দুই চাকার কারিগর: যার যেমন বাইসাইকেল গড়ে দেওয়ার গল্প!
মনে আছে সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' উপন্যাসের শুরুর অংশের কথা? সেখানে কী অসাধারণভাবেই না ফেলুদা ব্যাখ্যা করেছিল জিওমেট্রির ব্যাপারটা! চোখের মণি থেকে শুরু করে আকাশের চাঁদ-তারা-সূর্য, কিংবা এমনকি মানুষের মন, ফেলুদার মতে "সমস্ত জীবনটাই জিওমেট্রি"। তাই হ্যান্ডমেইড বাইসাইকেল তৈরির ইউরেকা মোমেন্টেও যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকবে সেই জিওমেট্রিরই, তাতে আর আশ্চর্য কী!
"২০১১ সালের দিকে আমার অনেকদিনের সঙ্গী বাইসাইকেলটা চুরি হয়ে যায়। নতুন কিনতে গিয়ে বুঝতে পারি বাজারে আসলে সবার সাইজের বাইসাইকেল পাওয়া যায় না। সাইকেলে জিওমেট্রি একটা বড় ব্যাপার," এভাবেই বাইসাইকেলের সঙ্গে জিওমেট্রির যোগসাজশটা প্রথম উপলব্ধি করেন মো. আবু নোমান সৈকত। দেশীয় হ্যান্ডমেইড বাইসাইকেল তৈরির প্রতিষ্ঠান 'বাইকস্মিথ'-এর উদ্যোক্তা তিনি।
"নিজেদের জুতার সাইজ, পোশাকের সাইজের মতো বাইসাইকেলেরও নির্দিষ্ট সাইজ মেন্টেইন করা গুরুত্বপূর্ণ। নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হয় নাহলে। তখনই নিজে কাস্টমাইজ বাইসাইকেল বানানোর তাগিদ অনুভব করি," নোমান বলেন।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র নোমানের স্বপ্ন ছিল চারুকলা বা স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ার। বাবা-মায়ের অনিচ্ছায় যা পূরণ হয়নি। ঢাকা পলিটেকনিক থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চার বছরের ডিপ্লোমা শেষে ভর্তি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অভ এশিয়া প্যাসিফিকে। কিন্তু, ২০১৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে শিক্ষাজীবন বাদ দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। বন্ধুর সাহায্যে ৩ লাখ টাকা মূলধনে যাত্রা শুরু হলেও এখন বাইকস্মিথের মোট মূলধন ৩০ লাখে দাঁড়িয়েছে- নোমানের সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই।
"৮০-৯০ দশকের আর দশটা মানুষের মতো সাইকেলের প্রতি আলাদা টান ছিল আমারও। নিজের শিল্পীসত্তার কারণেও সাইকেল বানানোর প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল নিজে যেটা পারি তা নিজেই বানাবো না কেন! খুব সহজ ভেবে কাজটা শুরু করলেও আদতে সাইকেল বানানোটা সহজ নয় বুঝতে পেরেছিলাম কিছুদিন পরই," বলেন নোমান।
বাইসাইকেল মেরামত ও নানান পার্টস বিক্রি করে শুরু করলেও এখন গ্রাহকের পছন্দমতো পুরো বাইসাইকেল তৈরির কাজ করে বাইকস্মিথ। মোহাম্মাদপুরের কারখানায় নোমানের সাথে কাজ করেন আরো ৫ জন কর্মী।
নোমানের ভাষ্যে, "আমাদের দেশের সব বাইসাইকেল আসলে ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ডে তৈরি। তাদের সঙ্গে তো আমাদের বডি মেজারমেন্ট মিলবে না। ইউরোপীয়ানদের যেরকম ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় — লার্জ, এক্সেল, মিডিয়াম বা স্মল — আমাদের কিন্তু ওভাবে ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক মিক্সড হওয়ার কারণে একেকজন একেক রকম দেখতে, ফিজিক্যাল সাইজ একেক রকম। সেই কারণে বডির অনেকগুলো অংশের মাপ নিয়ে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী সাইকেল বানাই আমরা।"
