তার কারবার জেব্রা, জিরাফ, সিংহ, গণ্ডার, জলহস্তী নিয়ে...
চাকরি করবেন না ঠিক করেছিলেন আগেই। খোকনের জন্য বাবা-মায়ের তাই ভাবনা ছিল বেশি। বাবা ছিলেন পিডব্লিউডি-র প্রকৌশলী। তিনি সেখান থেকে খোকনের জন্য একটি লাইসেন্স (কন্ট্রাক্টরির) বের করেছিলেন। কিন্তু খোকন রড-সিমেন্টের কাজেও লাগতে চাইলেন না। এমন একটা ব্যবসা করতে চাইলেন যেটায় ছলচাতুরি করতে হয় না, আবার জীবিকাও নির্বাহ হয়।
ছোটবেলায় দুরন্ত ছিলেন খোকন যার পোশাকি নাম সোহেল আহমেদ। আজিমপুরের শেখ সাহেব বাজারে বড় হয়েছেন। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ব্যাডমিন্টন যখন যেটার মৌসুম, তখন তা খেলেছেন শাহ সাহেব বাড়ি মাঠে। ম্যাট্রিকের ছিলেন চুয়াত্তরের ব্যাচ। পড়েছেন ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে, তারপর আইডিয়াল কলেজে।
সোহেল বলছিলেন, 'আমার বাল্যসাথীদের প্রত্যেকেই একেকজন জুয়েল, মানে রত্ন—কেবল আমি ছাড়া। আমাদের বন্ধুদের বেশিরভাগই ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সদ্যবিদায়ী অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদও আমার বাল্যবন্ধু। এত বড় বড় মানুষের মধ্যে আমিই কেবল অকাজের কাজি, জীবজন্তুর ব্যবসা ধরেছিলাম।'
সোহেল আহমেদের বন্ধু ছিল অনেক। তাদের সব বয়সী একটা আড্ডাও ছিল। সেখানে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আসতেন কয়েকজন। একজন যেমন ফজলুল হক তালুকদার। তিনি সরকারের সাপ্লাই অ্যান্ড ইনস্পেকশন দপ্তরের উপপরিচালক ছিলেন, পরে পরিচালক হয়ে অবসরে যান। সরকারের যাবতীয় ক্রয়-বিক্রয় তখন ওই দপ্তর মারফত পরিচালিত হতো।
সোহেলদের আড্ডার আরেকজন ছিলেন এমএ নূর। তিনি ইনকাম ট্যাক্স লইয়ার ছিলেন এবং টেক্সটাইল বিজনেসও করতেন।
১৯৮১ সালের গল্প বলছিলেন সোহেল, 'আইডিয়াল কলেজে তখন আমি ডিগ্রি শেষ বর্ষের ছাত্র। মাঝেমধ্যে বেড়াতে যেতাম কলকাতায়। তালুকদার সাহেব এবং নূর ভাইয়ের পাখি পোষার শখ ছিল। তালুকদার সাহেব একদিন বললেন, সোহেল, তুমি তো কলকাতা যাওয়া-আসা করো, আমাদের জন্য সেখান থেকে পাখি আনতে পারো। আমরা তোমাকে দাম দিয়ে দিব।
'তিনি বলেও দিলেন কলকাতার কোথায় পাখি পাওয়া যায়। পরেরবার কলকাতা গিয়ে হাতীবাগানে হাজির হলাম। রোববারে হাতীবাগানে পাখির ওপেন মার্কেট বসত। প্রথমবারে কিছু লাভ বার্ড, বাজরিগার আর কাকাতুয়া নিয়ে এসেছিলাম প্লেনে করে।'
লেখক: এয়ারপোর্টে কোনো অসুবিধা হয়নি?
সোহেল: আসলে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা শাড়ি-চুড়ি, গহনা-গাটির ব্যাপারেই উৎসাহী থাকত বেশি। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এগুলো দিয়ে কী করবেন? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, পালব। হেলথ সার্টিফিকেট (পাখিগুলোর) দেখানোর নিয়ম ছিল, আমি তা দেখিয়েছিলাম। তারা তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল।
লেখক: কয়টা খাঁচা লেগেছিল? বিমানের কোথায় রাখা হয়েছিল?
