বিদায় সানি: বাংলাদেশের গাড়িপ্রেমীদের পথিকৃৎ
বাবা লুৎফুর রহমানের সঙ্গে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন হাবিবুর রহমান সানি। সেই থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে হোক বা অন্যভাবে- সানির মধ্যে এক দৃঢ় প্যাশনের জন্ম নেয় যা পরবর্তীতে তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই প্যাশনের কারণেই জীবদ্দশায় তিনি ১০০টিরও বেশি ভিনটেজ গাড়ি সংগ্রহ করেন।
লুৎফুর রহমানের নৌকা ও গাড়ির প্রতি আগ্রহ ছিল। কুমিল্লার চাঁদপুরের বাসিন্দা হলেও কলকাতার আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় কাজ করতেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় আসেন। নিজের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গাড়ি বিক্রির জন্য আনেন এবং ঢাকার বড় একটি জমি কিনেন।
সেখানে অটোমোটিভের দোকান খুলে এর নাম দেন পাকিস্তান মোটরস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর এর নাম বাংলা মোটর রাখা হয়। সময়ের সঙ্গে জায়গাটি বাংলামোটর হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
সানির জীবনের শুরুর দিনগুলো
সেইন্ট গ্রেগরি'স হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করে বুয়েটে আর্কিটেকচারে পড়েন সানি। অবসর সময়ে বাবার সঙ্গেই কাটত তাঁর সময়। কখনো বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেতেন, আবার কখনো তাঁকে দোকানে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন। বাবার ছত্রছায়ায় সানি গাড়ি মেকানিক্সের বিভিন্ন কাজ শিখেন। কীভাবে সেগুলো ঠিক করতে হয়, নতুন কিছু সংযোজন করতে হয় সব করতে করতেই তাঁর মধ্যে গাড়ি নিয়ে প্যাশনের জন্ম নেয়।
সানি দেশব্যাপী গাড়ি সংগ্রহকারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। তবে মজার বিষয় হলো গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসায় তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তাঁর মূল আগ্রহ ছিল গাড়ি সংগ্রহে।
যদিও আর্কিটেকচার হিসেবে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, কিন্তু ক্যারিয়ারে আর সেই পথে হাঁটলেন না। পড়াশোনা করার সময় বেশকিছু স্থাপত্য বিষয়ক প্রকল্পে কাজ করেন তিনি। সেখান থেকে যেসব টাকা পান তাই দিয়ে এমন সব গাড়ি কিনতে শুরু করেন, যা আর কেউ ব্যবহার করতে আগ্রহী না।
'এই গাড়িগুলো এখন বেশ মূল্যবান, কিন্তু সেই সময় এগুলোর কোনো মূল্যই ছিল না,' বলেন হাবিবুর রহমান সানির ছেলের সাদি রহমান।
'মানুষ নতুন গাড়ি চাইত আর আমার বাবা এমন সব গাড়ি কিনতেন যেগুলো আর মানুষ চায় না'।
'তখনকার দিনে এসবের তেমন কোনো মূল্য ছিল না। আর আমার বাবাও আসলে সেগুলো বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে কিনতেন না। তিনি এই গাড়িগুলো বেশ পছন্দ করতেন এবং এগুলো সংগ্রহ করা ছিল তাঁর প্যাশন।'
দ্রুতই এটা নিয়মিত এক বিষয়ে পরিণত হয়। সানি গাড়ি কিনতেন। এরপর তিনি ও তাঁর মেকানিক বন্ধুরা মিলে সেগুলো সারাই করে সংগ্রহ করতেন।
'এটাই ছিল তার শখ আর তিনি এসবই করতে চেয়েছিলেন', বলেন সাদি।
'একে একে আমাদের বাড়িতে এই গাড়িগুলো জমতে শুরু করে। তিনি আসলে অন্য মানুষের ফেলে দেওয়া আস্তাকুঁড় আমাদের ঘরে এনে তুলতেন। তবে এগুলোর পিছে তিনি প্রচুর সময় দিতেন। গাড়িগুলোর পুরোনো চাকচিক্য ফিরিয়ে আসতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা ও কাজ করতেন।'
১০ ভাইবোন নিয়ে সানির পরিবারটি ছিল বিশাল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে সানির সব ভাইবোন দেশের বাইরে চলে যান। কিন্তু সানি বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশে থেকে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
'বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মায়ের সঙ্গে বাবার দেখা। তারা যুদ্ধ শেষে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বাংলাদেশেই রয়ে যান। সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে বাবার সংগ্রহ', বলেন সাদি।
