ক্যামিনো দে লা মুয়ের্তে: বিশ্বের সবচেয়ে বিপদজনক রাস্তা!
আর্জেন্টিনা ও চিলির মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ৪৮০০ মিটার উচ্চতার 'কুমব্রে পাস'-এ পৌঁছানোর পর আমাদের ট্রুফি (শেয়ারে চলা ট্যাক্সি) কুয়াশার মেঘের মধ্যে ডুবে গেল। গাড়ির ভেতরে বসে একটা অদ্ভূত শান্তিময় অনুভূতি হচ্ছিলো, যেন আমরা একটা বাবলের মধ্যে আটকে গেছি...কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা 'ক্যামিনো দে লা মুয়ের্তে' বা 'ডেথ রোড' ধরে যাওয়ার সময় এছাড়া আর কিইবা অভিজ্ঞতা হতে পারে!
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শহর বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ থেকে শুরু করে উপ-ক্রান্তীয় ইউঙ্গাস উপত্যকা এবং তার বাইরে আমাজনীয় নিম্নভূমি পর্যন্ত ছুটে চলা ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ইউঙ্গাস রোড থেকে অবরোহণের পথটি খাড়া ৩৫০০ মিটার নিচে চলে গিয়েছে। হাইওয়ের কিছু কিছু অংশ মাত্র ৩ মিটার চওড়া; রয়েছে কিছু তীক্ষ্ণ-বাঁকানো টার্ন ও 'ব্লাইন্ড কর্নার' এবং আশেপাশের শিলামুখ থেকে নেমে এসেছে ছোট ছোট পানির ধারা। এ পথে দুর্ঘটনা ঠেকাতে সেফটি ব্যারিয়ার যতটা না দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীক বা পবিত্র মাজার- ক্রুশ, একগুচ্ছ ফুল বা ছবি রেখে দেওয়া এখানে পরিচিত দৃশ্য।
চাকো যুদ্ধের (১৯৩২-৩৫) পর প্যারাগুয়ের যুদ্ধবন্দীদের তৈরি এই রাস্তায় নব্বইয়ের দশকে এত এত মানুষ মৃত্যুবরণ করে যে ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সড়ক বলে আখ্যা দেয়।
এদিকে আমাদের ট্রুফি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, চালক সামনের দিকে ঝুকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালো (যেন সে চোখ পরীক্ষা করাচ্ছে!) আর অমনি হঠাৎ কুয়াশা থেকে বেরিয়ে সূর্যালোকে পড়লাম। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ১০০০ মিটার খাড়া গর্ত, সামান্য অসাবধানতায় সেখানে মৃত্যু নিশ্চিত! এরই মধ্যে একটি মোটরসাইকেল আমাদের পার হয়ে গেল, অন্যদিকে তিন সাইকেল আরোহী অত্যন্ত সরু একটা জায়গা পেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে... সব মিলিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাডভেঞ্চার বটে!
