কোভিডের সুলভ চিকিৎসায় কুষ্টিয়ার চিকিৎসকের আমেরিকায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ফার্মা
২৭ অক্টোবর, ঘড়িতে সময় রাত ৯টা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ওয়ারেনে টেভোজেন বায়োর প্রধান কার্যালয় থেকে মার্কেটিং টিমের সদস্যরা সবার শেষে বের হলেন। তবে অফিস তখনও পুরো খালি হয়নি! ফাঁকা অফিসে বসেই কাজ করছিলেন বায়োটেক কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সিইও ডা. রায়ান সাদী। অফিস থেকে সাদীর বাসার দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটারের মতো, কিন্তু রাত তিনটার আগে তার বাড়ি যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আগামীকাল কোম্পানিটি টেভোজেন ৪৮৯ নিয়ে গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিতে যাচ্ছে। বয়স্ক ও উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য এটি তাদের সবচেয়ে বিশেষায়িত পণ্য। কোভিড-১৯-এর অন্যান্য চিকিৎসা থেকে এর চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। টেভোজেন ৪৮৯ জেনিটিক্যালি অপরিবর্তিত টি সেল ব্যবহার করে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোমকে টার্গেট করে, বিশেষত ভাইরাসের যে অংশগুলোর পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা কম সেসব অংশে টার্গেট করা হয় বলে প্রায় সব ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধেই এই থেরাপি কাজ করে।
'ভয় হচ্ছে এবারের শীতটা কঠিন হবে। তবে এই শীতেই রোগীদের কাছে টেভোজেন ৪৮৯ পৌঁছে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমরা,' বলেন ডা. সাদী। ক্লিনিকাল ট্রায়ালে ইতোমধ্যেই জানা গেছে এটি নিরাপদ। এখন পণ্যটির দ্রুত বিকাশ ও উৎপাদনের জন্য যত বিকল্প উপায় আছে সবকিছু নিয়ে গবেষণা করছে টেভোজেন বায়ো।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠা ডা. সাদী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক ও উদ্যোক্তা। ১৯৯২ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান সাদী। এর আগে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিনে পড়াশোনা করেন। কয়েক সপ্তাহ আগেও বাংলাদেশিরা ডা. সাদীর সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না। তার বন্ধু শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, ডা. সাদী ও টেভোজেন বায়ো স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। এরপরই ছড়িয়ে পড়ে তার নাম।
প্রায় দুই দশক বড় বড় ফার্মা কোম্পানিতে কাজ করার পর ২০২০ সালের জুন মাসে টেভোজেন বায়ো প্রতিষ্ঠা করেন সাদী। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক। টেভোজেন বায়োর কোনো পণ্যই আসলে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয় না। তারপরও প্রতিষ্ঠানটির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪.২৫ বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলো?
এর একটি কারণ হলো টেভোজেন বায়োর তৈরি নিরাপদ টি সেল। টি সেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সহজাত অংশ। আমাদের কোষে সংক্রমণের পর একমাত্র টি সেলই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। বিভিন্ন রোগে ইতোমধ্যে টি সেল থেরাপির ব্যবহার দেখা গেলেও এর দাম যেমন বেশি, তেমনি ব্যবহারও সীমিত, কেননা থেরাপিটি নিজেই অনেকসময় শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তবে ট্রিটমেন্টটাই পুরো বিষয় নয়। টেভোজেন বায়ো মূল যে আকর্ষণ তৈরি করেছে তা হলো তারা নাটকীয়ভাবে এই চিকিৎসার খরচ কমিয়ে আনার আশা দেখিয়েছে। যার ফলে অসংখ্য মানুষ সহজেই এই চিকিৎসা নিতে পারবে। একইসঙ্গে কোম্পানির জন্যও লাভ করা সহজ হবে।