সোহেল: বেশি পাখি তো আনিনি। এক খাঁচাতেই এঁটে গিয়েছিল। কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল খাঁচা আর বাতাস চলাচলের জন্য ইতিউতি ফুটোও রাখা হয়েছিল। পাখিরা তাই বিমানের ভিতরে (অন বোর্ড) চড়ে আরামেই চলে এসেছিল।
এভাবে কয়েকবারই চলল যাওয়া-আসা। কলকাতার কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুতাও হয়ে গেল। তখন ভারতে বন্যপ্রাণী শিকার ও রপ্তানিতে তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ট্রেনে করে বড় বড় জন্তুও এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে চালান করা হতো। বনের ধারের এলাকাগুলোয়ে অ্যানিম্যাল ক্যাচার নামে এক পেশাজীবী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যারা বন্যপ্রাণী ধরে এবং বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত।
তখন সার্কাস পার্টি ছিল ভারতে অনেক। তারা বাঘ, হাতি, ভালুক, বানর, উট, গাধা বা ঘোড়া দিয়ে খেলা দেখাত। আফ্রিকার পরেই কিন্তু প্রাণবৈচিত্র্যে ভারতের অবস্থান। চিড়িয়াখানার সংখ্যাও সেখানে অনেক।
ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে পশু-পাখি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। নকুল সরকার নামের একেজনের সঙ্গে যেমন পরিচয় হয়েছিল সোহেলের, তিনি ছিলেন কলকাতার নামী অ্যানিম্যাল ট্রেডার। সারা ভারতেই তিনি পশু-পাখি সরবরাহ করতেন। তবে ভারত সরকার এর অল্পকালের মধ্যেই বন্যপ্রাণী শিকার ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আইন তৈরি করেছিল। সোহেলের তাই পাখি ব্যতিত অন্য প্রাণী আর আনা হয়ে ওঠেনি ভারত থেকে। সোহেলের নিজের পাখি রাখার জায়গাও ছিল না, আনার পর ফজলুল হক তালুকদার বা নূর সাহেবের বাড়িতে রেখে আস্তে আস্তে বিক্রি করে দিতেন। বছরখানেক এভাবেই গেল।
চিড়িয়াখানায় পাখি লাগবে
কলকাতা থেকে পাখি আনা ছাড়া আর বেশি কিছু কাজ নেই। মাঝেমধ্যে তালুকদার সাহেবের অফিসে যান, গল্প করেন আর কাজের উপায় খোঁজেন।
বিরাশি সালের শেষদিকে একদিন তালুকদার সাহেব মন্ত্রণালয়ে গেছেন মিটিং করতে, প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মীর্জা এম এ জলিল সাহেবের সঙ্গে দেখা। তালুকদার সাহেবের পাখি পালন শখের কথা গল্পে গল্পে জলিল সাহেব জানতে পারলেন আর বললেন, 'পাখিগুলো আমাকে দিন, চিড়িয়াখানায় রেখে দিই।'
তালুকদার সাহেব বললেন, 'এগুলো আমার শখের জিনিস, চিড়িয়াখানায় দিতে যাব কেন? যদি আপনার লাগে তবে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি যে আমাদের পাখি এনে দেয়। সে জানে এগুলো কীভাবে আনা-নেওয়া করতে হয়।'
জলিল সাহেব উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললেন, 'আপনার জানাশোনা এমন লোক আছে, সত্যি! আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা চিড়িয়াখানার জন্য পাখি নিব।'
দুদিন পর সোহেল গিয়েছেন তালুকদার সাহেবের অফিসে। দেখেই তালুকদার সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, 'আরে মিয়া, কই ছিলা ডুব মাইরা, আমি তো তোমারেই খুজতেছি। বসো, জরুরি কথা আছে।'
