবারের রেস্তোরাঁর নাম সঞ্চয়িতা রাখার কারণ কী? আমি একজন শিল্পী হিসেবে ঐতিহ্য, সাহিত্য ও খাবারকে একই মেলবন্ধনে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই সঞ্চয়িতার নামে আমার রেস্তোরাঁর নাম দেওয়া। করোনাকালে মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা থেকে নিরামিষ খাবার রান্না করে স্বল্পপরিসরে ডেলিভারি দেওয়া শুরু করি। সেখান থেকে সাড়া পেয়ে পরবর্তীতে ডেলিভারির পাশাপাশি আয়োজন ও আপ্যায়ন করে খাওয়ার ব্যবস্থা চালু করি।"
আতিথেয়তার সাথে মিলবে ঘরের খাবারের স্বাদ
মেহমান আসবে তাই সাজানো হয়েছে ঘর থেকে বারান্দা। সিঁড়িতে জ্বালানো হয়েছে মোমবাতি, প্রদীপ ও সুবাস ছড়ানো আগরবাতি। বাড়ির ভেতরে ঢুকলে বোঝার উপায় নেই এটা অপরিচিত কারো বাড়ি। বেশ আপ্যায়নে চলে রাতের খাবার, জমে ওঠে নানা বিষয়ে গল্প-আড্ডা।
ফায়জা আহমেদ নিজের হাতে সবকিছু রান্না করা থেকে পরিবেশনার কাজটিও করে থাকেন। মেহমানদের আপ্যয়নে নিজে পাশে থেকে সকলের পাতে খাবার তুলে দেন পরম যত্নের সাথে। বোঝার উপায় নেই এদের কারও সাথে তার কোন পূর্ব-পরিচয় নেই। এখানেই সঞ্চয়িতা অন্যান্য রেস্তোরাঁ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে পরিচিত বন্ধু ও আত্মীয়রাও এখানে মাঝেমধ্যে খেতে আসেন নিরামিষ রান্নার স্বাদ পরখ করে দেখতে।
সঞ্চয়িতা-তে রান্না করার কাজের জন্যে কোনো অতিরিক্ত রাঁধুনি বা পরিচারক নেই। এমনকি ভাড়া নেওয়া কোনো প্রতিষ্ঠানেও এটি অবস্থিত নয়। বনানীর একটি বাড়িতে যেখানে ফায়জা আহমেদের 'মানাস' ফ্যাশন ব্রান্ডের কাজ চলে তার পাশের একটি রুমকে সাজানো হয়েছে আতিথিয়েতার জন্যে। বাড়িটিকে প্রকৃতির ছোঁয়ায় মুড়িয়ে রাখতে সাজানো হয়েছে ছোট-বড় গাছে। জানালায় লাগানো হয়েছে বাঁশের তৈরি ঝুলন্ত পর্দা।
'সঞ্চয়িতায়' মিলবে সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত এই চারবেলায় ভিন্নভিন্ন খাবার আইটেম। সাথে মিলবে মৌসুমী ফলের আচার ও নানা রকমের ফ্রোজেন খাবার। সকালের খাবার মেন্যুতে রয়েছে লুচি লার্বা সুজির প্ল্যাটার, এছাড়াও আছে আলুর দমের সাথে পরোটা ও সুজি। এছাড়া রয়েছে গ্রাম বাংলার সকালের নাস্তায় প্রচলিত খুদের ভাতের সাথে কয়েক পদের ঝাল-ভর্তা। ফায়জা আহমেদ খুদের ভাতের এই প্ল্যাটারের নাম দিয়েছেন বউ খুদি। ঝরঝরা পোলাও চালের খুদির সাথে মিলবে সরিষা, আলু ও তিষি ভর্তা। এছাড়াও সকালের নাস্তায় থাকে কয়েক রকমের পিঠাপুলির আয়োজন থাকে।
