পিন কোড ৭৪৩৩৭৮: ভারতে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিঠি পৌঁছায় যেভাবে
হুগলী নদী ধরে প্রায় বঙ্গোপসাগর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে মহানগরী কোলকাতা। বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবনের সাথে এখানকার দূরত্ব বেশি নয়। এই সুন্দরবনেরই একটি প্রত্যন্ত এলাকা কুমিরমারি দ্বীপ। সেখানে হেলিকপ্টারে করে পৌঁছে যাবেন মাত্র ১৭ মিনিটেই। অথচ একই ঠিকানায় দুটি চিঠি পৌঁছায় ৪৬ ঘণ্টা পর। খবর ডেক্কান হেরাল্ডের
কেন এত সময় লাগে এই যুগেও ডাক বিভাগের? উত্তর জানতে নিজেই চিঠিগুলির যাত্রা স্বচক্ষে দেখার পণ করি। আর যা দেখলাম তাতে করে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হতেও সময় লাগেনি।
চিঠি যায় প্রথমে ডাক বিভাগের গাড়িতে। তারপর দুটি ট্রেন বদলায়। এরপর আবারো চাপে একটি বাসে। কিন্তু, কুমিরমারির ডাক ঠিকানা বা পিন কোড ৭৪৩৩৭৮ আসতে পথ তখনও বাকী। অতঃপর আরও একবার মোটরবোট, এরপর সাইকেল এবং সবশেষে হেঁটে হেঁটে চিঠি পৌঁছে দেন ডাকপিয়ন। চিঠির প্রেরক হয়েও যাত্রাসঙ্গী হই প্রাপকের ঠিকানা পর্যন্ত।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যখন চোখের পলকেই হচ্ছে বার্তার আদানপ্রদান- ঠিক সে সময়ে চিঠির এই যাত্রাসঙ্গী হওয়াটাও সত্যিই রোমাঞ্চকর।
গল্পটা শুরু থেকেই বলা যাক। আইডিয়াটা মাথায় আসামাত্র প্রথমে দেখা করলাম ভারতীয় ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে। চাইলাম চিঠির পথ অনুসরণের অনুমতি। এরপর কোলকাতার যোগাযোগ ভবন থেকে সবুজ সংকেত পেতে দেরি হয়নি। সম্মতি পাওয়ার পর চিঠি দুখানা পোস্ট করলাম বিডন স্ট্রিটের পোস্ট অফিসে। ডাকবিভাগের 'স্পিড পোস্ট' বা সবচেয়ে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার সেবার আওতায় চিঠিগুলো পোস্ট করা হয়। দুটিই ছিল কুমিরমারির দুই বাসিন্দাকে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া চিঠি।
চালানের নাম্বার আমায় দিয়েছিল ডাক বিভাগ। সেটি দিয়েই অনুসরণ করি চিঠির যাত্রাপথের প্রথম কয়েক ঘণ্টা। দুপুর ২.১৩টা থেকে রাত ৮.২২ পর্যন্ত চিঠি যায় আরেকটি পোস্ট অফিসে, সেখান থেকে ট্রানজিট মেইলের দপ্তরে আর সেখান থেকে জাতীয় ডাক বাছাই কেন্দ্রে। বাছাইয়ের পর ঠিকানা অনুসারে সাজানো হয় চালানের ক্রম। এবার চিঠি একটি চালানের আওতায় চলে যায় শিয়ালদহ রেল স্টেশনে।
চিঠি যাবে পরের দিন ভোর রাতে। সময়মতো সকাল সাড়ে ৪টায় আমিও গিয়ে হাজির হই। কিন্তু, কাউন্টারে গিয়েই আক্কেলগুড়ুম। এই সময়েও দুই কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেটপ্রার্থী যাত্রীর দল। অগত্যা, আমিও গিয়ে লাইনেই দাঁড়াই। বার বার মনে হচ্ছিল চিঠির ট্রেন মিস করব। আমার যেন তর সইছিল না। তাই বার বার সামনে লাইন কতদূর এগুলো সেদিকে লক্ষ করছিলাম। এরমধ্যেই দেখি সামনের একজন একটু পাশে সরে গেলেন।
