বিশ্বের ক্ষুদ্রতম আঙুর বাগানের এক বোতল ওয়াইনের দাম ৫০০০ ডলার, কিন্তু পান করা নিষেধ!
তুল্লিও ম্যাসনি বিশ্বের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ওয়াইন প্রস্তুতকারীদের একজন, কিন্তু তিনি চান না মানুষ তার তৈরি ওয়াইন পান করুক! ইতালির এই সাবেক ব্যাংকার, শিল্প সংগ্রাহক ও খোশমেজাজি ব্যক্তিটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট আঙুর বাগানের মালিক। ইতালির রেজ্জিও এমিলিয়া শহরে ১৬ শতকের একটি প্রাসাদতুল্য ভবনের উপরে তার আঙুর বাগান। ম্যাসনির এই বাগানের পরিসর দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে এখানে তৈরি প্রতি বোতল ওয়াইনের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ টাকা!
রেজ্জিও এমিলিয়া শহর ইতালির ত্রিরঙা পতাকার জন্মস্থান হিসেবে বিখ্যাত। এছাড়াও, পারমা ও মোডেনার মাঝামাঝি অবস্থিত এ অঞ্চল থেকেই রপ্তানি হয় ফেরারি ও ল্যাম্বরঘিনির মতো দুনিয়াজোড়া বিখ্যাত গাড়িগুলো। আর এখানেই পাওয়া যাবে লাজানিয়া, তর্তেল্লিনি, প্রসুতো দি পারমা এবং রাগু আল্লা বোলোনিয়েজের মতো বিখ্যাত ইতালিয়ান খাবার।
কিন্তু তুল্লিও ম্যাসনির তৈরি ওয়াইন কেন প্রায়শই লোকের খাবার টেবিলে দেখা যায় না তা বুঝতে হলে তার এই পথচলার শুরু থেকে জানতে হবে। 'ভিয়া মারি ১০' ভবনের ছাদে ম্যাসনির আঙুর বাগান এবং তার উৎপাদিত ওয়াইনের নামও এটি। ভিয়া মারি ১০ ভবন একটি বিখ্যাত স্থান কারণ ১৮৫৯ সালে এখানে পায়ের ধূলো দিয়েছিলেন ইতালির বিপ্লবী নেতা জিউসেপ্পে গ্যারিবালদি।
"আমার বাবা একসময় ওয়াইন তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। রেজ্জিও এমিলিয়ার গ্রাম্য এলাকায় আমাদের বড় আঙুরের ক্ষেত ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম এই আঙুরের ক্ষেত থেকে আমি যতটা না আয় করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা ঢেলেছি এর পেছনে। তাই আমি সেটা বিক্রি করে দেই। যদিও ২০ বছর পর সেই সিদ্ধান্তের জন্য অনেক অনুশোচনা করতে হয়েছিল, তাই এই ছাদের উপরেই একটা পকেট-সাইজ আঙুরের বাগান গড়ে তুলি", সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন ম্যাসনি।
ভিয়া মারি ১০ ভবনের ছাদের মাত্র ২০০ বর্গফুটের আঙুর বাগান থেকে বছরে ২৯ বোতল রেড ওয়াইন তৈরি করতে পারেন ম্যাসনি; কিন্তু তার একেকটি বোতলের দাম প্রায় ৫০০০ ডলার! তার চেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, এই বোতলগুলো সাধারণ ওয়াইনের দোকানে নয়, বরং ভবনটি থেকে কয়েক ব্লক দূরের 'বোনিওনি আর্তে' নামক আর্ট গ্যালারিতে বিক্রি হয়!
আর্ট গ্যালারিতে ওয়াইন বিক্রির খবরে যদি আপনার ভ্রু কুঁচকে ওঠে কিংবা বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে যান, তাহলে এর কারণটা ম্যাসনির নিজের মুখ থেকেই জেনে নিন- "আমার তৈরি ওয়াইন একটা শৈল্পিকতার প্রকাশ, এক ধরনের দার্শনিক চিন্তার জন্ম দেয় এটি... আপনি আপনার লিভিং রুমে এক বোতল 'ভিয়া মারি ১০' রেখে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে যেন বলতে পারেন একটা পাগলা লোকের কথা, যে কিনা ছাদে আঙুর বাগান করে ওয়াইন তৈরি করছে!", বলেন ম্যাসনি।
নিজের শহুরে আঙুর বাগানকে তিনি ফরাসি শিল্পী মার্সেল ডুশাম্পের 'বাইসাইকেল হুইল'র সাথে তুলনা করেন। ডুশাম্প ১৯১২ সালে তার প্যারিসের স্টুডিওতে একটি সত্যিকার বাইসাইকেলের চাকাকে কাঠের টুলের উপর বসিয়ে দিয়ে এই শিল্পকর্মটি তৈরি করেন। এ ধরনের সাধারণ বস্তুকে শিল্পে রূপ দেওয়াকে ডুশাম্পের 'রেডিমেডস' নামক শিল্পকর্মের সিরিজ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
ম্যাসনি বলেন, "আপনি যদি নষ্ট জিনিস সারাইয়ের দোকানের বদলে লিভিং রুমে একটা বাইসাইকেলের চাকা দেখতে পান, তখন সেটাকে অনেক সুন্দর মনে হয়। আমার আঙুর বাগানও তেমনই, কারণ বাড়ির ছাদে এটুকু পরিসরে আঙুর বাগান তো অপ্রত্যাশিত ব্যাপার; এটা মাথার মধ্যে নতুন চিন্তা জাগ্রত করে।"
আঙুর বাগান ও শিল্পের মধ্যে সম্পর্ক!