নির্দিষ্ট ব্যক্তির শারীরিক গড়ন ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী- সাইকেলের ফ্রেমের সাইজ, হ্যান্ডেলবারের দূরত্ব, সিট বা স্যাডলের আকার-আকৃতি, ক্র্যাংক আর্মের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি কাস্টমাইজ করে বাইসাইকেল বানানো হয় বাইকস্মিথে। তাছাড়া সাইকেল ব্যবহারের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয় চাকার সাইজ ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের ধরন।
শরীরের আকার-আকৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সাইকেল দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে পিঠ-কোমর আর ঘাড় ব্যথার মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ হতে পারে যেকোনো মানুষের। "এমন অনেক কাস্টমার আমার কাছে আসে, যাদের ডাক্তার বলেই দিয়েছে দুই চাকার কোনো যানবাহন আর তারা চালাতে পারবে না। এর কারণ হলো- ভুল সাইজের সেই দুই চাকার যান। শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট মনে হলেও আদতে এতটা গোবেচারা না বাইসাইকেল। ভুল সাইজের সাইকেল যারা চালায় তাদের ক্ষতি হবেই," জানান নোমান।
বাইকস্মিথের বানানো প্রতিটি বাইসাইকেলই অনন্য। হ্যান্ডমেইড হওয়ায় একসাথে অনেকগুলো সাইকেল বানানো যায় না। নোমানের মতে, তার গ্রাহকেরা সগর্বে দাবি করতে পারেন, তার জন্য বানানো সাইকেলটি পৃথিবীতে আর কারো কাছে নেই।
কাস্টমাইজড বাইসাইকেল বানানোর পুরো প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করে নোমান বলেন, "প্রথমে কাস্টমারের বডি মেজারমেন্ট নিই আমরা। এক্ষেত্রে নাভির থেকে নিচের অংশ, নাভির থেকে উপরের অংশ আলাদা করে মাপি। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর দুই পা যেখান থেকে শুরু হয়েছে- সেখান থেকে মাটি পর্যন্ত দূরত্ব, হাত কেমন লম্বা, কাঁধ কেমন চওড়া, সেই স্পেসিফিক কাস্টমারের রাইডিং স্টাইল কেমন তা নোট করি। কেউ রাফ চালাতে পছন্দ করে, কেউ রিল্যাক্স মুডে চালাতে পছন্দ করে, কেউ অনেক লম্বা সময়ের জন্য চালাবে, কেউবা কাছাকাছি চালাবে, কেউ শুধু কমিউট করবে, কেউ আবার মালবহন করবে। একেকজন একেক পারপাসে বাইসাইকেল ব্যবহার করবে। ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুযায়ী, যথাযথ বাইসাইকেলটা সিলেক্ট করে দেই আমরা। এরপর কাস্টমার সম্মতি দিলে সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করি।"
কম্পিউটারে বাইসাইকেলের ডিজাইন, ড্রয়িং থেকে শুরু করে সাইকেলের পার্টসের ওয়েল্ডিং, রঙ করা, জোড়া লাগানো সব কাজেই সরাসরি যুক্ত থাকেন নোমান। সাইকেলের রঙ আর ডিজাইনেও থাকে গ্রাহকের চাহিদার প্রতিফলন।
একটি সাইকেল বানানোর পুরো প্রসেসে বাইকস্মিথের কারখানায় সময় লাগে এক সপ্তাহের মতো। তবে গ্রাহককে সাধারণত ২৫-৩০ দিন সময় হাতে নিয়ে কাস্টমাইজড বাইসাইকেলের অর্ডার করতে হয়। সীমিত জনবলে আগের অর্ডারের চাপ সামলিয়ে নতুন কাজ শুরু করতে হয় নোমানকে।
সাইকেলের ফ্রেমের জন্য টেকসই আর হালকা উপকরণ খুঁজতে গিয়ে সোনালী আঁশ পাট ব্যবহার করে দেশ-বিদেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন নোমান। পাটের কাপড়ের সাথে রেজিনের আঠা মিশিয়ে তৈরি করেছেন শক্ত পাইপ, যা দিয়ে সাইকেলের ফ্রেমসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ বানিয়েছেন তিনি। কিন্তু, দেশে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের অভাবে আট বছর ধরে ধীরে ধীরে আগাতে হয়েছে এই উদ্ভাবন নিয়ে। এই লম্বা সময় ধরে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের টাকা আর সরকারি কিছু সাহায্য দিয়ে শেষপর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করতে পেরেছেন পাটের বাইসাইকেল।
