অ্যান্টার্কটিকার ভূত আমাদের তাড়া করে বেড়াবে পৃথিবীর সমাপ্তি পর্যন্ত
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।
জাহাজের নাম 'হোপ'। তিমি মাছ ধরার বিশালাকার জাহাজ। ১৮৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। চিলির কেইপ হর্ন নামে এক পাথুরে অন্তরীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল 'হোপ'। পাশ কাটাতে না কাটাতেই এক বিধ্বংসী ঝড় এসে জাহাজটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক বরফের সাগরে। রাত বাড়তেই জাহাজটির চারদিকে তৈরি হলো বরফের বড় বড় কেল্লা!
পরদিন ভোরবেলা। নিষ্ঠুর বাতাস তখন দমে গেছে। এবার সর্বনাশা ঝড়ের ধ্বংসলীলা হিসেবনিকেশ করার পালা। দেখা গেল দৈবক্রমে 'হোপ' তখনও টিকে আছে! গতরাতে কেল্লার মতো যে বরফখণ্ডগুলো ছিল সেগুলো আর একই রূপে নেই। পরিণত হয়েছে বরফের বিচ্ছিন্ন টুকরোয়।
হঠাৎ জাহাজটির মাস্তুলের উপরি-কক্ষ থেকে একটা আওয়াজ শোনা গেল। আইসবার্গের গা ঘেঁষে আরেকটা জাহাজ দেখতে পেয়েছে হোপের এক নাবিক। স্পাইগ্লাসের ভেতর দিয়ে মনে হচ্ছিল বরফ যেন জাহাজটিকে আক্রমণ করেছে। 'হোপ' খুব সাবধানতার সাথে সেদিকে এগুলো। জাহাজটিকে প্রাথমিকভাবে পরিত্যক্ত মনে হচ্ছিল। হোপের ক্যাপ্টেইন ব্রাইটন একটা বোটে করে তিন জন নাবিক নিয়ে জাহাজটির দিকে গেলেন।
তারা হিমশৈলে ঘেরা জাহাজটির পেছন দিক দিয়ে যেতেই দেখলেন জাহাজটির গায়ে এর নাম লেখা: 'জেনি'। জাহাজে উঠে নিচের তলায় নামার আগে জোরে চিৎকার করলেন তারা, জীবিত কেউ আছে কিনা পরখ করতে। কোনো সাড়া না পেয়ে তারা নিচের ডেকে নামতে লাগলেন।
কেবিনে পা দিতেই সবাই চমকে উঠলেন। একজন পুরুষের লাশ! ঠান্ডায় জমে একেবারে শক্ত। লাশটা কিন্তু শায়িত নয়, চেয়ারে বসা। এক হাত টেবিলে। আর হাতের ওই কালো জমে যাওয়া আঙুলের ফাঁকে একটা কলম এখনও ধরে আছে। সামনে পড়ে ছিল একটা লগবুক যেটাতে 'জেনি'র শেষ দিনগুলোর বর্ণনা লেখা।
লগবুক থেকে জানা গেল, একদিন আগে 'হোপ' যে বিপদ কাটিয়ে এসেছিল ঠিক সে করুণ বিপদে পড়েছিল 'জেনি'। জাহাজটি ১৮২২ সালের নভেম্বর মাসে বরফের ফাঁদে আটকা পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও বরফের পাহাড় ভাঙতে পারেনি জাহাজটি। ক্যাপ্টেইন ৭২ দিন ধরে কেবিনের আগুন জ্বালিয়েছি রাখতে পেরেছিলেন। ৭৩তম দিনে আগুন নিভে গেল।
এবার ফেরা যাক বাস্তবতায়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের একদিন। সিডনির হার্বার ব্রিজ দাবানলের ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা। এই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলাম আমি। চারদিকের ছাই, ভস্ম, উত্তাপ, অসুস্থতা যে নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে দানা বেঁধে বসছিল তা বেশ ভালোই টের পাচ্ছিলাম। এখন যতবার কাশি হয়, শহর ছেয়ে যাওয়া সেই কালো ধোঁয়া বুকের ভেতর ততবার অনুভব করি।
ইন্টারনেট দুনিয়ের ঘুরে বেড়ানো একটা মিমের কথা আজকাল মাথা থেকে যাচ্ছেই না। মিমটা হচ্ছে এরকম: একটা এনিমেটেড কুকুর ঘরের ভেতর একা বসে আছে। তার চারদিকে জ্বলন্ত আগুন গ্রাস করে ফেলছে সবকিছু। সমগ্র রুম জুড়ে ধোঁয়া। বাড়তে থাকা আগুন এক্ষুনি তাকেও গ্রাস করে ফেলবে। তবুও সে পরমানন্দে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলে 'সব ঠিকঠাক।' তার জীবন শেষ হতে চলেছে তবুও তার মাঝে বাঁচার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা নেই।