তুল্লিও ম্যাসনির তৈরি ওয়াইন ও শিল্পের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়ার আগে শুরু করতে হবে আঙুরফল দিয়েই, কারণ ভবনের ছাদে জাফরিতে জন্মানো আঙুর গাছগুলো সত্যিকার অর্থেই স্থানীয় ভাস্কর অস্কার অ্যাকরসির হাতে তৈরি শিল্প। ম্যাসনির ভাষ্যে, "আমার গাছের আঙুর জন্মানোর সাথেসাথেই যেন শিল্পকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।"
তবে এখানেই শেষ নয়, ওক কাঠের যেই ব্যারেলের মধ্যে দীর্ঘদিন ওয়াইন রাখা হয়, সেই ব্যারেলগুলোও স্থানীয় আরেক ভাস্কর লরেঞ্জো মেনোজ্জির বানানো। এই ব্যারেলগুলো নারী ও পুরুষের প্রতিরূপ তুলে ধরে। এছাড়াও, রেজ্জিও এমিলিয়ায় জন্ম নেওয়া বিখ্যাত মার্ভেল কমিক বইয়ের শিল্পী জিউসেপ্পে কাম্যুকলিকেও কাজে লাগিয়েছেন ম্যাসনি। তার ওয়াইনের বোতলের বিশেষ একটি সংস্করণের লেবেলের নকশা করেছেন কাম্যুকলি। যেহেতু ম্যাসনির 'ভিয়া মারি ১০' ওয়াইনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিল্প জড়িয়ে, সে কারণেই তিনি বোতলগুলো খুলতে নিরুৎসাহিত করেন এবং এই শিল্প সংরক্ষণ করতে বলেন!
ম্যাসনি নিজেই স্বীকার করেন, "আমিই বিশ্বের একমাত্র ওয়াইন প্রস্তুতকারী যে কিনা মানুষকে বলে এই ওয়াইন পান না করতে!"
ম্যাসনির বাগানে মূলত সাঞ্জোভেইসা জাতের আঙুর জন্মানো হয়। শুধুমাত্র গতানুগতিক পদ্ধতিতে তৈরি করলেই ওয়াইন ভালো হবে, এমনটা বিশ্বাস করতে নারাজ ম্যাসনি। তিনি জানান, তার তৈরি ওয়াইনে কোনো 'লেদার' বা রেড বেরি নেই।
তবে ওয়াইন উৎপাদনের জগতে কিছু 'উন্নাসিকতা' তিনি বরদাশত করতে পারেন না এবং এগুলোর প্রতি নিজের বিতৃষ্ণাও লুকিয়ে রাখেন না; এই যেমন- ইতালির অধিকাংশ বিখ্যাত ওয়াইন উৎপাদনকারীই সম্ভ্রান্ত পরিবারের। সে তুলনায় ম্যাসনির ওয়াইনের দামটা অনেক বেশি চড়া, যদিও ওয়াইন বিক্রি থেকে নিজের আয় সম্পর্ক বিস্তারিত জানাননি তিনি।
ম্যাসনি শুধু জানান, তার উৎপাদিত বেশিরভাগ ওয়াইনই হয় কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়, আর নাহয় বোনিওনি গ্যালারিতে যায়। সেখানে অনেক বেশি পরিমাণে মদ যারা কেনেন, সেসব ক্রেতাকে উপহার হিসেবে 'ভিয়া মারি ১০' দেওয়া হয়। এদিকে তুল্লিও ম্যাসনির ওয়েবসাইট মারফত জানা যায়, তার সর্বশেষ ভিন্টেজ ওয়াইনের মাত্র ১০ বোতল স্টকে অবশিষ্ট আছে।
কিন্তু ম্যাসনির তৈরি ওয়াইন গ্লাসে ঢাললে দেখতে কেমন তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে অনেকেরই। এর বৈশিষ্ট্য ও স্বাদ সম্পর্কে তিনি বলেন, "প্রথম চুমুকে অনেকটা আবেশের মধ্যে চলে যাবেন, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই এর স্বাদ অন্য মাত্রায় চলে যাবে এবং মনকে অভিভূত করবে।"
"আমার তৈরি ওয়াইন প্রশান্তি আনে না, বরং এটা অসীম গতিতে মনের মধ্যে একের পর এক ভাবনাচিন্তার জগত খুলে দিচ্ছে বলে অনুভব হবে!" বলেন ম্যাসনি।
আর এক্ষেত্রে তুল্লিও ম্যাসনির কথা বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি!
সূত্র: সিএনএন