দেখতে পেলাম, এতক্ষণে খুলেছে তৃতীয় কাউন্টারের জানালা। আর দেরি না করে সেদিক পানেই ছুটলাম। চটজলদি টিকেট কেটে রুদ্ধশ্বাসে গিয়ে উঠলাম ট্রেনে। এই রেলগাড়িরই একটি অংশকে ভারতীয় ডাক বিভাগের মালামাল বহনের জন্য নির্দিষ্টভাবে রিজার্ভ রাখা হয়।
একটি ট্রলিতে স্তূপ করে রাখা ডাকবোঝাই থলেগুলি ট্রেনে লোড করে ডাকবিভাগের দুই কর্মী। এরপর ভোর ৫.১৬ নাগাদ ট্রেন ছেড়ে দেয়। তবে কাজ আরও বাকি। ট্রেনে ডাকঘর নং অনুসারে ব্যাগ ও পার্সেল বাছাই শুরু করেন ডাক বিভাগের অন্য তিন কর্মী।
পরবর্তী আধাঘণ্টা একাগ্র চিত্তে এ কাজেই ডুবেছিলেন তারা। এরমধ্যে কতবার বা কোথায় কোথায় ট্রেন থামলো– তা একবার চোখ তুলেও দেখেননি। আমি অবশ্য প্রতিবার ট্রেন থামার পর যাত্রীদের ওঠানামা, স্টেশনের আলো আর চিৎকার-চেচামেচিতে মনোযোগ হারাচ্ছিলাম। ডাক কর্মীরা সেসবে ভ্রক্ষেপই করেননি।
আমাদের যাত্রার দিনছিল সোমবার। আর ডাক কর্মীরা জানালেন এদিনই কাজের চাপ থাকে সবচেয়ে বেশি। তাদের সাথে আড্ডাও দিচ্ছিলাম। এরমধ্যেই ট্রেনের স্পিকারে মাঝেমধ্যে বাজানো হচ্ছিল– অমিতাভ বচ্চনের কোভিড-বিরোধী বিজ্ঞাপনী বার্তা– 'যব তক দাওয়াই নেহি, তব তক ঢিলাই নেহি'। রেলওয়েতে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখানো দালালদের থেকে সতর্ক থাকার ঘোষণাও শুনছিলাম থেকে থেকে।
কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছাই কোলকাতা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের সোনারপুর স্টেশনে। এখানে এসে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ক্যানিং শহরের জন্য বাছাই করে রাখা ব্যাগগুলি অন্য একটি ট্রেনে ওঠানো হলো। প্লাটফর্মে পরিচিত হলাম জলিল মোল্লা ও অনিমেষ বৈদ্য নামের ডাক বিভাগের 'সব কাজের কাজী' দুই কর্মীর সাথে। তারা আমাকে চা-বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। যাত্রার পরবর্তী অংশের জন্য গরমা গরম চায়ে চুমুক আমাকে কিছুটা চাঙ্গাও করে তুললো।
এরপর আমরা সবাই মিলে চাপলাম দ্বিতীয় ট্রেনে। এখানে ডাক থলে আরেকদফা বাছাইয়ের কাজ চললো। এবার অবশ্য আলাদা কম্পার্টমেন্ট নয়, বরং রেল কোচটিতে অন্যান্য কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গেই চলছিল ডাকের চালান।
সকাল সাড়ে ৬টায় ক্যানিং পৌঁছায় ট্রেন। নিজের অর্ধেক ওজনের পেল্লায় এক ডাক থলে কাঁধে তুলে নেমে যান মোল্লা। আর ছোট থলেগুলি একটি ট্রলিতে চাপিয়ে প্লাটফর্ম ধরে এগিয়ে নেওয়া হয়, দুপাশেই ছিল দোকানিদের পসরা। কেউ কেউ বিক্রি করছিল গরম গরম রুটি ও ডিমভাজা।