দুপুরের খাবার তালিকায় ভাত, সবজি, শাক, ডালের মতো আইটেমগুলো বেশি থাকলেও বিরিয়ানি, কোরমা ও রোস্ট পাওয়া যাবে চাইলেই। সচরাচর বিরিয়ানি রান্না গরু বা খাসি দিয়ে করা হয়ে থাকলেও এখানে বিরিয়ানি তে থাকবে আলু ও মোটর। মুরগী খাসির রোস্টের সাথে পরিচিত আমাদের অনেকেই কখনো শুনিনি ফুলকপির তৈরি রোস্টের কথা। তাই অনন্য স্বাদের এই রোস্ট খেয়ে দেখতে চাইলে একবার হলেও সঞ্চয়িতার নীড়ে ভিড় করতে হবে আপনাকে।
সঞ্চয়িতা ভেগান রেস্তোরাঁটি কেবলমাত্র নামে নয়, এর প্রতিটি রেসিপি যথাযথ নিয়ম মেনে রান্না করা হয়। সঞ্চয়িতার প্রতিটি প্ল্যাটারের মূল্য জনপ্রতি সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা থেকে শুরু। আর প্রতিকেজি মাশরুম হালিমের জন্য নির্ধারিত দাম হচ্ছে ১৩৭৫টাকা।
ফায়জা আহমেদ বলেন, "রান্নার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তেমনভাবে নেই আমার। আমার মা ছিলেন খুব ভালো রাঁধুনি। তার থেকেই আমার রান্নার হাতেখড়ি। কিছু মানুষ আছে উত্তরাধিকারসূত্রে পূর্বপুরুষ বা পরিবারের সদস্য থেকে বিভিন্ন গুণাবলি পেয়ে থাকে, আমার ক্ষেত্রে রান্নাটা হচ্ছে তাই। আমি আমার মায়ের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে রান্নার গুণটি পেয়েছি। তাইতো আমি ২ জন হোক কিংবা ৫০ জন, নিজের আন্দাজমতো নুন, মসলা, তেল দিয়ে থাকি। এই কাজে আমি অন্যান্য রাঁধুনিদের মতো পরিমাণ হিসেব করে করে কাজটি করিনা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার হচ্ছে কম রান্না হোক বা বেশি, আমার রান্নার স্বাদে হেরফের হবেনা এবং আন্দাজ মতো পরিমাণ সবসময় ঠিকঠাকই হবে।"
ঐতিহ্যগত খাবারে শিল্পীর হাতের নিদারুণ কারুকার্য
সপ্তাহের রোববার ছাড়া প্রতিদিন সঞ্চয়িতার হেঁশেলে রান্না হয়। দিনের সব বেলায় খাবার ডেলিভারি দেওয়া হলেও এখানে এসে আয়েশ ও গল্প করে খেতে চাইলে তা শুধু রাতের ভোজে সম্ভব। কিন্তু সেজন্যে পূর্বেই রিজার্ভেশন দিয়ে রাখতে হবে। কেননা অর্ডার আসার পরে রান্না চড়ানো হয় চুলোয়। তাই একরকম সতেজ তাজা স্বাদও লেগে থাকে প্রতিটি রান্নায়। এছাড়া বাটাটাপুরি, সন্দেশ পিঠা, হালিম, নাড়ু ও বিভিন্ন মৌসুমে ফলের আচার পাওয়া যায় সঞ্চয়িতায়।
সঞ্চয়িতা পাকশালার প্রতিটি প্ল্যাটারের নাম কবিতার নামে নামকরণ করা হয়েছে। কোনটি রাখা হয়েছে আগমণ, কোনটির নাম দিঘি, নিমন্ত্রণ বা অতিথি। কবিতাগুলো রবিঠাকুর কবে, কখন, কোথায় বসে লিখেছেন তার স্বল্পপরিচিতিও তুলে ধরা হয়েছে মেন্যু তালিকার পাশে। বাঙালির ঐতিহ্যগত খাবারের সাথে বাংলা কবিতা জুড়ে দেওয়া যেন ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে। খাবার পরিবেশনেও রাখা হয়েছে গ্রাম বাংলার চিরচেনা বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। তাইতো খাবার পাতা হয় তামা, কাঁসার থালাতে এবং তার ওপর কলাপাতা রেখে সেখানে খেতে দেওয়া হয়।