কিন্তু মানুষ বরাবরই অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার নেশায় ছুটেছে। যেখানেই দেখেছে মৃত্যুফাদ, সেটিই বরং জয় করতে চেয়েছে। তাই ডেথ রোডের ভয়ঙ্কর খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে এ পথে চলাচলের অভিজ্ঞতা নিতে।
কুমব্রে পাস এমন একটি অঞ্চলে প্রবেশের গেটওয়ে যা এখনো বেশ উপেক্ষিত। ইয়ুঙ্গাস অঞ্চল অত্যন্ত উর্বর। আদিবাসী ভাষা আয়মারা অনুযায়ী এর নাম 'উষ্ণ ভূমি'। বলিভিয়ার ১.৭ মিলিয়ন মানুষ আয়মারা ভাষায় কথা বলে। এছাড়াও এ অঞ্চল এমন দুটি বিষয়ের সাথে জড়িত যা বছরের পর বছর ধরে মানুষের মধ্যে আগ্রহ, বিতর্ক ও শ্রদ্ধার জন্ম দিয়েছে; আর তা হলো- কোকা (কোকেইন তৈরির উৎস) ও স্বর্ণ।
কোকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সংস্কৃতি
আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব ঢাল বরাবর অবস্থিত ইয়ুঙ্গাস অঞ্চলের উর্বর মাটি এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এ অঞ্চলকে একটি কৃষি উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ইনকা এবং এর আগের সাম্রাজ্যগুলোর জন্য এ অঞ্চল ছিল খাদ্যের একটি প্রধান উৎস। সেই প্রাচীন রীতি আজও বজায় রয়েছে। শতাব্দী পুরনো পাহাড়ি পথ ধরে রিও কোরোইকো দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে জন্মানো হয়েছে কফি, কলা, কাসাভা, পেয়ারা এবং আরও কিছু টকজাতীয় ফল। সেই সাথে দেখলাম ঝোপের মতো দেখতে, ডিম্বাকৃতির পাতাযুক্ত গাছ 'কোকা' এবং এর লালচে ফল।
হাজার বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকার সংস্কৃতির একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে কোকা এবং কোকা উৎপাদনের দিক থেকে বলিভিয়াই শীর্ষে।। দেশটিতে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার জমিতে চাষ করা হচ্ছে কোকা এবং এর দুই-তৃতীয়াংশই ইয়ুঙ্গাস অঞ্চলে চাষ হয়। ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ কোকা গাছের পাতা মৃদু উত্তেজক হিসেবে কাজ করে এবং উচ্চতাজনিত অসুস্থতা দূর করতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তি দূর করতেও এটি সাহায্য করে; হজমে সাহায্য করে এবং ব্যথাও হ্রাস করে। প্রায় ৮০০০ বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ওষুধ হিসেবে এবং সোশ্যাল লুব্রিকেন্ট হিসেবে এটি ব্যবহার হয়ে আসছে।
প্রাথমিকভাবে স্প্যানিশরা এ অঞ্চলে কোকা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এটি আদিবাসী মানুষদের কয়লা খনিতে ও বাগানের কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে সাহায্য করে বোঝার পর এই ফসলটি সম্পর্কে তাদের মনোভাব পরিবর্তন হয়। এরপরে তারা বাণিজ্যিকভাবে কোকা চাষ শুরু করে। ধীরে ধীরে কোকার চাহিদা এ মহাদেশের বাইরেও ছড়িয়ে যায়।
উনিশ শতকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কোকা এবং এর সাইকোঅ্যাক্টিভ অ্যালকালয়েড কোকেইনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন পানীয়, টনিক, ওষুধ ও অন্যান্য পণ্যের মধ্যে তারা কোকেইন ব্যবহার করতে শুরু করে। এসবের মধ্যে রয়েছে 'ভিন মারিয়ানি' নামক একটি ফরাসি ওয়াইন, যাতে ২০০ লিটারেরও বেশি কোকেইন ব্যবহার করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের দাবি করা হয় এটি মস্তিষ্ক ও শরীরকে চাঙ্গা করে তুলবে।
