১০ সেকেন্ডের এই ভারসাম্য রাখার পরীক্ষায় আপনি উতরাতে পারবেন?
বয়স যখন ৫০ পেরিয়েছে তখন থেকেই সোজা পথে হাঁটতে কিছুটা অসুবিধার মুখোমুখি হতে লাগলেন লেন কাপলান। শরীরের ভারসাম্যে কিছু একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল তাঁর। ডাক্তারের ভাষ্যে, বয়সের কারণে লেনের পিঠের ডিস্কগুলো (হাড়) সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে শরীরের ভারসাম্যের অবনতি হচ্ছিল।
বর্তমানে ৮০ বছর বয়সী লেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, "থেরাপি, নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। আমাকে আরও কিছু করতে হয়েছিল।"
সে সময় লেন এবং তার স্ত্রী জিনি প্রতিদিন দুবার করে 'তাই চি' ক্লাসের অংশ নেওয়া শুরু করেন। ৭৭ বছর বয়সী জিনি বলেন, তাই চি-কে তারা এতোটাই ভালোবাসে ফেলেছেন যে এটি এখন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বাড়ির কাছাকাছি ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োরবা লিন্ডাতে তাই চি শেখায় এমন একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছেন তারা। সাধারণত ধীরস্থির ও নিয়ন্ত্রিতভাবে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নাড়ানো এবং গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসই তাই চি'র মূল কাজ।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেন এবং জিনি নিয়মিত তাই চি এবং শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ বা ব্যালেন্স ক্লাস করছেন। এর সুফল হিসেবে লেন এখন সহজেই সোজাপথে হাঁটতে পারেন এবং তার শরীরের ভারসাম্যও আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে।
দীর্ঘায়ু এবং বয়স হওয়ার পরেও সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে 'ব্যালেন্স ট্রেনিং' নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে আমাদের সমাজে এর গুরুত্ব খুবই কম। এ ব্যাপারে কেউই তেমন সচেতনও নয়। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যালেন্স ট্রেনিং বা শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখার প্রশিক্ষণ আমাদের দীর্ঘদিন সুস্থতার সঙ্গে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুপূর্ণ। গেল জুনে ব্রাজিলের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১ হাজার ৭০০ প্রাপ্ত বয়স্ক লোকেদের মধ্যে ২০ শতাংশই শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে টানা ১০ সেকেন্ড বা তার বেশি সময় এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, শরীরের এমন ভারসাম্যহীনতা ১০ বছরের মধ্যে যেকোনো কারণে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে দ্বিগুণ।
তবে আপনি যদি বাড়িতে এক পায়ের ওপর ভারসাম্য ঠিক রেখে দাঁড়িয়ে থাকার পরীক্ষায় ব্যর্থ হন, তাহলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যালেন্স ট্রেনিং যেকোনো বয়সেই শুরু করা যেতে পারে। এমনকি, যদি আপনি ১০ সেকেন্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হন এবং আপনার বয়স যদি ৫০ বা এরচেয়ে বেশি হ্যে থাকে, তবে ঘরে বসেই আপনি শুরু করতে পারেন ব্যালেন্স ট্রেনিংয়ের কাজ। এর জন্য আপনার বাসায় ব্যায়াম করার বিশেষ কোনো সরঞ্জামেরও প্রয়োজন নেই।
১০ সেকেন্ডের এই পরীক্ষা আমাদের শরীর সম্পর্কে যা বলে
বিশ্বব্যাপী অনিচ্ছাকৃত আঘাতে দ্বারা মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো শারীরিক ভারসাম্যহীনতার কারণে পড়ে যাওয়া। এরপরেও শরীরের ভারসাম্য পরীক্ষা করার সহজ উপায় নেই ডাক্তারদের কাছে। ১০ সেকেন্ডের এই পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই শরীরের ভারসাম্যের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হলো, আলাদাভাবে উভয় পায়ে শরীরের সমস্ত ভর দিয়ে টানা ১০ সেকেন্ড কোনোকিছুর সহায়তা ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করা।