পরিবেশ সচেতন ফায়জা আহমেদ খাবার প্যাকেটজাত করতে কোনোপ্রকার প্লাস্টিক ব্যবহার করেন না। মাটির হাঁড়িতে খাবার দিয়ে তার মুখে বেঁধে দেওয়া হয় কাগজ ও পরিস্কার নতুন গামছা কাপড় দিয়ে। আচারের কাঁচের বোতলের মুখেও বেঁধে দেওয়া হয় কাপড়ের টুকরো। তাই ডেলিভারির সময় বেশ সাবধানতার সাথে সেগুলো পৌঁছে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত ও অর্ডারকৃত খাবারটি হচ্ছে ধোকার ডালনা। অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন খাবারের মধ্যে এটি একটি। খেসারি ও বুটের ডাল দিয়ে রান্না করা এই খাবারটি পরিবেশন করা হয় আঠালো বিন্নি ভাতের সাথে।
ফায়জা আহমেদ বলেন, "আমার এই কাজের মধ্যে একধরনের প্রতিবাদের ভাষা রয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই বাঙালিদের খাবারকে বিদেশি খাবারের থেকে হেয় করে দেখি। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যগত খাবারগুলো কতটা স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু তা তুলে ধরাই আমার কাজ। কোন মৌসুমে কোন খাবার স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো হবে, তা নিয়ে আমি পড়াশোনা করার মাধ্যমে সেগুলো মেন্যুতে রাখি। যেমন চৈত্রের গরমে তিতা খাবার আমাদের শরীরের জন্য ভালো। তারপর বিভিন্ন আচার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।"
ফায়জা রেস্তোরাঁর দিক বিবেচনায় একজন প্রচার বিমুখ মানুষ। তিনি চান না রেস্তোরাঁকে বাণিজ্যিকভাবে প্রচারণার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে। এতে যে উদ্দেশ্যে এই কাজটি শুরু করা, তা-ই যেন হারিয়ে যাবে।
ফায়জা আহমেদ তার কাজের উদ্দেশ্যে নিয়ে জানাতে বলেন, "আমার এখানে খেতে আসা লোকদের সবাই যে নিরামিষভোজী এমন নয়। তারা অন্যসব রেস্টুরেন্ট থেকে ভিন্ন কিছুর স্বাদ পরখ করে দেখতে চান বলেই আমার এখানে ডাল, ভাত, সবজি ও ভর্তা খেতে আসেন। অনেকে আবার ঘরের খাবারে স্বাদ পেতে আমার এই ছোট্ট নিড়ের ঠিকানায় চলে আসেন।"
"ভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ ঘুরতে আসা অনেকেই বাঙালি খাবারের স্বাদ নিতে আমার এখানে এসেছেন। আমার অতিথিদের মধ্যে বিদেশি হাইকমিশন থেকে আসা লোকের সংখ্যাটাই বেশি। প্রতিদিন যে পরিমাণ অর্ডার ও কর্পোরেট অর্ডার আসছে, আমি চাইলেই বড় কোনো স্থান ভাড়া নিয়ে সঞ্চয়িতাকে বর্ধিত করতে পারি। কিন্তু আমি তা চাইনা। কেননা আমি নিজ হাতে যতোজনের জন্যে রান্না করে খাওয়াতে পারছি তার বাইরে আমি এটাকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বড় করতে চাইনা। লোকে ঘরের খাবারের স্বাদ পাচ্ছে, আর আমিও নিজ হাতে তাদের রান্না করে আপ্যায়ন করতে পারছি। এখানেই সঞ্চয়িতার স্বার্থকতা।"