ক্লিনিকাল ট্রায়াল সম্পন্ন করতে টেভোজেন ৪৮৯-এর প্রায় ১৮ মাস সময় লেগেছে, যেখানে অধিকাংশ ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের ট্রায়ালে ৭ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়। অন্যদিকে, কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের বিকাশে সাধারণত ২.৬ বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়। অথচ ডা. সাদীর ভাষায়, টেভোজেনের জন্য এর খুব ছোট্ট একটি অংশের প্রয়োজন পড়েছিল। সত্যি বলতে কী, ডা. সাদীর কাছে (আটটিসহ) যে তিনটি পেটেন্ট আছে, সেগুলো 'উৎপাদন ক্ষমতা কমানোর ওপরই'।
এছাড়া টেভোজেন ৪৮৯ সহজলভ্য চিকিৎসা। এর জন্য বিশেষায়িত কোনো হাসপাতালে থেরাপি নিতে হবে না। যেকোনো ডাক্তার এটি প্রেসক্রাইব করতে পারবেন।
'আমি আসলে এমন কিছু বানাতে চাই না যার জন্য রোগীদের আধামিলিয়ন ডলার খরচ পড়বে। কিন্তু দাম ঠিকমতো নির্ধারণ না করলে আমার নিজের ব্যবসাই গুটাতে হবে। এটা উভয় সংকট,' বলেন সাদী।
'ওষুধের খরচ কমাতে আমাকে বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। তাছাড়া আমি ১০-১৫ বছর সময়ও নিতে পারছিলাম না। যা করার, আমাকে তাড়াতাড়ি করতে হতো। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর আমাদের পণ্যের মূল্য এখন সবার হাতের নাগালেই থাকবে,' বলেন তিনি।
কুষ্টিয়া থেকে বিগ ফার্মায়
ডা. সাদী ও টেভোজেন বায়ো উভয়েই এখন যুক্তরাষ্ট্রের বায়ো-টেক ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে আলোচিত নাম। প্রতিষ্ঠানটি পণ্যকে শুধু লাভজনক সুলভ ও কার্যকর করার প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছে না, তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান বৈষম্যের ওপরও আলোকপাত করেছে।
বড় ফার্মাগুলো সাধারণত বৈষম্যের কথা বিবেচনা করে না। এমনকি তারা শোষণমূলক কাজের জন্য সমালোচনার শিকারও হয়ে থাকে। দুই দশক ধরে এহেন ফার্মা জগতের সদস্য হয়েও ডা. সাদীর মাথায় কীভাবে বৈষম্য দূরীকরণের চিন্তা এল?
ডা. সাদী আসলে এই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন নিজ জন্মভূমি থেকে। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়, সাদীর বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। যুদ্ধ শুরুর পর সেই বিভীষিকার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি।
তিনি জানান, 'যুদ্ধে আমার ১১ মামাকে হারিয়েছি—আমার নানার পরিবারের প্রায় সবাইকে। আমিও ছিলাম এই হত্যাযজ্ঞের মাঝে। আসলে ওরা আমাকে দুবার গুলি করেছিল।'
সাদীর ছেলেবেলা কেটেছে কুষ্টিয়ায়—যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ আর দারিদ্র্যের মধ্যে। সেসময় বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ, 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা পেত বাংলাদেশ। সেই স্মৃতিই ডা. সাদীর মনে এতকাল পরেও রয়ে গেছে।
'অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা বাস্তবে রূপ নিত না, যদি না শেখ মুজিব পুরো জাতিকে তার সামর্থ্য বোঝাতে পারতেন। অধিকাংশ মানুষ বর্তমান বাংলাদেশকে মিরাকল বলে। কিন্তু আমি দেখতে পাই একজন নেতার দূরদর্শিতা, যিনি প্রত্যেককে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছিলেন,' বলেন তিনি।
