দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে বাংলায় যেভাবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভরাডুবি হয়
১৮৭৫ সালে লেখক জিসি ক্লার্ক ডি রয়স একটি ডাচ কলোনিয়াল জার্নালে লিখেছেন, ব্রিটিশ ও ফরাসিদের যখন বাংলায় রমরমা চলছে, ওই মুহূর্তে 'ডাচ [ইস্ট ইন্ডিয়া] কোম্পানি সেখানে সম্মান ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শক্তিও অর্জন করতে পারেনি'।
এই লেখায় ফ্রেঞ্চ ইন্ডিয়ার গভর্নর জেনারেল জোফেস মার্কুইস দুপ্লেই ও ব্রিটিশ গভর্নর রবার্ট ক্লাইভের নাম নেন রয়স।
তিনি লেখেন, ডাচরা হুগলিতে যে ক্ষমতা নষ্ট করেছে, তার অর্ধেকও ধরে রাখতে পারলে হিন্দুস্তানে তারা ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মতো পরাক্রমশালী হতে পারত।
১৮২৫ সালের পর ভারতবর্ষ থেকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলীন হয়ে গেলেও ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সফল ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। ব্রিটিশদের জন্য ভারতবর্ষ যেরকম সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস ছিল, ডাচদের জন্য ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জও ঠিক তা-ই হয়ে ওঠে।
বাংলায় ব্যবসা
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০৩ সালে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসে। বাংলা থেকে পোশাক, চিনি, সল্টপিটার (রাসায়নিক যৌগ পটাসিয়াম নাইট্রেট), আফিম ও ঘি সরবরাহ করা হতো। এ সবই ব্যবহৃত হতোসবই ডাচ আন্তঃ-এশিয়াটিক বাণিজ্যের জন্য। আর পোশাক যেত সরাসরি আমস্টারডামে।
১৬৯৭ থেক ১৭১৮ সালের মধ্যে আমস্টারডামের বিত্তবানরা নতুন ফ্যাশনের চল করে। এর ফলে বাংলার কাঁচা সিল্কের চাহিদা বাড়ে। আমস্টারডামে রপ্তানি হওয়া মোট কাঁচা সিল্কের ৮৩ শতাংশই যেত বাংলা থেকে।
বিভিন্ন লেখায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বাংলার তাৎপর্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ডাচ কবি অ্যান্টোনাইডস ভ্যান ডার গোয়েস ১৬৭১ সালে লিখেছেনম বাংলা ছিল সম্পদের সমুদ্র।
ডাচ চিকিৎসক উটার শুটেন ১৬৭৬ সালে হুগলি নদীর অনতিদূরে চিনসুরা নামক স্থানে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারখানার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন:
'হুগলিতে অবশ্য ডাচ লজের চেয়ে জমকালো আর কিছু নেই। লজটি বিশাল নদী গঙ্গা থেকে মাস্কেটের গুলি ছোড়া দূরত্বে চমৎকার একটি উঁচু চত্বরে অবস্থিত, যাতে পানিতে ভেসে না যায়। লজটি অনেকটাই মজবুত দুর্গের মতো দেখতে। এর দেয়াল ও বুরুজ সূক্ষ্ম পাথর দিয়ে নিপুণভাবে খোদাই করা...এছাড়া পাথরের গুদামও আছে, সেখানে রোজকার বিদেশি ও স্থানীয় পণ্য মজুত করা হয়।'
তাহলে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে ১৮২৫ সালের মধ্যে ডাচদের রমরমা অবস্থার ইতি টানতে পারল?