এর দুই বছর পরে যাওয়া যাক। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে একটা শ্যাওলামুক্ত পাথরের ওপর বসে আরাম করছিলাম। পৃথিবীর শেষ প্রান্ত বলতে অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার ক্যাসি স্টেশনের কয়েক কিলোমিটার পূর্বে। এর কিছুদূর থেকে অ্যাডেলি পেঙ্গুইনের কোঁকোঁ শব্দ বেশ ভালোভাবেই কানে আসছিল। মাঝে মাঝে তাদের জলকেলির আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিলাম। বাতাসের সাথে ভেসে আসা তাদের বিষ্ঠার বাজে গন্ধে নাক ভারী হয়ে যাবার অবস্থা।
কিছু সময়ের ব্যবধানে পেঙ্গুইন দলের হাঁটার শব্দ একটা ছন্দে পরিণত হলো। টিপ টিপ জল পড়ে যেরকম ছন্দের সৃষ্টি করে, ঠিক সেরকম। নিউকম উপসাগর থেকে কয়েক মিটার দূরে বসে যেন শুনতে পাচ্ছিলাম আমাদের মহাদেশটা মহাসাগরে ডুবে যাচ্ছে। অদ্ভুত কিছু নয়। পরবর্তীতে স্টেশনের এক সদস্যের কাছ থেকে জানতে পারলাম অ্যান্টার্কটিকার গ্রীষ্মকালে এটা রীতিমত একটা নিয়মিত শব্দ। বসে একটু ভালোভাবে কান পেতে শুনলেই বরফ গলার শব্দ যে কেউ টের পাবে। একটু সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেই নজরে আসবে সূর্যের তাপে তুষারের চাদর গলে পাথুরে পাহাড় উঁকি মারছে। যা দেখছি, যা শুনছি তা জলবায়ু পরিবর্তন নয় তো?
কিছু জায়গা বাদে ক্যাসির অন্তর্ভূমিগুলোর বরফের স্তরগুলো (আইস শীট) এখনও অক্ষত আছে। ইউনিভার্সিটি অভ তাসমানিয়ার আইস শীট বিষয়ক বিজ্ঞানী ম্যাট কিং-এর মতে এই বরফ স্তরগুলো ডুবে যাবার ফল হবে ভয়াবহ। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তবে এটা অদূর ভবিষ্যতে ঘটার আশঙ্কা নেই। তা সত্ত্বেও পশ্চিমের আইস শীট যেরকম মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা'র এসব বরফ তা পারেনি। এই সময়ে এসেও কেবল এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ হবে তার হিসেব চলছে।
যতদূর জানি 'জেনি' নামক জাহাজটির বরফে পথ হারানোর ঘটনাটা একটা ভূতের গল্প। ঊনিশ শতকের শুরুর দিক থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জার্মান গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিত্তিহীন অনেক প্রতিবেদন বেশ সাড়া ফেলত। তাই খুব সম্ভবত 'জেনি'র গল্পটা সত্যি ছিল না। এটি ছিল নাবিকদের দ্বারা ছড়ানো নিছক একটা গুজব।
যতোই গুজব হোক গল্পটার কিছু গুরুত্ব রয়েছে। কথায় বলে, যা রটে তার কিছুটা হলেও সত্য বটে। নাবিকেরা পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রযাত্রায় যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতেন তার বর্ণনাই ফুটে উঠে গল্পটিতে।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ আবিষ্কৃত হয় ১৮২০ সালে, তথাকথিত 'জেনি'র হারিয়ে যাবার কয়েক বছর আগে। তখনও মহাদেশটিতে মানুষের পদচারণা পড়েনি। এটি অন্তর্দেশীয় ভূমিগুলোতে ভ্রমণের এবং দক্ষিণ মেরুতে পতাকা পুতে দেওয়ার বহু দশক আগে।
ঊনিশ শতকের শেষের কয়েক দশক ছিল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ জয়ের 'বীরত্বপূর্ণ সময়'। সর্বশেষ আবিষ্কৃত এই মহাদেশটিকে ঘিরে চলছিল নানা রহস্য। অনতিক্রম্য কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া 'সাহসী' হিরোদের গল্পের যুগ ছিল সেসময়।
রবার্ট ফ্যালকন স্কট, রোল্ড অ্যামান্ডসন এবং আর্নেস্ট শেকলটন সেই প্রকৃত অভিযাত্রী যারা কল্পিত 'জেনি'র মতোই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু পার্থক্য হলো, তারা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত দক্ষিণ মেরুতে নিজেদের নাম লিখতে পেরেছেন।