গত আড়াই দশকে ডা. সাদী সানোফি, জেনযাইম, জনসন অ্যান্ড জনসন, সিএসএল বেরিং-এর মতো বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসে স্পেশাল ইউএস গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি হিসেবেও কাজ করেছে। এখনও ফার্মা নিয়ে কাজ করে যাওয়া ডা. সাদী হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। আর সেটাই তাকে আজ টেভোজেন বায়ো প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়ে এতদূর নিয়ে এসেছে। শুধু ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদনই নয়, নাটকীয়ভাবে খরচ কমিয়ে আনাতেও তাই তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
'বিনয় দেখাচ্ছি না, কিন্তু যখন ভাবি তখন মনে হয় আমার তো এই অবস্থায় আসার কথা ছিল না। তখনকার সবচেয়ে দরিদ্র দেশে ছেলেবেলা কাটানো মানুষটিই ইয়েল-হার্ভার্ডে পড়াশোনা করে বিশ্বের ৫১টি দেশে কাজ করেছে, ৯টি দেশে থেকেছে। আসলে নিয়তি আমার প্রতি সহায় ছিল,' বলেন রায়ান সাদী।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মতো
মাত্র দুই বছরে ডা. সাদীর স্টাডি রুম থেকে মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন জায়গায় টেভোজেন বায়োর চারটি শাখা গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে রয়েছে ফিলাডেলফিয়ায় টেভোজেনের গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) কেন্দ্র, যার নেতৃত্বে আছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টি সেল বিশেষজ্ঞ ডা. নিল ফ্লোমেনবার্গ।
ডা. সাদী ও ড. ফ্লোমেনবার্গ দুজনেই মেডিসিনের ক্যান্সারবিষয়ক অনকোলজি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ছিল ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের আরও ভালো, দ্রুততর ও সুলভ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যার ঘাটতি ব্যাপকভাবে প্রতীয়মান।
'সত্যি বলতে কী, ক্যান্সারের যেসব চিকিৎসা আছে, সেগুলো নিয়ে আমি কখনোই সন্তুষ্ট ছিলাম না। বেশিরভাগই চিকিৎসায়ই চড়া খরচে রোগীদেরকে কয়েক মাস বাঁচিয়ে রাখা হয়। তাই আমরা আরও ভালো থেরাপি নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম,' ডা. সাদী জানান। টেভোজেন বায়ো অল্প সময়ের মধ্যেই একটি অনকোলজি ও নিউরোলজি পাইপলাইন গড়ে তোলে। কিন্তু তারপরই শুরু হয় কোভিড মহামারি।
'আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের পদ্ধতি কোভিডেও কার্যকর হতে হবে,' ডা. সাদী বলেন।
তো এই পদ্ধতিটা কী?
সিডিএইটপ্লাস টি-লিম্ফোসাইট—যা সাইটোটক্সিক বা কিলার টি কোষ নামেও পরিচিত—রোগের বিরুদ্ধে প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। টেভোজেন বায়োর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফ্লোমেনবার্গ জানান: আমরা যখন কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হই, তখন আমাদের দেহ সাইটোটক্সিক টি কোষগুলোর একটি গ্রুপকে প্রসারিত করে তা থেকে মুক্তি পায়।
পরে এক জুম মিটিংয়ে ড. ফ্লোমেনবার্গ বলেন, 'সাইটোটক্সিকের আক্ষরিক অর্থ হলো, হত্যা করতে সক্ষম…মাদার নেচার বলে যে, এই কোষগুলোকে আমার মেরে ফেলতে হবে। ব্যাপারটা ভাইরাস উৎপাদনের কারখানাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো।' অন্যান্য সব চিকিৎসাই ভাইরাসকে ধীর করে দিয়ে ভাইরাস ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যকার প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য বাড়তি সময় আদায় করে দেয়।