সোহেল বসার পর বললেন, 'তুমি তো আমার এখানকার পরিস্থিতি সব দেখতেছ। দুই নম্বর থেকে চৌদ্দ নম্বর—সব লোক পাইবা কিন্তু এক নম্বর পাইবা না। তাই এখানে তুমি পারবে না বরং মীর্জা জলিল সাহেবের কাছে যাও, আজকেই যাও। গিয়ে শুধু আমার নাম বলবে। বাকিটা তিনিই তোমারে বলবেন।'
সোহেল রওনা হলেন। তখন প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্তারা কাজী আলাউদ্দিন রোডের পশু হাসপাতালের ভেতরে অফিস করতেন। জলিল সাহেবের অফিসে গিয়ে সোহেল অ্যাটেনডেন্টকে বললেন খবর দিতে। খবর পেয়ে জলিল সাহেবে নিজেই এসে রিসিভ করলেন আর অবাকও হলেন।
জলিল সাহেব ভেবেছিলেন, সোহেল বয়স্ক মানুষ হবেন। অথচ সোহেলের বয়স তখন ২৩ বা ২৪। বললেন, 'আপনিই সেই লোক যে পাখি এনে দেন তালুকদার সাহেবকে?' সোহেল হ্যাঁ বলার পরেও তার সন্দেহ যায় না। বললেন, 'পাখি কোথায় রাখেন? দেখাতে পারবেন?'
সোহেল আলপটকা বলে দিলেন, 'হ্যাঁ, দেখাতে পারব, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আছে।'
জলিল সাহেব বললেন, 'আমি আজকেই যাব। চারটার সময় এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। দেইখেন ফাঁকি দিয়েন না।'
সোহেল বলেছিলেন, 'না, ফাঁকি দিব না। ঠিক সময়ে চলে আসব।'
তারপর পশু হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এসে সোহেল সোজা চলে গিয়েছিলেন তালুকদার সাহেবের অফিসে। সব বিস্তারিত বয়ান করলে তালুকদার সাহেব হায় হায় করে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, 'আরে মিয়া করছ কী, আমার বাড়িতে নেমপ্লেট লাগানো আছে, তিনি তো দেখেই বুঝে ফেলবেন।'
সোহেল: তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি তো আপনার বাসায় পাখি এমনিতেও রাখি। এখন নাহয় আমার কোনো স্টক নাই, কিন্তু পাখিগুলা তো আমিই এনে দিয়েছি। জলিল সাহেবের সন্দেহ ঘোচানো দিয়ে কথা, আপনি রাজি হয়ে যান।
তালুকদার সাহেবকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আবার এলেন পশু হাসপাতালে। চারটায় জলিল সাহেবকে নিয়ে গেলেন মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে। পাখি দেখে খুশি হলেন জলিল সাহেব। বললেন, 'আপনি আমাদের বাজরিগার, কাকাতুয়া, বিভিন্ন রকমের মথুরা, বিশেষ করে লেডি অ্যামহার্স্টস ফিজেন্ট এনে দেন। তালিকা বানান, আমরা টেন্ডার দিব, বেশি দেরি করবেন না।'
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সোহেলের। ভাবতে ভাবতে গেলেন সব পাখি সহজলভ্য হবে কি না এই সময়ে, আর দামেও মিলবে কি না। বিশেষ করে লেডি অ্যামহার্স্ট ফিজেন্টের দাম এমনিতেই চড়া। সারাহ অ্যামহার্স্ট (১৭৬২-১৮৩৮) নামের এক ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী থাকতেন ভারতে। তিনিই প্রথম ১৮২৮ সালে পাখিটা পাঠিয়েছিলেন লন্ডনে, পরে তার নামেই রাখা হয় পাখিটার নাম। খুবই রঙিলা এই পাখি।
তালিকা করে টেন্ডার জিতে নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন সোহেল। সরোজ হালদার নামের এক বার্ড ব্রিডারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেবার। থাকতেন পার্ক সার্কাসে। তার কাছে কিছু পাখি পেয়েছিলেন, হাতীবাগান থেকেও সংগ্রহ করেছিলেন কিছু।