স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে আমরা গেলাম শহরের প্রধান ডাকঘরে। পথে দেখা পেলাম কয়েকজন ফুল ও লটারির টিকেট বিক্রেতার। ছোট্ট একটি চায়ের দোকান থেকে পাচ্ছিলাম ধূপ আর কয়লার ধোঁয়া মেশানো গন্ধ।
আধার কার্ডের জন্য অপেক্ষা:
ভারতীয় নাগরিকত্ব বা সেদেশে দীর্ঘদিন বসবাসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হলো আধার কার্ড। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র। আমরা ক্যানিং পোস্ট অফিসে যখন পৌঁছালাম তখনও সাতটা বাজেনি। তবে কিছু নারী বাচ্চাদের নিয়ে পোস্ট অফিসের বারান্দায় বসেছিলেন আধার কার্ডের ফর্ম পূরণের অপেক্ষায়। দিনে এ ধরনের ২০-৩০টি আবেদন গ্রহণ করে পোস্ট অফিসটি। তাই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত সময়ের অনেক আগেই সকাল সকাল চলে আসে কার্ড প্রত্যাশীরা।
এই ডাকঘরে দৈনিক আসে প্রায় দুই হাজার চিঠি/পার্সেল বা সরকারি নথি ইত্যাদি। স্থানীয় ডাকগুলি আলাদা করে পায়রার খোপের মতো ছোট ছোট কাঠের র্যাকে সাজিয়ে রাখা হয়। প্রতিটি আইটেমের গায়েই পড়ে নির্দিষ্ট তারিখের স্ট্যাম্প।
তারিখ দেওয়া পর আবারো যাত্রা শুরু হয় কুমিরমারির চিঠিগুলোর। এবার প্রথমে সেগুলি পাঠানো হবে ছোট মোল্লাখালির সাব পোস্ট অফিসে। ক্যানিং অফিসের আরেক কর্মী দিলিপ মণ্ডল এবার যাত্রাসঙ্গী। কুমিরমারির ডাক নিয়ে আমরা চাপলাম একটি বাসে। বাস থেকে নেমে হাঁটতে হলো কিছুদূর। হেঁটে হেঁটে চুনাখালী ঘাটে গিয়ে ফেরিতে উঠলাম। এখানে ডাক বিভাগের জীবন বীমা কর্মী অচিন্ত্য পুরকাইতও আমাদের সঙ্গী হলেন। তার কাছ থেকেই গল্পে গল্পে শেষপর্যন্ত চিঠি কীভাবে পৌঁছায় সেসব বর্ণনা শুনছিলাম।
বাসের জানালা দিয়েও ডাক বিলি
আমাদের বাসটি মৃদুমন্দে যাত্রা শুরু করে সকাল ৯টায়, পথে কয়েক মিনিট চলতে না চলতেই থামছিল, যাত্রী তুলছিল। লোকাল বাস তস্য লোকাল বাসই বটে। কচ্ছপগতির বাসের জানালা দিয়ে ফুলমালঞ্চ ডাকঅফিসের কর্মীকে তার ডাকঘরের জন্য চিহ্নিত থলেটি বেমালুম পাচার করে দেন মণ্ডল।
বাস থেকে নেমে ১০ মিনিট হেঁটে ঘাটে গেলাম বড় মোল্লাখালির ফেরি ধরতে। ছোট মোল্লাখালি দ্বীপের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত বড় মোল্লাখালির ডাকঘর। তবে ছোট মোল্লাখালির পোস্ট অফিসের আওতা হলো পূর্বদিকে।
ফেরিতে যাত্রীর ভিড় ছিল। তবে প্রথম ডেকের শেষপ্রান্তে দাঁড়াবার মতো জায়গা পেয়ে যাই কোনমতে। কিন্তু, ওপরের ডেকে গরম আর আদ্রতা ছিল অসহনীয়। তাই নিচে নেমে যাই একটু পরেই। এখানে আবার ইঞ্জিনের গরম আর ধোঁয়া। তাই আবার ওপরে ফিরে এসে পিছন দিকে একটি কাঠের চৌকিতে গিয়ে বসি। রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা খুলে বসলাম। ফেরিও তখন চলতে শুরু করেছে।
৪৫ মিনিট নৌযাত্রা শেষে ফেরি আমাদের পৌঁছে দিল ডুগডুগি বাজার ঘাটে। এখানে আরেক ডাকবাহকের কাছে চিঠির থলি দিলে মণ্ডল। এরপর বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন ক্যানিংয়ের দিকে।