দেশীয় কাঁচামালে তৈরি, পরিবেশবান্ধব এই সাইকেল ৭৫% থেকে ৮০% পর্যন্ত বায়োডিগ্রেডেবল। ৬০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত টেকসইযোগ্য এই সাইকেলের দাম শুরু হবে ১৭ হাজার টাকা থেকে।
সাধারণত সাইকেলের ধরণভেদে দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে বলে জানান নোমান। বাইকস্মিথে এপর্যন্ত বানানো কাস্টমাইজড বাইসাইকেলের দাম সর্বনিম্ন সাড়ে ১২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজ করার সুবিধা ছাড়াও সাইকেল বিক্রির পর আজীবন 'আফটার সেলস সার্ভিস' দিয়ে থাকে বাইকস্মিথ। নোমান বলেন, "সাইকেল বানানোর সময়ই কিছু এক্সট্রা পার্টস আমাদের কাছে রাখি, যেন পরবর্তীতে সেই সাইকেলে কোনো সমস্যা হলে আমরা সাপোর্ট দিতে পারি। সাইকেলের ফ্রেমে মিনিমাম ১০ বছর থেকে ম্যাক্সিমাম লাইফ টাইম গ্যারান্টিও দেই আমরা।"
মূল কাঠামোর বাইরে সাইকেলের নানা খুটিনাটি যন্ত্রাংশ দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় নোমানকে। এই নির্ভরতা কমাতে বাইসাইকেলের ডিস্ক রোটর, ক্যাসেট, রিম ও সিটসহ নানা যন্ত্রাংশ নিজস্ব কারখানায় তৈরির পরিকল্পনা করছেন তিনি।
নোমান সৈকতের মতে, ব্যবসা দুইভাবে করা যায়। একটি হচ্ছে, গ্রাহকের যা চাহিদা সেটিই তাকে দেওয়া; আরেকটি হলো- নিজেই গ্রাহকের মধ্যে নতুন পণ্যের চাহিদা তৈরি করা। দ্বিতীয়টাই করতে চেয়েছেন নোমান। বাইকস্মিথের ৯ বছরের পথচলায় দেশের গ্রাহকদের মাঝে কাস্টমাইজড বাইসাইকেলের চাহিদা তৈরি করতে পারাকে নিজের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করেন তিনি।
কাজের জগৎ নিয়ে খানিকটা ক্ষোভও প্রকাশ করেন নোমান। কিছুটা হতাশার সুরেই বলেন, "আমার পুরো ক্যারিয়ারে এমন অনেক কাস্টমার পেয়েছি- যারা নিজেদের সাইকেলে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' কথাটা লিখতে চায় না। দেশীয় ব্র্যান্ডকে প্রমোট করতে চায় না। এটা খুবই খারাপ লাগার। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে আমি নিজের জায়গায় অনড় থাকি। যারা বাংলাদেশ বা দেশীয় ব্র্যান্ডের পরিচয় দিতে চায় না- তাদের সাথে কাজ করার আগ্রহও থাকে না আমার।"
ফেসবুকের মাধ্যমে সারাদেশের সাইকেলপ্রেমী মানুষের কাছেই তার পণ্যের পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছেন এই সাইকেল কারিগর। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডসেও পৌঁছে গেছে নোমানের হাতে বানানো বাইসাইকেল।
বর্তমানে ইউরোপের বাজারে সাইকেল রপ্তানিতে বৈশ্বিকভাবে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। আর পুরো বিশ্ববাজারে রপ্তান্তির ক্ষেত্রে এই অবস্থান অষ্টম। তবে সাইকেল তৈরির নানা যন্ত্রাংশের জন্য চীন, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকার মতো দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল আমরা। ফলে এখানে সাইকেলের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি।
বাইসাইকেল তৈরিতে এই আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই সাইকেলের জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রাংশ তৈরী করতে চান নোমান। স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যান্ডমেইড বাইসাইকেল নির্মাতা দেশ হয় সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। নিজের এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে কমনজেন্ডারদের জন্য কর্মক্ষেত্র তৈরি করার স্বপ্নও দেখেন এই সাইকেল কারিগর।