সেবার দুই খাঁচা পাখি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। চিড়িয়াখানার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উৎরেও গিয়েছিলেন। চিড়িয়াখানার একটা নিয়ম আছে যে, কোনো পশু বা পাখি আমদানির পর তা ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। চৌদ্দ দিনের মধ্যে কোনো সমস্যা (মূলত স্বাস্থ্যবিষয়ক) ধরা না পড়লে ছাড়পত্র দেওয়া হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
তবে সমস্যা তৈরি হয়েছিল আরেক দিক থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক বাজরিগার দেখে চিড়িয়াখানার কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, এগুলো তো রং করা পাখি। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলে দেখবেন সব রং উঠে যাবে।
কর্মকর্তা ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন। বাজরিগার দারুণ রঙচঙা পাখি। তিনিই নিজেই রিসিভ করেছিলেন। যদি শিক্ষকের কথা সত্যি হয় তো জবাবদিহি করতে পড়তে হবে, চাকরিও চলে যেতে পারে।
পরে যখন সোহেল রুটিন ভিজিটে চিড়িয়াখানা গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তোপের মুখে পড়লেন। কর্মকর্তা তাকে ধরে বললেন, 'এত বড় বাটপারি করতে পারলেন?'
সোহেল: কী বাটপারি?
কর্মকর্তা: রঙ করা পাখি এনে চালিয়ে দিলেন।
সোহেল তো অবাক, রঙ করা হবে কেন? আর যদি তা-ই হয় তবে নিজে কেন পরীক্ষা করে দেখেন না। ওই তো পালক পড়ে আছে। আপনি উঠিয়ে নিয়ে পানি দিয়ে, সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে রং তুলতে চেষ্টা করুন।
এই এতক্ষণে কর্মকর্তার হুঁশ হলো। তিনি ভাবলেন, আরে, তাই তো। পরীক্ষা তো এখনই হয়ে যেতে পারে।
পরীক্ষার ফলাফল দেখার জন্য আর অপেক্ষা করেননি সোহেল, কারণ তিনি জানেন এভাবে পাখি রং করা যায় না আর তা করাও হয়নি।
চিড়িয়াখানার কথা কিছু
মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানা উন্মুক্ত করা হয় ১৯৭৪ সালে। এর শুরু অবশ্য উনিশ শতকের শেষভাগে। ঢাকার নবাবরা ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা করেছিলেন রমনায়।
দেশভাগের পর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে একটি চিড়িয়াখানা তৈরির প্রয়োজন দেখা দেয়। সেইমতো পঞ্চাশের দশকে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের সামনে এখনকার জাতীয় ঈদগাঁ এলাকায় ৪-৫ একর জায়গা নিয়ে ছোট একটি চিড়িয়াখানা করা হয়। সেখানে বানর, হনুমান আর হরিণ ছিল। সরীসৃপের মধ্যে ছিল অজগর আর কুমির। চিড়িয়াখানার পুকুরে রাজহাঁস, পাতিহাঁসও দেখা যেত।
মিরপুরে এখনকার চিড়িয়াখানার আয়তন ২১৩ একরের বেশি। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধান করে। বছরে ৩০ লক্ষ লোক এটি পরিদর্শন করে। প্রায় ১৯০ প্রজাতির দুই হাজারেরও বেশি মেরুদণ্ডী প্রাণী আছে জাতীয় চিড়িয়াখানায়। পাখি আছে ৯১ প্রজাতির ১,৫০০ প্রায়।
বাঘ, সিংহ, জলহস্তী ছাড়াও জেব্রা, এমু, গয়াল, লেমুর আছে। বাঘ, সিংহ, চিতার প্রজনের সাফল্য পেয়েছে চিড়িয়াখানা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রাণীবিনিময়ও করে থাকে।