ভিন মারিয়ানির সফলতা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিস্ট ও সাবেক কনফেডারেট যোদ্ধা জন পেমবারটন 'পেম্বারটন'স ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোকা' তৈরি করতে উৎসাহী হন। এই ওয়াইনের মধ্যে ছিল কোকেইন, অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইনসমৃদ্ধ কোলা নাটের নির্যাস। পরবর্তীতে এখান থেকেই জনপ্রিয় পানীয় কোকা-কোলা ধারণা আসে। কোকা-কোলা থেকে বহু আগেই কোকেইন ও অ্যালকোহল বাদ দেওয়া হলেও কোকেইনমুক্ত কোকার পাতা এখনো এর ফ্লেভার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের প্রারম্ভে কোকেইন এবং কোকেইনভিত্তিক পণ্য ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বৈধ করা হয়। এমনকি মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েন্ডও কোকেইনের প্রশংসা করে গেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে কোকেইনের সাথে অপরাধ কার্যক্রম জড়িয়ে যায় এবং সারা বিশ্বে এটি নিষিদ্ধ করা হয়; যদিও পরে বলিভিয়ায় এটি বৈধই রাখা হয়।
এদিকে কোকেইনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮০'র দশকে যুক্তরাষ্ট্র 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' পরিচালনা করে বলিভিয়ার চাপারে অঞ্চল ধ্বংস করে দেয় যা ছিল একটি প্রধান কোকা-উৎপাদন কেন্দ্র। কিন্তু বলিভিয়ার কোকা উৎপাদনকারীরা এটি মেনে নিতে পারেনি, তারা 'কোকালেরোস' আন্দোলন গড়ে তোলে। এদের বেশিরভাগই ছিল কুয়েচুয়া বা আয়মারা আদিবাসী গোষ্ঠী। তারাই বলিভিয়ান নেতা ইভো মোরালেসকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে এবং তাদের প্রতিনিধি বানায়।
ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সময় পার করার পর ২০০৫ সালের নির্বাচনে ইভো মোরালেস বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই তিনি 'কোকাকে হ্যাঁ বলুন, কোকেইনকে না' নামক নীতি চালু করেন এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে এ ফসল উতপাদনের অনুমতি দেন। বর্তমানে অনেক বলিভিয়ানের কাছেই কোকা একটি পবিত্র গাছ এবং প্রচুর মানুষ এটি ব্যবহারও করে নিয়মিত।
ইয়ুঙ্গাস অঞ্চল, স্বর্ণ ও লুকানো সম্পদ!
কোরোইকো নদীর কাছাকাছি পৌছাতেই স্বর্ণের আভাস পেলাম... না, সত্যিকার স্বর্ণ নয়, হাজার বছরের পুরনো গল্পের যা ইয়ুঙ্গাস অঞ্চলকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। 'রুতা দেল ওরো' বা তথাকথিত 'গোল্ডেন রুট' নামে পরিচিত ৩৫০ কিলোমিটারের একটি নাব্য জলপথ শুরু হয়ে আমাজন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। ইয়ুঙ্গাস ও এর আশেপাশের অঞ্চলে গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অসংখ্য গুজব ও রূপকথা!
বিশ শতকের শুরুর দিকে পার্সি হ্যারিসন ফচেট নামক এক ব্রিটিশ পর্যটক দক্ষিণ আমেরিকায় ভ্রমণ করেন। তার লেখা বই 'এক্সপ্লোরেশন ফচেট'-এ তিনি ইয়ুঙ্গাস অঞ্চলে স্বর্ণের উতস নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, সাকাম্বায়া নদীর ধারে একটি টানেলের মধ্যে জেসুইট সম্প্রদায় 'বড় রকমের ধনসম্পদ' লুকিয়ে রেখেছে। যে ছয়জন আদিবাসী বলিভিয়ান ও সাতজন পুরোহিত এই কাজটি করেছিল, গোপনীয়তা রক্ষার্থে তাদেরও হত্যা করা হয় বলে গল্পে উল্লেখ করেন তিনি।
কিন্তু এসব মুখরোচক গল্পের বাইরেও, ইয়ুঙ্গাস অঞ্চল ও বলিভিয়ান আমাজনে স্বর্ণের উপস্থিতি কিছুটা তো রয়েছেই। এখানে স্বর্ণ উত্তোলন প্রক্রিয়ার বেশিরভাগই অবৈধ এবং সংগঠিত অপরাধ চক্র, বিষাক্ত জলপথ এবং বন নিধনের সাথে যুক্ত।
কিন্তু কোরোইকোতে এসবের কোনো বাস্তব চিহ্নই মেলেনি। এক কাপ কোকা চা হাতে নিয়ে শান্ত হয়ে বসে যখন ডেথ রোড থেকে আমার ট্যাক্সি ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলাম, তখন আন্দিয়ান পর্বতের পাদদেশে সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে যে আলোর ঝলকানি চোখে লাগলো, সেটাই ছিল আমার দেখা একমাত্র সোনালি আভা!
(শফিক মেঘজি 'ক্রসড অফ দ্য ম্যাপ: ট্রাভেলস ইন বলিভিয়া' বইয়ের লেখক।)
সূত্র: বিবিসি