কেবল কিছু সীমিতসংখ্যক সিএআর-টি বিকল্প ছাড়া—যাতে আবার রোগীপিছু আধ মিলিয়ন এবং সব মিলিয়ে ১.৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়—আজতক এই কোষগুলোর পূর্ণ সম্ভাবনা ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৬ হাজার হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ৬টি হাসপাতালের সিআর-টি দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
তাছাড়া খোদ এই থেরাপিই খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। টেভোজেন বায়ো টিমের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল নিরাপদ টি কোষ তৈরি করা। এবং তারা টি কোষগুলোকে জেনেটিক্যালি মডিফাই না করেই কাজটি করার উপায় আবিষ্কার করেছে।
ড. ফ্লোমেনবার্গ বলেন, 'টেভোজেন ৪৮৯ একটি অ্যালোজেনিক পণ্য। অর্থাৎ এটি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে যেতে পারে। পণ্যটি ব্যক্তির নিজ কোষ থেকেই উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে অটোলোগাস পণ্য এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে যেতে পারে না।
'একজন ডোনার থেকে আমরা মূলত একাধিক—তিন বা ততোধিক—ব্যক্তির জন্য পণ্য তৈরি করতে পারি। এর ফলে চিকিৎসার ব্যয় একাধিক ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যাচ্ছে।'
ড. ফ্লোমেনবার্গ বলেন, প্রথমদিকের ট্রায়ালগুলোতে তারা ইচ্ছা করেই একজন ডোনারের কাছ থেকে যথাসম্ভব কম ডোজ রেখেছেন, যাতে তারা 'স্বচ্ছন্দ' থাকতে পারেন। তবে ড. ফ্লোমেনবার্গ ও তার সহকর্মীরা আত্মবিশ্বাসী যে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও পরীক্ষা করার পর ডোজ অনেক বাড়ানো যাবে। 'সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, একজন ডোনারের কাছ থেকে আমাদের ১০০টির বেশি ডোজ পাওয়া যাওয়ার কথা।'
টেভোজেন বায়ো তাদের মনোযোগ কোভিডের ওপর সরানোর পর বুঝতে পারে যে, শুধু স্পাইক প্রোটিন দিয়ে ভাইরাসের মিউটেশনাল চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
ড. ফ্লোমেনবার্গ বলেন, 'কোভিড-১৯ হলো মিউটেশনপ্রবণ আরএনএ ভাইরাস। আর আমরা ইতিমধ্যে এমন সব ভেরিয়েন্টের দেখা পেয়েছি যেগুলোর ইমিউন সিস্টেমকে, বিশেষ করে স্পাইক অঞ্চলে ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা থাকার সম্ভাবনা আছে। তাই নিল আর আমি যা করলাম, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রিসোর্স আর সময় ব্যয় করলাম গোটা ভাইরাল জিনোমে টিভিজিএন ৪৮৯ টার্গেট খুঁজে বের করার জন্য, বিবর্তনীয় চাপে যেগুলো মিউটেট হওয়ার সম্ভাবনা কম।
'টেভোজেন ৪৮৯ নিয়ে যা করছি, তা হলো, আমরা ফিনিশিং লাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা এমন একজনের কাছ থেকে কোষ নিচ্ছি, যিনি ইতিমধ্যেই কোভিডে আক্রান্ত এবং ইতিমধ্যেই এর বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করেছেন। আমরা কোষগুলোকে ল্যাবে জমাচ্ছি এবং বাড়াচ্ছি, আর মানুষকে অত্যন্ত পরিশোধিত কোষ দিচ্ছি পণ্য হিসেবে।'
টেভোজেন বায়ো অন্য যে উদ্ভাবনটি নিয়ে এসেছে সেটি হলো, টার্গেট-স্পেসিফিক হওয়ার সক্ষমতা।
ডা. সাদী বলেন, 'আপনার শরীরে যদি ক্যান্সার বা সংক্রমণ তৈরি করা পাঁচটি কোষ থাকে, তাহলে এটি কেবল ওই কোষগুলোকেই টার্গেট করবে এবং মেরে ফেলবে। এবং কাজটি করা হয়ে গেছে। এটি বাকিদের কাজে বাগড়া দেয় না। আর আমাদের শরীর সুস্থ কোষ দিয়ে মৃত কোষগুলোকে প্রতিস্থাপন করবে।'
বড় বড় ফার্মা কোম্পানিগুলোতে দুই দশক কাজের সুবাদে কোনো পণ্য কীভাবে শূন্য থেকে উৎপাদন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হয় তার সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন ডা. সাদী। এ কাজটা খরুচে, সময়সাপেক্ষ, এবং এখানে ব্যর্থতার হার ৯০ শতাংশ পর্যন্তও হতে পারে।