১৯৭৪ সালে অনুমোদিত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে দেশের ভেতর বেশিরভাগ বন্যপ্রাণী ধরা, মারা, শিকার বা আহত করা নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ২০১২ সালের আইনেও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনায় অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
বাংলাদেশ সিআইটিইএস বা সাইটিসের (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজারড স্পেশিজ অভ ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা) চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশও। মূলত বন্যপ্রাণীর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭৫ সাল থেকে এটি সারা পৃথিবীতে কার্যকর।
সাইটিস চিহ্নিত প্রায় ৫,০০০ বন্যপ্রাণীর (ওরাংওটাং, তিমি, ডলফিন, সি টার্টলস ইত্যাদি) যে কোনোটির পরিবহন বা স্থানান্তরের জন্য অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ সরকার বন্যপ্রাণীর বংশ বিস্তার ও সংরক্ষণে কক্সবাজার ও গাজীপুরে দুটি সাফারি পার্কও করেছে।
দেশে এখন ঢাকা ছাড়াও রংপুর আর চট্টগ্রামে চিড়িয়াখানা আছে। তবে রংপুর চিড়িয়াখানার পশুপাখি কেনার অথরিটি নেই। সাধারণত জাতীয় চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্ক থেকে উদ্বৃত্ত পশু যায় রংপুর চিড়িয়াখানায়। কুমিল্লায় একটি চিড়িয়াখানা ছিল, তবে তা বন্ধ হয়ে গেছে।
আটাশি সালে নেদারল্যান্ডে
সোহেল ভাইকে জিজ্ঞেস করি, চুয়াত্তরে মিরপুরে চিড়িয়াখানা হওয়ার পর কী কী প্রাণী ছিল?
সোহেল: আমার কোনো ধারণা নেই।
লেখক: তখন চিড়িয়াখানায় পশু পাখি সাপ্লাই দিত কে বা কারা?
সোহেল: আসলে একটা বড় সময় ফরেন পারচেজ বন্ধই ছিল। আর যেহেতু বন্যপ্রাণী আইন প্রণয়ন হয়ে গিয়েছিল, তাই দেশের বনজঙ্গল থেকে প্রাণী ধরে চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসাও সহজ ছিল না। তবে শুনেছি জন মুনরো নামের এক বেলজিয়ান কিছু প্রাণী সাপ্লাই দিয়েছিলেন। এর বেশি কিছু জানি না।
লেখক: বেলজিয়ামে কি সাফারি পার্ক বা ব্রিডিং সেন্টার আছে অনেক?
সোহেল: পাখির জন্য বেলজিয়াম ভালো।
লেখক: আপনি বৃহদাকার প্রাণী সরবরাহ করার ফরমায়েশ পেলেন কবে?
সোহেল: আটাশি সালে প্রথম চালান আনি নেদারল্যান্ড থেকে। তখন তো ইমেইল বা মোবাইলের যুগ ছিল না। দূতাবাসগুলোতে গিয়ে অ্যানিম্যাল ট্রেডারদের তালিকা চাইতাম। তালিকা পাওয়ার পর ফ্যাক্স করতাম। সবাই তো উত্তর দিত না। যারা দিত তাদের সঙ্গে দর কষাকষি করতাম, অনেক ফ্যাক্স চালাচালি করতাম। সময় লেগে যেত বেশি।
প্রথম চালান নেদারল্যান্ডের যে প্রতিষ্ঠান থেকে আনি তাদের নাম ব্ল্যাঙ্কস্টাইন পেট ফার্ম বিভি। ইমু, ম্যান্ডারিন ডাক ইত্যাদি এনেছিলাম। ব্ল্যাঙ্কস্টাইন এখন আর ব্যবসায় নেই। তবে শিম্পাঞ্জি যাদের কাছ থেকে এনেছিলাম সেই র্যাভেনসডেন্স জু এখনো টিকে আছে। নীল গাই এনেছিলাম ম্যান ইন্টারন্যাশনাল ভেল বিভি থেকে।
লেখক: নেদারল্যান্ডে কি পশুপাখির বৈচিত্র্য অনেক?