আমি এবার পরবর্তী ডাকবাহকের সাথে একটি তিন চাকার ভ্যানে চাপলাম ছোট মোল্লাখালি যাওয়ার জন্য। ঘাট থেকে সেখানকার দূরত্ব পায় ৭ কিলোমিটার।
সাব পোস্ট অফিসের পথে হেঁটে চলার সময়ে জনপদে দুর্গাপুজোর আমেজটা ঠিকই টের পাচ্ছিলাম। বাজারে নতুন কাপড় কিনতে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়, পুজো উপলক্ষে বাড়ি ফেরা মানুষের উচ্ছ্বসিত মুখগুলিরও চোখ এড়ানোর উপায় ছিল না। কিছু দোকানে দেখলাম ক্যারোসিনের লন্ঠন। এ বস্তু একটি কেনার লোভ আমিও সামলাতে পারলাম আসলে। আসলে এককালে কোলকাতাতেও যথেষ্ট বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো। ছোটবেলার সেদিনগুলোতে ক্যারোসিনের লন্ঠনই ছিল সঙ্গী। বিদ্যুৎ নিয়ে সেই যঞ্ঝাট আজ নেই, তাই লন্ঠনও হয়ে উঠেছে মিউজিয়ামের বস্তু।
শুধু লন্ঠন নয়, ছোট্ট এই বাজার জনপদের জিনিসপত্র সংগ্রহের লোভে আরও কিনে ফেললাম কাঠের স্লেট ও চক পেন্সিল।
ব্যাটারিচালিত কিছু বাইসাইকেলও দেখলাম। জানলাম, এখানকার মানুষ এগুলি বিনা-পয়সার সৌর বিদ্যুতে চার্জ করতে পারে।
ছোট মোল্লাখালির সাব পোস্ট অফিস ও এর ১৩টি শাখায় মোট কর্মী ৪০জন। তাদেরকেই এই এলাকার ছয়টি দ্বীপে ডাকবিলির কাজ করতে হয়। সাব অফিসের পোস্টমাস্টার প্রদীপ কুমার নাইয়া জানান, সপ্তাহজুড়েই থাকে প্রচণ্ড কাজের চাপ।
দুদিন ছিলাম সেখানে। এসময় ডাকসেবা প্রত্যাশী অনেকের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, প্রত্যন্ত এই এলাকায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ থেকে থেকেই ব্যাহত হয়, তখন তারা ডাকঘরে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। আবার বেশি দেরি হলে পরে আবার আসেন।
ইতোমধ্যে বেলা তখন ১টা, ক্যানিং ছেড়ে এসেছি চার ঘণ্টা আগে। কুমিরমারির ডাক যাবে আগামীকাল সকালে। তাই হাতে যথেষ্ট সময়। নষ্ট না করে এই অবসরটা দুর্গম এলাকায় ডাক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে সেটা জানতেই কাজে লাগালাম।
এবছরেই ডাক বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন ৬৫ বছরের শশাঙ্ক শেখর ঘোষাল। কিন্তু, আজ একজন কর্মী অসুস্থ থাকায় তার বদলে তিনিই এসেছেন কাজ করতে। এই পোস্ট অফিসের এলাকায় ১২ বছর ধরে চিঠি বিলি করেছেন তিনি। পথঘাটের নাড়িনক্ষত্র তার মুখস্থ। তার হাতেই পড়লো আমার পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তার সেই চিঠি। তার সাথে পথ চলতে শুরু করলাম এবার। কখনো জমির আল ধরে, কখনো পুকুরের পাড় ধরে আবার কখনোবা সরু ইট বেছানো রাস্তায় চললো আমাদের যাত্রা। যেতে যেতে কখনো কোনো চিঠি প্রাপকের সন্ধানও আমরা চাইছিলাম স্থানীয়দের কাছে।