১৮৯৮ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকায় মোট ২২ জন অভিযাত্রী প্রাণ হারান। ১৯১৪ সালে শেকলটনের অভিযান বেশ খ্যাতি লাভ করে। তার জাহাজ কয়েক মাস ধরে বরফবন্দী হয়ে পড়ে এবং একসময় ভেঙে সাগরের নিচে ডুবে যায়। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে জাহাজটি অনাবিষ্কৃত ছিল। তবে এটা 'জেনি'র মতই আরেকটা ভুতের গল্প।
গত শতাব্দিতে এ চিত্র একদম বিপরীত মোড় নেয়। অ্যাডভেঞ্চারের পরিবর্তে গবেষণার জন্য অভিযান শুরু হয়। পর্যটক বহনকারী জাহাজ এবং বিজ্ঞানের নাম করে পরিচালিত সমুদ্রযাত্রারগুলোর কারণে মহাদেশটির বরফ আরও দ্রুত গলতে শুরু করল।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন আমরা সত্যিকারের ভূতের গল্প বুনছি আর অপেক্ষা করছি মহাধ্বংসের।
ধসে পড়ছে বরফের তাক
এবছরের মার্চ মাসে রোম শহরের সমান একটি বরফের টুকরা ভেঙে পড়ে। মহাসাগরের ওপর জড়িয়ে থাকা ধবধবে সাদা চাদর মুহূর্তের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ টুকরো হয়ে যায়। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবিতে ভয়ংকর এ দৃশ্য ধরা পড়ে।
এই ধসের কয়েক সপ্তাহ আগে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। মহাদেশটির কনকর্ডিয়া স্টেশনে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। মোনাশ ইউনিভার্সিটির একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ম্যাকিন্টশ আমাকে জানান, কঙ্গার নামক ওই বরফের টুকরার ভেঙে পড়ার সাথে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
কিছুকিছু জায়গায় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বুঝতে বেশ সময়ের প্রয়োজন। গ্লেশিওলজিস্ট ম্যাককর্ম্যাক অস্ট্রেলিয়ার ক্যাসি স্টেশনের কাছে থাকা ভ্যান্ডারফোর্ড হিমবাহের ওপর গবেষণা করেন। তার মতে দীর্ঘমেয়াদে ভ্যান্ডারফোর্ডের উপর কী প্রভাব পড়বে তা বলা মুশকিল তবে এ অঞ্চলে বেশি পরিমাণে তুষারপাতের দেখা মিলছে। এ থেকে আশঙ্কা করা যায় ভবিষ্যতে বেশ 'শক্তিশালী প্রভাব' দেখা যেতে পারে।
আর অন্যদিকে অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার দক্ষিণ গোলার্ধে তাপমাত্রা বেশ দ্রুত বাড়ছে। ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ-এর হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব পূর্ব সময় থেকে এখনও পর্যন্ত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা আগামীতেও বাড়বে।
এর ফলে দক্ষিণ গোলার্ধে বড়সড় পরিবর্তন আসতে শুরু করবে। হিমবাহ যে হারে গলছে সেখানকার স্বতন্ত্র ইকোসিস্টেমকে বিনাশ করে দেবে। ২১০০ সাল নাগাদ অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলাকে চেনার আর উপায় থাকবে না।
ভ্রমণ কেমন ছিল?
অ্যান্টার্কটিকাফেরত কাউকে এ প্রশ্নেরই বেশি মুখোমুখি হতে হয়। সত্যি বলতে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
জবাবে কি অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে যে আমাদের গ্রহের অস্তিত্ব সংকট আরও পাকাপোক্ত করে আসলাম তা বলব? নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা হারাতে যাচ্ছি, যে ভূত তৈরি করার পথে এগুচ্ছি তার কথা বলব?
আমরা যে ভ্রমণের নামে ডিজেলচালিত আইসব্রেকারে করে মিলিয়ন লিটার জ্বালানি নিয়ে মহাদেশটির অনের বড় ক্ষতি করছি!
মনের চোখ দিয়ে 'জেনি'র কথা ভেবে দেখি। দেখতে পাই এসিডে পুরু হয়ে যাওয়া মেয়াদোত্তীর্ণের দ্বারপ্রান্তে থাকা এক মহাসাগরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে ক্রিল মাছ। আরও দেখতে পাই নাম না জানা অজস্র হিমবাহ গলে যাচ্ছে, মাসের ব্যবধানে বরফ হয়ে যাচ্ছে উধাও।
এরপর নামছে ধস!
জ্যাকসন রায়ান সিনেট-এর সায়েন্স এডিটর