সোহেল: দেশটার কথা বলছি না। ওদের অ্যানিম্যাল ফার্মগুলো খুব সমৃদ্ধ। অনেক জায়গাজুড়ে হয় এসব ফার্ম। সব প্রাণী খোলা পরিবেশে বিচরণ করে। কর্মীরা প্রাণী-অন্তপ্রাণ হয়। যে প্রাণী যেমন পরিবেশে ভালো থাকে, তেমন তেমন পরিবেশ বানিয়ে নেয় তারা।
নীল গাই বা অ্যান্টিলোপ আমাদের দিনাজপুরেও একসময় পাওয়া যেত, এখন তো বিলুপ্ত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসে নীলগাইয়ের কথা কয়েকবারই বলেছেন। ওখানে গিয়ে আমি নীল গাই দেখলাম, তারপর দেখি আমাদের ঘরের আরেক প্রাণী ক্লাউডেড লেপার্ড। মেঘলা চিতা, লাম চিতা, গেছো বাঘ আর ফুলেশ্বরী চিতা নামেও এটি পরিচিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই প্রাণী, আইইউসিএন এদের সংকটাপন্ন ঘোষণা করেছে। এরা সহজেই পোষ মানে। আগের দিনে জমিদার, চা বাগান মালিকরা গেছো বাঘ পুষতেন।
সোহেল ভাই বড় বড় প্রাণী বেশি এনেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। এটা অবশ্য শুরু হয় ইমেইল যুগে। তিনি আগে ইমেইলে প্রাণীর তালিকা পাঠিয়ে দেন। কথাবার্তা সব শেষ করে নিজে রওনা হন।
সাধারণত ট্রেডাররা কথা আর কাজে কোনো হেরফের করেন না। প্রাণী ক্রেতার কাছে পৌঁছানো থেকে শুরু করে কোয়ারেন্টিন সময় পর্যন্ত সমস্ত দায়-দায়িত্ব থাকে খামারির।
সাধারণত কার্গো প্লেনে পুরে খাঁচায় করে প্রাণী আনেন সোহেল ভাই। কার্গোতে প্রাণীর উচ্চতাবিষয়ক শেষ সীমা ৩ মিটার। জিরাফের ক্ষেত্রে উচ্চতা সমস্যা বলে বাল্যবয়সী আনেন। যখন হিপো আনেন তখন ওয়াটার স্প্রে গান দিয়ে পুরোটা পথ প্রাণীটার শরীর ভিজিয়ে রাখেন।
একবার হাতি পরিবহনের একটা ঘটনা তার মনে আছে। দুটি হাতিকে সেবার ইতিহাদের কার্গোতে করে পৌঁছে দিয়েছিলেন সাইপ্রাসে।
প্রধানমন্ত্রীর উপহার পৌঁছে দেওয়া
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দুটি হাতি উপহার দিয়েছেন সাইপ্রাসকে। সচিবালয়ের বৈঠকে ড. তপন কুমার দে (সাবেক প্রকল্প পরিচালক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালেন, সোহেল আহমেদেরই দেশে-বিদেশে প্রাণী পরিবহনের ভালো অভিজ্ঞতা আছে। কর্তাব্যক্তিরা ডেকে আলাপ করে সোহেল আহমেদকে দায়িত্ব দিলেন হাতি দুটি সাইপ্রাস পৌঁছে দেওয়ার।
প্রাণীগুলো ছিল রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায়। সোহেল ভাই চলেছেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে তিনি হাতি দুটি দেখলেন। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করার জন্য মাহুত নিযুক্ত করলেন। রওনা হওয়ার আগে কমান্ড মানার অভ্যাস তাদের করিয়ে না নিলে বিপদ ঘটতে পারে। পরে ইতিহাদের একটি কার্গো চার্টার করেছিলেন। তাতে করে প্রাণী দুটিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সাইপ্রাসে।
লেখক: প্রাণী পরিবহনকালে কোনো দুর্ঘটনা কখনো ঘটেছে?