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ব্যালেন্স স্টাডি বিষয়ক গবেষক ড. জোনাথন মায়ার্স বলেন, পরীক্ষাটির মূল উদ্দেশ্য হলো, একজন ব্যক্তি যেনো সহজেই নিজের শরীরের ভারসাম্য অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন। তার মতে, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারাটা অনেকাংশেই শারীরিক অক্ষমতা এবং আয়ু কমে আসার পূর্বাভাস দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজনে একজন এই পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং হিব্রু সিনিয়র লাইফের মার্কাস ইনস্টিটিউট ফর এজিং রিসার্চের পরিচালক ড. লুইস লিপসিজের মতে, বিভিন্ন কারণে ভারসাম্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যার মধ্যে বেশিরভাগই বয়স-সম্পর্কিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন আপনি চোখে ছানি পড়ার মতো বয়সে পৌঁছে যান কিংবা পা থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত যখন আপনার স্নায়ু সংকেতগুলো ধীর গতিসম্পন্ন হয়ে যায়, তখন শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। এ সমস্যা মোকাবেলায় বয়সকে আপনি থামিয়ে রাখতে পারবেন না, তবে বিশেষ ব্যায়াম ও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে এসব সমস্যার প্রভাব কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারবেন, শরীরের শক্তি বাড়াতে পারবেন।
কী কী উপায়ে শরীরের ভারসাম্য বাড়ানো যেতে পারে
শরীরের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে ভারসাম্য বৃদ্ধির বিষয়টি একান্তভাবে জড়িত। কারণ আপনার পেশীগুলো যত বেশি শক্তিশালী হবে, আপনার শরীরের ভারসাম্যও তত ভালো হবে। শক্তি ও ভারসাম্য বৃদ্ধির জন্য যা করা যেতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে- তাই চি বা ইয়োগা করা, ওজন কমানো, নৃত্য কিংবা রক ক্লাইম্বিং। এগুলোর মাধ্যমে শরীরের মেদ ঝরিয়ে সহজেই বাড়ানো যেতে পারে পেশীর শক্তি।
বাড়িতেই যেভাবে শুরু করতে পারেন ব্যালেন্স ট্রেনিং
তাহলে দীর্ঘায়ু নিয়ে সুস্থ থাকতে কীভাবে শুরু করবেন ব্যালেন্স ট্রেনিং? স্বস্তির কথা হলো, বেশিরভাগ ব্যালেন্স ট্রেনিংয়ের জন্য কোনো বিশেষ সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় না; ঘরে বসেই আপনি শুরু করতে পারেন এ কাজ। তবে নতুন যেকোনো ব্যায়াম শুরুর আগে অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখার ৫টি উপায়ের কথা বলা হয়েছে। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এই ব্যায়ামগুলো করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সিঙ্গেল লেগ স্ট্যান্স বা একক পায়ে অবস্থান
প্রথমে একটি চেয়ারের পিছনে সোজা হয়ে দাঁড়ান, দুই হাতে ধরে রাখুন চেয়ার। এবার মাটি থেকে এক পা ধীরে ধীরে উপরে তুলুন, বুক বরাবর ওঠাতে থাকুন পা। এভাবে অন্তত পাঁচ সেকেন্ড এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। উভয় পা দিয়ে একই কাজ টানা পাঁচবার করুন। সবশেষে চেয়ার থেকে দুহাত সরিয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করুন।
বডি-ওয়েট স্কোয়াট
পায়ের মাঝে দূরত্ব রেখে দাঁড়ান, পায়ের আঙ্গুলগুলো সামনের দিকে রাখুন। এরপর হাঁটু বাঁকাতে থাকুন যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার উরুগুলো মেঝে বরাবর সমান্তরাল হয়। শরীরের সমস্ত ওজন গোড়ালির ওপর দিন। শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে প্রয়োজনবোধে হাত দুটো সামনে প্রসারিত করুন বা খুব সহজ মনে হলে নীচের দিকে স্কোয়াট করুন। এভাবে ১০ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
বার্ড ডগ
পিঠ সোজা রেখে দুই হাত ও দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে শুরু করুন। এবার পিছন দিক থেকে এক পা সোজা করে উপরে তুলুন এবং তার বিপরীত হাতটি সোজা করে সামনে তুলুন, যাতে আপনি এক হাঁটু এবং এক হাতের ওপর শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেন। ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড এভাবে ধরে রাখুন। এরপর অপর হাঁটু এবং হাত দিয়ে একই ব্যায়ামের পুনরাবৃত্তি করুন।
ল্যাটালার লেগ লিফট
চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে চেয়ার ধরুন। এবার একপাশ থেকে এক পা তুলুন। এ সময় শরীরকে যতটা সম্ভব স্থির রাখার চেষ্টা করুন। অন্য পা দিয়েও একই ব্যায়ামের পুনরাবৃত্তি করুন। প্রতি পাশে অন্তত পাঁচ বার করতে হবে এটি। সম্ভব হলে পা লম্বা রেখে চেয়ার ছেড়ে দিন।
টেন্ডেম স্ট্যান্স
সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং এক পা সরাসরি অন্য পায়ের সামনে রাখুন। দু'পায়ে শরীরের ওজন সমানভাবে দিন। এরপর হাঁটু বাঁকাতে হবে সামান্য। এভাবে ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন, তিনবার পুনরাবৃত্তি করুন। এরপর অন্য পা দিয়ে একই কাজ করুন। সম্ভব হলে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিতে পারেন।
- সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস