সোলার সেচ ব্যবস্থা জনপ্রিয় হচ্ছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আল মামুন গত বছর জেলার নাচোল উপজেলায় একটি চাষাবাদ প্রকল্প হাতে নেন। পাঁচ বিঘা প্রকল্পটিতে একটি তিন বিঘা আমের বাগান ও দুই বিঘা মাছের খামার ছিল।
প্রকল্পটি বর্ষাকালে শুরু করার কারণে গাছপালা ও পুকুরে পানি দিতে মামুনকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। এরইমধ্যে তিনি গ্রিড সংযোগের জন্য স্থানীয় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি বিআরইবি-তে (বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) আবেদন করেন। কিন্তু বিআরইবির কর্মকর্তারা মামুনকে জানান, প্রতিষ্ঠানটি নতুন সংযোগ দিচ্ছে না।
এ খবরে মামুনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বর্ষা শেষে পানির অভাবে তার বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে যাবে বলে গ্রিড সংযোগের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
গ্রিড সংযোগ না পেয়ে মামুন বিদ্যুতের বিকল্প উৎসের কথা ভাবতে শুরু করেন। কিছুদিন খোঁজখবর নেওয়ার পরে তিনি সিদ্ধান্ত এলেন, ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় একটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কিনতে পারেন, অথবা বোরিংয়ের খরচসহ ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সোলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপন করতে পারেন। বোরিং হলো নলকূপ খনন। এটি সেচ পাম্প স্থাপনের প্রথম ধাপ।
মামুন দ্বিতীয় পথ বেছে নিলেন। যদিও প্রাথমিক খরচ প্রায় দ্বিগুণ ছিল।
মামুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা ডিজেল ইঞ্জিন চালাতে দৈনিক প্রায় ৭০০ টাকা খরচ হবে আমার। তাই আমি সোলার সিস্টেম বেছে নিলাম, কারণ এতে জীবাশ্ম জ্বালানি লাগে না।' সর্বশেষ জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের পর খরচ এখন ১ হাজার ৯০ টাকায় পৌঁছাবে। দুই বিঘা আয়তনের পুকুরটি দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ায় ঘন ঘন পানি দিতে হয়। বাগানেও পানি দিতে হয় নিয়মিত।
মামুন পার্শ্ববর্তী উপজেলার আরও কয়েকটি সৌর সেচ প্রকল্পের কথা জানালেন। তিনি বলেন, এ বছর খরার মতোই পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সোলার পাম্পগুলো দারুণ কাজে আসছে। সরকারি সংস্থা-চালিত অনেকগুলো সোলার পাম্প রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো পড়ে ছিল বলেও জানান তিনি।
মামুন তার সোলার সিস্টেম কিনেছেন ঢাকার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রুরাল সান পাওয়ার থেকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে সোলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপন করছে। রুরাল সান পাওয়ার এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৩৪২টি পাম্প বসিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নাজমুল হাসান জানালেন, তাদের যাত্রা খুব মসৃণ ছিল না।
নাজমুল বলেন, 'ওই সময় সোলার পাম্প সম্পর্কে মানুষের বলতে গেলে কোনো ধারণাই ছিল না। এসব পণ্যের দামও অনেক বেশি ছিল।'
গড়ে তাদের সিস্টেমে ৩ থেকে ৭ কেডব্লিউপি-র সোলার প্যানেল থাকে। তবে এখন সোলার প্যানেলগুলোর ক্ষমতা বাড়ছে।
নাজমুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'আমরা এখন একটা ১৫ এইচপি সোলার পাম্প প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। একটা সময় ছিল যখন সোলার সেচ ব্যবস্থার জন্য সাড়ে ১৩ লাখ টাকা খরচ করবেন, এমন উদ্যোক্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু এখন মানুষ প্রকৃত অর্থেই সোলার পাম্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।'
সর্বশেষ ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং নিয়মিত লোডশেডিং ফিরে আসার ফলে সোলার সেচ ব্যবস্থার চাহিদা বেড়েছে কি না জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রাতারাতি বাজার বদলে যাওয়ার আশা করা যায় না। কেননা বেশিরভাগ কৃষকেরই একটি সোলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক বিনিয়োগ বহনের সামর্থ্য নেই। তবে আজকাল অনেকেই তার অফিসে ফোন করে সোলার সেচ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইছে বলে জানালেন নাজমুল।
নাজমুল জানালেন, অর্থায়নই মূল সমস্যা। গত বছর রুরাল সান পাওয়ার ৫০ শতাংশ বাকিতে সোলার পাম্প বিক্রি করেছে। এতে বিক্রি অনেক বেড়েছে। তবে ক্রেতারা নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় এই সুযোগটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একটি খরচের তুলনা থেকে দেখা যায়, দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে সোলার সেচ ব্যবস্থা গ্রিড বিদ্যুতের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে।
গ্রাহকের ক্যাটাগরি ও স্ল্যাবের ভিত্তিতে একজন গ্রিড বিদ্যুতের গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ১২ টাকা (বা বিশেষ ক্ষেত্রে তার বেশি) দিতে হয়, কিন্তু কৃষি পাম্প ব্যবহারকারীদের সবাই-ই প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য সমহারে ৪.১৬ টাকা দেন।
মামুনের সেচ ব্যবস্থার আরেকটি খরচ বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সোলার প্যানেলে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতে খরচ পড়ে প্রায় ৪ টাকা। এই হিসাবে প্রকল্পের জীবনকাল ১০ বছর ধরে নেওয়া হয়, আর বিক্রেতারা সোলার প্যানেলের জন্য ২৫ বছরের ওয়ারেন্টি দেয়।
এই হিসাবের মধ্যে সোলার প্যানেল উত্তোলন ও ধরে রাখার জন্য নির্মিত কাঠামোও অন্তর্ভুক্ত। তবে গ্রিড কানেক্টেড সিস্টেমে সাধারণত যে পাম্প, ক্যাবল, পানির পাইপ ও বোরিং থাকে, তার খরচ এ হিসাবে আনা হয়নি। অবশ্য আল মামুনের সোলার পাম্প অর্ধেকের বেশি সময়ই বন্ধ থাকে। এসব ক্ষেত্রে ইউনিট খরচ কয়েকগুণ বেশি হবে।
কিন্তু এসব সোলার সিস্টেমের গ্রিড সমন্বয় করা হলে পাম্প যখন অলস বসে থাকে, ওই সময় মালিকরা কিছু বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পেতেন। এতে খরচ আরও দ্রুত ওঠানো যেত। এছাড়া এখানে আরেকটা ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, গ্রিডের বিদ্যুতে সরকার মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দেয়, যার ফলে গ্রিডের বিদ্যুতের দাম কমে আসে।
এর ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সোলার পাম্পগুলো একদিক থেকে ব্যয়বহুল। কিন্তু যেসব কৃষ গ্রিড সংযোগ নিতে পারেন না, তাদের জন্য সোলার পাম্পই সেরা বিকল্প। কৃষকরা বলছেন, আজকাল নতুন সংযোগ পাওয়া কঠিন। তার সঙ্গে ঘন ঘন লোডশেডিং আরেক মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে।
তবু এ ধরনের একটি সিস্টেমের জন্য যে বড় অঙ্কের প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটিই সোলার সেচ ব্যবস্থার দ্রুত বিকাশের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে গেছে।
গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে মাঝারি থেকে বৃহৎ আকারের নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের উন্নয়নে অর্থায়ন ও তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) বৃহৎ সোলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনে অর্থায়ন করে আসছে।
৩৫ শতাংশ ঋণের বাইরেও ইডকল সোলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য ৫০ শতাংশ অনুদান দেয়।
২০১২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুফি ইকবাল আহমেদ, তার ছেলে তৌফিক সুফি ও একদল জলবায়ু উৎসাহী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন জলবায়ু স্টার্টআপ সোলারগাও লিমিটেড। স্টার্টআপটি উত্তরবঙ্গের ৫৭০টি পৃথক সাইটে ৭৫০-র বেশি সোলার সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যা বছরজুড়ে ২৩ হাজারের বেশি কৃষককে সেচ ও কৃষি পরিষেবা প্রদান করে।
প্রতিষ্ঠানটি একাধারে গাজী রিনিউয়েবল এনার্জি লিমিটেড, ব্লু মেরিন এনার্জি লিমিটেড ইত্যাদির মতো স্বনামধন্য কোম্পানির জন্য ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার এবং নিজেদের সোলার সেচ, মিনি-গ্রিড ও ন্যানো-গ্রিড প্রকল্পগুলোর জন্য ইডকল স্পনসর হিসেবে কাজ করে।
সোলারগাওয়ের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা তৌফিক সুফি সোলার সেচ ব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে দারুণ আশাবাদী।
তৌফিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক ইস্যুগুলোর কথা ভাবলে বর্তমান জ্বালানি সংকট অপ্রত্যাশিত নয়। কাজেই বাংলাদেশের কৃষি খাতকে বিশ্বব্যাপী ডিজেল ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির দামের প্রভাব ও প্রাপ্যতা থেকে মুক্ত রাখতে একটি জাতীয় সোলার সেচ নীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় গ্রিডের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সেচের জন্য ব্যবহার করে। এতে পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পের ওপর প্রভাব পড়ছে। তাই জাতীয় গ্রিডের এই লোকসান কাটাতে পর্যাপ্ত সোলার সিস্টেম স্থাপন করাটা বিচক্ষণ কাজ হবে। সোলার পাম্প স্থাপন করা সহজ এবং এর সুবিধা আজীবন ভোগ করা যায়।
তৌফিক বলেন, ভর্তুকি বাড়ালে সোলার সেচ ব্যবস্থার বিকাশ আরও সহজ হবে।
তিনি বলেন, 'ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যই সোলার সেচ ব্যবস্থায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়। এতে ভারতে তৃণমূল পর্যায়ে একটা বিশাল বিপ্লব তৈরি হয়েছে। ভারতে কৃষকরা গত ১০ বছরে ৩ লাখের বেশি সোলার পাম্প স্থাপন করতে পেরেছেন। আর এই পাম্পগুলোর বেশিরভাগই গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত, যার ফলে অনেক গিগাওয়াট (গিডব্লিউ) বিদ্যুৎ কেবল সোলার সেচ থেকেই পাওয়া যায়।'
বাংলাদেশের সোলার সেচ ব্যবস্থা গ্রিডের সঙ্গে সমন্বিত করা হয়নি। ফলে স্থাপন করা সোলারের সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই নষ্ট হয়।
দেশের বিদ্যমান নেট মিটারিং নীতির আওতায় নবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলো বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারে। কিন্তু বর্তমান নীতিতে সিস্টেমের সক্ষমতা ১০ কেডব্লিউপি-র বেশি হতে হয়, যা বেসরকারিভাবে অর্থায়নকৃত সিস্টেমের চেয়ে বেশি।
এর আগে টিবিএস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে কর্মকর্তারা বলেছিলেন, অস্থিতিশীলতার সমস্যা এড়াতে সরকার গ্রিডের সঙ্গে ছোট সোলার সিস্টেমের সমন্বয় করতে আগ্রহী নয়।
কিন্তু ইডকলের অর্থায়ন করা বেশিরভাগ প্রকল্পই ১০ কেডব্লিউপির বেশি হয়ে থাকে। তারপরও ওই প্রকল্পগুলোকে গ্রিডে সংযুক্ত করা হয় না।
২০১৮ সালে ইডকল ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার সোলার পাম্প স্থাপন করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে। ডিজেলচালিত পাম্পগুলোকে প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি এই ৫০ হাজার সিস্টেমকে একীভূত করা হলে জাতীয় গ্রিডে ২ দশমিক ৫ গিডব্লিউপি পর্যন্ত বিদ্যুৎ যোগ করা যেত।
পরে ইডকল লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ২০২৭ সালের মধ্যে ১০ হাজার পাম্প স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৫১৫টি পাম্প বসাতে পেরেছে।
লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন ও সোলার সেচ ব্যবস্থার গ্রিড সমন্বয়করণ সম্পর্কে কথা বলতে টিবিএসের পক্ষ থেকে ইডকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ টিবিএসের প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হয়নি।