'মানুষ কোনোকিছু না ভেবেই বলে বসে, বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কেবল সুবিধা নিতে চায়। কিন্তু কথাটা ঠিক না,' তিনি বলেন।
'আমি একটি বড় ফার্মা কোম্পানির নির্বাহী। আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। তাই আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম আমাদেরকে ঔষধ উন্নয়ন ও উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আনতে হবে।'
সুস্পষ্ট কারণেই ডা. সাদী এ বিষয়ে বেশি বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে পারেননি। কিন্তু সরস হাসি দিয়ে তিনি বলেন, 'এটা তো সহজ, তা-ই না? বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কথা ভাবুন।'
আচমকা দরপতনের হলেও পোশাক শিল্পের মতোই টেভোজেন বায়োও ভালো প্রফিট মার্জিনের সম্ভাবনা দেখছে। সাদীর ভাষায়, টেভোজেনের অনুমিত ব্যবসা মডেল কোম্পানিটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে লাভজনক বায়োটেক কোম্পানিগুলোর একটিতে পরিণত করবে।
আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা
ডা. সাদীর অনুপ্রেরণার কিছুটা এসেছে তার জন্মভূমি থেকে। বাকিটা এসেছে দ্বিতীয় দেশ আমেরিকাকে কিছু দেওয়ার তাগিদ থেকে। মেডিকেল পেশাজীবি ও ফার্মা নির্বাহী হিসেবে ক্যারিয়ারজুড়ে মার্কিন স্বাস্থ্যসেবায় বিদ্যমান বৈষম্য দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট চার ট্রিলিয়ন ডলার। যা জার্মানির পুরো জিডিপির সমান। তারপরও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ১৯৮০-র দশকের পর প্রত্যাশিত গড় আয়ু শুধু কমেছে। স্বাস্থ্যসেবার খরচ বাড়লেও, এর ফলাফলে উল্টো চিত্র দেখা গেছে।
'জীবনে অনেক কিছুরই বিকল্প আছে। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারটা মানুষের ব্যয় করার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। মৌলিক সেবাগুলো সহজলভ্য হতে হবে। এটাই তো সমতা, তা-ই না?'
তাই ওষুধের খরচ কমাতে পারে, এমন ব্যবসা মডেল খুঁজতে শুরু করেন ডা. সাদী। একদিন একইভাবে তিনি মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার খরচের সমস্যাও সমাধান করতে চান।
স্ত্রী জুডি ও মেয়ে এমিলিকে নিয়ে সাদীর পারিবারিক জীবন। জুডি পেশায় ডেন্টাল সার্জন। জুনিয়র কলেজে থাকতে তার সঙ্গে পরিচয় হয় সাদীর। বাংলাদেশে পরিবার বলার মতো সাদীর বিশেষ কিছু নেই। তবে যেদিনই আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছেন, সেদিন থেকেই দেশটি তাকে দুহাত ভরে দিয়েছে।
'আমি যখন ইয়েলে আসি, তখন খুব ভালো ইংরেজিও বলতে পারতাম না। মার্কিনীদের ইংরেজিও খুব একটা বুঝতে পারতাম না। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কষ্ট হতো। কিন্তু যেমনটা দেখছেন, আমি কথা বলতে বেশ পছন্দ করি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে অনেক বন্ধুও বানিয়ে ফেলি। ওদের অনেকেই আমার শিক্ষক ছিলেন, কেউ কেউ এখন বোর্ড মেম্বার। তারা সবচেয়ে উদারমনের মানুষ,' সাদী বলেন।
'শুনতে অস্বাভাবিক মনে হয় না কুষ্টিয়া থেকে উঠে আসা একটা ছেলে হার্ভার্ড, ইয়েলে পড়ে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে? এটা একটা আমেরিকান গল্প; কেবল আমেরিকাতেই আপনি এমন জিনিস দেখতে পাবেন। আমেরিকা এমনভাবে তৈরি যেটা মানুষকে এগিয়ে যেতে, চেষ্টা করতে প্রেরণা জোগায়। পদে পদে আমার এ অভিজ্ঞতাটা হয়েছে। যার কাছেই কোনো কিছুর জন্য গিয়েছি, কেউ কখনো ফিরিয়ে দেয়নি।'