লুটপাটের বাণিজ্য
আমস্টারডামে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা বিদেশে কর্মরত কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু বাংলায় কর্মরত ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের সামনে ছিল উপার্জনের অবারিত সুযোগ।
বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা বাঙালি অভিজাতদের মতো আচরণ করতে শুরু করে।
বাংলায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়ার কর্মকর্তারা বাইরে ঘুরতে বেরোত পাল্কিতে চেপে। তাদের কবরগুলোও অলংকৃত করা হতো মোটা টাকা খরচ করে।
জ্যান অ্যালবার্ট সিখটারমান নামক এক ডাচ পরিচালক বাংলায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। বাংলা থেকে বিপুল অর্থ-সম্পদ নিয়ে ডাচ প্রজাতন্ত্রের গ্রোনিংজেনে যখন ফিরে আসেন, ততদিনে তার নাম হয়ে গেছে 'গ্রোনিংজেনের নাবব'।
হেন্ড্রিক ভ্যান শুইলেনবার্গের ১৬৬৫ সালের একটি চিত্রকর্মে দেখা যায়, ডাচ কোম্পানির পরিচালক পিটার স্টারথেমিয়াস একটি পাল্কিতে চেপে কাসিমবাজার থেকে হুগলি যাত্রা করেছেন। ছবিতে দেখা যায়, দুই ডাচ পাল্কিতে চেপে চলেছেন আর কয়েকজন ইউরোপীয় ঘোড়ায় চেপে তাদের পিছু পিছু চলেছে।
এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাচ্ছে একদল পদাতিক সৈন্য। বহরের সামনে থাকা এক ব্যক্তি এই রাজকীয় শোভাযাত্রার আগমনবার্তা জানানর শিঙা বাজাচ্ছে। আর এই শক্তি ও আড়ম্বর প্রদর্শন চেয়ে চেয়ে দেখছে গ্রামবাসীরা।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা ১৭ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত হুগলি থেকে কাসিমবাজারে যেতেন এরকম রাজকীয় কায়দায় বিশাল বহর নিয়ে, পাল্কিতে চেপে। কাসিমবাজারে একটি বিখ্যাত ডাচ কারখানা ছিল; সেখানে বস্ত্র কেনা হত।
ডাচ 'জমিদার'
ডাচ কর্মকর্তারা এত অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন কীভাবে? বাণিজ্যে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ ছিল তাদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের প্রধান উৎস।
অবৈধ ব্যবসার জন্য ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়। ১৬৮৪ সালে কোম্পানিটি তাদের কারখানাগুলো তদন্ত করার জন্য বাংলায় একটি কমিটি পাঠায়। ওই কমিটি বাংলায় এসে দেখে, কর্মকর্তারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে হাট মিলিয়ে অবৈধ পণ্যের ব্যবসা করছে।
কর্মকর্তাদের একটি ছোট দল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভেতরে 'স্মল কোম্পানি' নামে একটি ক্লাব গঠন করে অর্থ আত্মসাৎ করছিল। এই দলটি কোম্পানিকে ব্যবহার করে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য পণ্য কিনত। এভাবে তারা শুল্ক ফাঁকি দিত।
স্থানীয় দালালরা—দীপচাঁদ, কল্যাণ দাস ও জয় বিশ্বাস, যারা রামসেন নামেও পরিচিত—ডাচ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করেছিল। বাংলায় কর্মরত নিকোলাস শ্যাগেন নামের একজন ডাচ পরিচালকের বিরুদ্ধে বেআইনি ব্যবসার অভিযোগ ওঠে। আর তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্থানীয় বণিক ও চাকরদের সহায়তায় অবৈধভাবে রেশম ব্যবসার অভিযোগ আনা হয়।
বাংলায় অবৈধ বাণিজ্য এমনই তুঙ্গে ওঠে যে সুদূর আমস্টারডামে 'হেট সাকস্পিগেলটজে' নামে একটি বেনামী পুস্তিকা প্রকাশ করে বাংলায় কোম্পানির দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র তুলে ধরার হয়।
তবে শুধু অবৈধ ব্যবসাই ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার একমাত্র পথ ছিল না। ডাচরা চুঁচুড়া, বরাহনগর ও বাজার মির্জাপুর—এই তিনটি গ্রামের জমিদারি অধিগ্রহণ করে। ডাচ জমিদার ও কাছারির কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল গ্রামবাসীদের।
ওলন্দাজ জমিদাররা গ্রামবাসীদের পাট্টা বা জমি ভোগদখলের অধিকারপত্র দিত। গ্রামবাসীরা খাজনা পরিশোধ করে পাট্টা পেত। আর পাট্টার জন্য লাগত জমিদারের সীলমোহর ও স্বাক্ষর। কারও মৃত্যুর পর কোনো পরিবারের সঙ্গে জমিজমার অংশ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে জমিদার সেখানে হস্তক্ষেপ করতেন। তিনি বাড়ির পাট্টা দিয়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা বিক্রির ব্যবস্থা করতেন।