সোহেল: প্রথমত, পরিবহনকালের সব দায়িত্ব খামারি নিয়ে থাকে। তারা এসব ব্যাপারে খুবই প্রফেশনাল। শিম্পাঞ্জি বা হিপো পরিবহনের সময় তারা প্রশিক্ষিত লোক সঙ্গে দেয়।
দ্বিতীয়ত, বিমানে আনি বলে সময় লাগে কম। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ট্রাকে করে সোজা পৌঁছাই চিড়িয়াখানায়। সেরকম বড় কোনো দুর্ঘটনা কখনো ঘটেনি।
লেখক: আপনি উপহার দেওয়া বা পাওয়া আর কোনো প্রাণী পরিবহন করেছেন?
সোহেল: আমাদের বনবিভাগকে একবার মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাংক ট্রাস্ট ৪০টি কুমির উপহার দিয়েছিল। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল সেগুলো নিয়ে আসার। নিয়ে এসে বনবিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।
অদ্ভুত জায়গা ওই মাদ্রাজ ক্রক ব্যাংক। ওরা মূলত রেপটাইল সংরক্ষণ ও বংশবিস্তার নিয়ে কাজ করে। ভারতের তো বটেই, অনেক ভিনদেশী স্বেচ্ছাসেবকও আছে ওদের। সাপ-কুমিরের বিরাট এক সংসার দেখেছি ওখানে।
বন্ধুর নাম মোনাস
গাজীপুরে সাফারি পার্ক করা হবে বলে ২০১০ সাল থেকেই জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছিল। সেসঙ্গে চলছিল প্রাণীদের বাসোপযোগী প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরির কাজও।
এরপর প্রাণী সংগ্রহের দিকে নজর দিল কর্তৃপক্ষ। সোহেল আহমেদের ডাক পড়ল। কোথায় কোন প্রাণী কিভাবে রাখলে ভালো হয় তার পরামর্শও দিতে থাকলেন তিনি। একইসঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকলেন তার পুরোনো বন্ধু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াসের সঙ্গেও, যার পুরো নাম জোনাস হারমোনাস প্রিটোরিয়াস।
মোনাস মূলত ডাচ, তবে কয়েক পুরুষ ধরেই তারা থাকেন আফ্রিকায়। প্রিটোরিয়া থেকে অল্প দূরে ব্রিটস বলে এক জায়গায় তার খামার, নাম মেফুনিয়ে। ৮৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে মেফুনিয়ে। সাফারি পার্কের জন্য জেব্রা, জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট, সাদা গন্ডার, বাঘ, সিংহ, জলহস্তী ইত্যাদি অনেক প্রাণীই সোহেল ভাই এনেছেন মোনাসের খামার থেকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আরেকটি ওয়াইল্ডলাইফ পার্ক যার নাম মিস্টিক মাংকিজ। তারা বানর নিয়েই বেশি কাজ করে। কত রকমের বানর যে আছে পৃথিবীতে তা ওখানে না গেলে দেখাও হবে না আর জানাও হবে না।
লেখক: আপনার পছন্দের প্রাণী কি?
সোহেল: জেব্রা
লেখক: বই পড়তে পছন্দ করেন?
সোহেল: গোয়েন্দা কাহিনী ভালো লাগে।
লেখক: কী ধরনের খাবার পছন্দ করেন?
সোহেল: সব রকমের খাবারই খাই, তবে পরিমাণে বেশি না।
লেখক: অবসর সময় কাটান কিভাবে?
সোহেল: বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।
লেখক: আপনাকে কি দেশের প্রধান অ্যানিম্যাল ট্রেডার বলা যাবে?
সোহেল: হ্যাঁ, আমাদের ধারে-কাছেও কেউ নেই।
লেখক: আপনার বয়স এখন কত?
সোহেল: তেষট্টি।
লেখক: ধন্যবাদ। নিজের যত্ন নেবেন।
সোহেল: আপনাকেও ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।