ভিনটেজ গাড়ির প্রতি অন্ধ ভালোবাসা
সানি সারা বাংলাদেশ থেকেই গাড়ি সংগ্রহ করতেন। যখনই তিনি কোনো ভিনটেজ গাড়ি বিক্রি হওয়ার সন্ধান পেতেন, সেখানে গিয়ে সেগুলো কিনে নিজের জন্য সংগ্রহ করতেন।
সানির কালেকশনের কিছু গাড়ি ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে এসেছে। 'আমার বাবার সংগ্রহে নাটোরের মহারানির মালিকানাধীন গাড়ি, রানির বিভিন্ন বিখ্যাত আইনজীবীকে উপহার দেওয়া গাড়ি রয়েছে। যখন ছোট ছিলাম আমার মনে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জিপে ঘুরে বেড়াতাম। কুমিল্লায় এক আমেরিকান বেসে গাড়িটি ব্যবহৃত হতো। কুমিল্লা ও সিলেটের বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আমেরিকান আর্মির বিভিন্ন গাড়ি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন,' ব্যাখ্যা করেন সাদি।
শখ পূরণ করতে গিয়ে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানিয়েছিলেন সানি। তাদেরই একজন আরেক সংগ্রহকারী মাহমুদুল ফারুক। দুজন মিলিতভাবে ১৯৮০-র দশকে ঠিক করেন তাদের গাড়িগুলো অন্যদেরও দেখাবেন। প্রতিটি গাড়ির ইতিহাস, দাম এবং গল্প তারা অন্যদের সামনে আনতে চাইলেন।
১৯৮৩ সালে সানি ও ফারুকের ওল্ড কার ক্লাব অব বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। এর দুই বছর পর তারা বাংলাদেশের প্রথম ভিনটেজ গাড়ির র্যালি আয়োজন করেন শেরে বাংলা নগরে। ১৯৮৮ এবং ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো ক্লাবের উদ্যোগে র্যালির আয়োজন হয়।
'এই র্যালিগুলো দেখে মানুষ অনেককিছু জানতে পারে। তৃতীয় ইভেন্টটি সফলভাবে পার করার পর অনেকেই শখের বশে গাড়ি সংগ্রহ শুরু করেন। মানুষ ভক্সওয়াগন ক্লাব, মার্সিডিজ ক্লাব ইত্যাদি বিভিন্ন ক্লাব শুরু করে।
'এই গাড়িগুলো কীভাবে আমাদের ইতিহাসের অংশ ছিল সেটিও মানুষ র্যালি আয়োজন থেকে জানতে পারে। অনেকের গ্যারেজেই তাদের দাদার আমলের গাড়ি পড়ে ছিল। তারাও এই গাড়িগুলো সারাই করে পারিবারিকভাবে সংরক্ষণ করতে শুরু করে।
স্বতস্ফূর্ত শখ থেকে জন্ম নেওয়া সংস্কৃতি
'সানির ভিনটেজ গাড়ির সংগ্রহ সম্পর্কে সবাই জানে। আমরা ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। আমরা একসঙ্গে একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। আমার গাড়ির প্রতি কখনো এতবেশি আগ্রহ ছিল না। আমি সানির ওই গাড়ির নেশার বিষয়টিও বুঝতাম না। কিন্তু সে সবসময় র্যালিতে আমাকে কোনো একটি গাড়ি চালাতে দিত,' বলেন সানির বাল্যবন্ধু শওকত ওসমান।
'আমি জীবনে অসংখ্য মানুষ দেখেছি, কিন্তু তাঁর মতো এত প্যাশনেট মানুষ খুব কমই আছেন। সানি নিজের শখ নিয়ে বেশ স্বতস্ফূর্ত ছিল। খুব নম্র ও মৃদুভাষী ছিল সে।'
সানির বাবার বয়স হয়ে গেলে বাংলা মোটর একসময় বন্ধ হয়ে যায়। তিনি শিপিং ব্যবসা শুরু করেন, যেখান থেকে পরবর্তীতে সানি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি নামে লজিস্টিকসের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে শখের পেছনে যতটা সময় দিতেন, সময়ের সঙ্গে দেখা গেল অত বেশি সময় তিনি দিতে পারছেন না। কিন্তু নিজে না পারলেও তিনি দেশের গাড়িপ্রেমী ও সংগ্রহকারীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে সানির কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
'আমার বাবা সর্বশেষ যে গাড়িগুলো নিয়ে কাজ করছিলেন তাঁর একটি হলো ১৯১০ সালের ডাইমলার। এটা সবসময়ই তাঁর অন্যতম প্রিয় একটি গাড়ি ছিল। আমি ছোট থেকে তাঁকে বলতে শুনেছি 'একদিন এর বয়স ১০০ বছর হবে' আর নিশ্চিতভাবেই এই গাড়ির বয়স ১১২ বছর হতে চলেছে,' বলেন সাদি।
'আমরা ভাবতাম এটা ১৯০৯ সালের ডাইমলার। আমি ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে একবার প্রতিষ্ঠানটির কাছে গাড়িটি সম্পর্কে লিখে পাঠাই। গাড়ির ছবি আর চ্যাসিস নাম্বার তাদের দিই। তারা আমাকে জানায় যে এটি ১৯১০ সালের মডেল এবং এখন পর্যন্ত বিশ্বে এই মডেলের গাড়ি স্রেফ এই একটিই অবশিষ্ট আছে! আশা করি তাঁর কাজগুলো আমি শেষ করতে পারব,' বলেন তিনি।