ঘোষ বাবু বললেন, 'মাঝেমধ্যে অনেক চিঠিতে স্থানীয় ল্যান্ডমার্কের উল্লেখ থাকে না। আবার অনেক মানুষেরই একই নাম। অনেক সময় চিঠির প্রাপক বাড়ি থাকে না, কারণ এই দ্বীপগুলির অধিবাসীরা বাড়ি থেকে অনেক দূরে কাজ করতে যায়'।
বাইসাইকেল ডায়েরিজ
পরের দিন সকাল সোয়া দশটায় কুমিরমারির অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রাঞ্চ পোস্টমাস্টার যমুনা মণ্ডল ছোট মোল্লাখালী সাব পোস্ট অফিসে এলেন। সাধারণত তিনি মোটরবোটে আসার সময় সাথে সাইকেলটিও নিয়ে আসেন। তবে আজ এই নারী হেঁটেই এসেছেন।
এবারের যাত্রাসঙ্গী আমরা চারজন। আমি, পুরকাইত, যমুনা এবং আমাদের নতুন সঙ্গী হলেন কুমিরমারির পোস্টমাস্টার অনিকেত বিশ্বাস। আমরা প্রথমে ঘাটে গিয়ে মোটরচালিত একটি নৌকায় চড়লাম। এপর পৌঁছাই ডাকবিভাগের কুমিরমারি শাখায়। এতক্ষণে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার সেই ক্ষণ এলো।
এখানকার একজন ডাকপিয়ন হলেন তাপস গায়েন। তার বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে গদি লাগানো। তাতেই চেপে বসলাম আমি। একই উপায়ে বিশ্বাস ও পুরকাইত আসতে থাকলেন আরেকটি সাইকেলে। এভাবে চলাটা বেশ কষ্টকরও বটে।
ভাগ্যক্রমে, আমার প্রথম চিঠির প্রাপক ছিলেন এক জন স্কুল শিক্ষক পবিত্র মণ্ডল। তিনি ডাক অফিসের কাছাকাছিই ছিলেন।
দ্বিতীয় প্রাপক হলেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অমল রঞ্জন সরদার। তার বাড়ি যেতে আমাদের কখনো কখনো সাইকেল থেকে নেমেও চলতে হয়েছে। ছোট্ট একটি বাজার এলাকা পেরোনোর পর পথে আর কোনো দোকানপাট চোখে পড়েনি। চারপাশে ছিল শুধু সবুজ শস্যের মাঠ। রাস্তা কখনোবা পাকা, আর কখনো ইট বেছানো। দুটি ঠিকানায় চিঠি পৌঁছাতে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো।
ডাক কর্মীরা জানালেন, এই ঠিকানাগুলি সহজ তাই এত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আরও প্রত্যন্ত অংশে যেতে দুই ঘণ্টার বেশি সাইকেলে ও পায়ে হেঁটে যেতে হয়।
কুমিরমারি দ্বীপে এখন গুটিগুটি পায়ে আসছে ডিজিটাল যোগাযোগ ও লেনদেনের ব্যবস্থা। কিন্তু, আজো মানুষের প্রধান ভরসার জায়গা ডাকবিভাগ। অমল বলেন, 'ডাকবিভাগে সঞ্চয় রেখে আমরা নিশ্চিন্তে থাকি। এই দ্বীপের ১৩টি প্রাথমিক ও দুটি উচ্চ বিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক সব ধরনের যোগাযোগ আজো ডাকের মাধ্যমে করে। ব্যাংক সংক্রান্ত লেনদেনেও আমরা ডাক সেবা ব্যবহার করি।
এই দ্বীপের অনেক মানুষই দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর বেঙ্গালুরু শহরে কাজ করেন। সেখান থেকে টাকা পাঠান বাড়িতে।
'বেসরকারি কুরিয়াররা পার্সেল নিয়ে এলে তারা আমাদের নদীর ওপাড়ের ঘাটে যেয়ে ডেলিভারি নিতে বলে। এটা খুবই সমস্যা। সরকারি সেবা তার চেয়ে অনেক ভালো'।