পাট্টা দেওয়ার জন্য কাছারি থেকে জমিদারের কর্মচারীরা বাড়ি পরিদর্শনে যেত এবং জিনিসপত্রের তালিকা তৈরি করত। বাড়ির মালিকানা প্রমাণের জন্য পাট্টা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই পাট্টা দেওয়ার ক্ষেত্রেই কিছু জমিদার দুর্নীতি আরম্ভ করে।
উইলেম ড্যাঙ্কেলম্যান নামে একজন ডাচ জমিদার তার মুৎসুদ্দি (জমিদারকে তার দায়িত্ব পালনে যে কর্মচারী সহয়তা করত) পার্বতী চরণ রায়ের সঙ্গে মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। তারা পাট্টা আটকে রেখে বাড়ি বা সম্পত্তি বিক্রি করে দিতেন।
নথিপত্র ঘেঁটে এরকম কয়েকটি ঘটনার কথা জানা যায়। একবার ভবানী নামে এক বিধবা স্থানীয় কাছারির মাধ্যমে দুটি বাড়ি বিক্রি করেন, কিন্তু বাড়ি বিক্রির টাকা কখনোই পাননি বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি।
বরাহনগরের শশীদাস বৈরাগী নামে এক ব্যক্তি জমি বিক্রির জন্য একবার মুৎসুদ্দি পার্বতী চরণ রায়ের কাছে যান। পার্বতী চরণ তার কাছ থেকে জমির পাট্টা চেয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
ওলন্দাজ জমিদাররা নানা উপায়ে ধন-সম্পদ জামিয়েছিলেন, কখনও স্বতন্ত্র কর্মকর্তা হিসেবে, কখনও স্থানীয় বণিক ও প্রশাসকদের সহায়তায়।
কর্মকর্তারা বাংলায় সম্পদ পুঞ্জীভূত করার সঙ্গে সঙ্গে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমস্টারডামে ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।
'হারানো গৌরব'
ডাচ বাংলার শেষ বাসিন্দা ড্যানিয়েল অ্যান্থনি ওভারবেক ১৮২৪ সালে আফসোস করে বলেছিলেন, কলকাতার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে চুঁচুড়া তার গৌরব হারিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, চুঁচুড়া থেকে দলে দলে মানুষ কলকাতায় চলে আসছিল।
১৭৬৫ সালের পর ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর আদায়ের জন্য দিওয়ানি অধিকার লাভ করে এবং ভারতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অচিরেই অ্যাংলো-ডাচ সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে এবং কলকাতায় ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার বন্দরের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বন্দর হিসেবে চুঁচুড়ার গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ১৭৮১ সালে ইংরেজরা বাংলাসহ ভারতের সমস্ত ডাচ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়।
১৭৮৪ সালের শেষের দিকে চুঁচুড়া ও অন্যান্য গ্রামের শাসন কিছুকালের জন্য ফের ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ফিরে যায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি ফের খারাপের দিকে চলে যায়। ১৭৮৫ থেকে ১৭৯২ সাল পর্যন্ত বাংলার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা আইজ্যাক টিটসিং চুঁচুড়াকে 'অ্যাডার সাপের আস্তানা' বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বাংলায় নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন:
'এখানে আসার পর থেকে আমি আনন্দে সময় কাটিয়েছি খুব কমই। অনেক মানুষ যে প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছে, তা-ও আমার পছন্দ হয়নি। এখানে ভালো সঙ্গ পাই না বললেই চলে, প্রতিদিনই একই লোকের সঙ্গে দেখা হয়। এই মানুষগুলো মনের মধ্যে বহু বছরের পুরোনো ঘৃণা ও ঈর্ষা ঘৃণা পুষে রাখে।'
বাংলায় ডাচদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন টিটসিং, তারপরও ১৭৯৫ সালে ডাচ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো ফের ইংরেজদের দখলে চলে যায়। ১৭৯৯ সালের পর দেউলিয়া হয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮১৭ সালে চুঁচুড়া ডাচ ঔপনিবেশিক সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলেও এলাকাটি বেশিদিন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি।
১৮২৫ সালের মধ্যে বাংলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে ডাচরা। অল্প কয়েকজন ডাচ শুধু বাংলায় থেকে যায়। মৃত্যুর পর তাদের চুঁচুড়ার ডাচ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
সূত্র: স্ক্রল ডটইন