প্রাচীন যেসব উদ্ভাবন বিজ্ঞান এখনো ব্যাখ্যা করতে পারে না, তালিকায় রয়েছে ভারতবর্ষের আবিষ্কারও
প্রযুক্তি দিনে দিনে উন্নততর হতে থাকে বলেই আমরা জানি ও মানি। সেই আদিমকালের মানুষদের সাধারণ হাতিয়ার থেকে শুরু হয়ে আজকের দিনের স্বচালিত গাড়ি; এভাবেই বিবর্তন ঘটেছে প্রযুক্তির। কিন্তু তা-ই বলে সব প্রাচীন আবিষ্কারগুলোই কি এ সময়ে এসে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দিক থেকে একেবারেই সেকেলে হয়ে গেছে?
এর উত্তর হচ্ছে- না। প্রাচীনকালেও মানুষ এমন সব আশ্চর্যকর যন্ত্রপাতি তৈরি করেছেন যার পেছনের কারিগরি দেখলে আজও বিজ্ঞানী ও উদ্ভাকদের মুখ হাঁ হয়ে পড়ে। এমন কয়েকটি আবিষ্কারেরই খবর জানিয়েছে স্টারস ইনসাইডার।
এসব সুপ্রাচীন উদ্ভাবনের কারিগরি দিক দেখলে মনে হয় এগুলো সে সময়ে একেবারে আচানক আকাশ থেকে মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে। অনেকগুলো আবিষ্কার মানুষ কীভাবে করেছিলেন সেটা জানতে এখনো ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু কিছু তথ্য যেন ইতিহাসের গোপন অন্দরে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন কয়েকটি অবাক করে দেওয়া প্রাচীন আবিষ্কারের কথা।
গ্রিক ফায়ার
১৭ শতকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগরের পূর্ব থেকে আগত দস্যুদের আক্রমণের মুখে পড়ে। বাইজেন্টাইনদের কাছে সৌভাগ্যজনকভাবে একটি গোপন অস্ত্র ছিল। এ অস্ত্রের নাম গ্রিক ফায়ার। শত্রুর জাহাজের ওপর 'সাইফন' নামক একটি যন্ত্রের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে দেওয়া হতো।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গ্রিক ফায়ার পানিতেও জ্বলতে পারত। বিজ্ঞানীরা এখনো জানতে পারেননি এ আগুন কী দিয়ে তৈরি করেছিলেন প্রাচীন উদ্ভাবকেরা। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ আগুনও হারিয়ে যায়। তারপর আর কখনো এটি তৈরি বা ব্যবহার করা হয়নি।
দামেস্কের ছোরা
হাল আমলের অনেকে ছুরি ও তরোয়াল দামেস্কের স্টিল দিয়ে তৈরি বলে দাবি করা হয়। কিন্তু কিংবদন্তিতুল্য দামেস্কের স্টিলের সমতুল্য কোনোটিই নয়। ক্রুসেডের সময়কালে বিভিন্ন ঘটনায় দামেস্কের স্টিল দিয়ে তৈরি ছুরি ও তরোয়ালের কথা জানা যায়।
লেভান্তের এ স্টিল ছিল অন্য যেকোনো স্টিলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এটি থেকে তৈরি অস্ত্র হতো অবিশ্বাস্যরকম ধারালো ও নমনীয়। অথচ নমনীয় হওয়া সত্ত্বেও এটির ক্ষয় করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
এ ধাতুর সক্ষমতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে: এটি ভাসমান রুমাল কেটে দুটুকরা করতে পারত, ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত বাঁকা হতে পারত এবং কোনো ক্ষতি ছাড়াই আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারত। এখন পর্যন্ত কেউ এ ছুরির স্টিল আর তৈরি করতে পারেননি।
অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম
১৯০১ সালে ভূমধ্যসাগরের তলদেশ থেকে একটি অদ্ভুতদর্শন যন্ত্র উদ্ধার করা হয়। অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম হিসেবে পরিচিত এ যন্ত্র তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় শতকের গ্রিসে।
ধারণা করা হয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবনিকাশ করার জন্য এ যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। তবে এখনো কেউ জানতে পারেনি এটি কারা তৈরি করেছেন বা কীভাবে তৈরি করা হয়েছে। কারণ এ যন্ত্র পৃথিবীতে যখন ছিল, তার পরবর্তী ১০০০ বছরে এর মতো জটিল যন্ত্র আর দেখা যায়নি।
প্রথম সাইসমোস্কোপ
চীনে আনুমানিক ১৩২ সালে ঝ্যাং হেং-এর সাইসমোস্কোপ যন্ত্র তৈরি করা হয়। এ ধরনের যন্ত্রের মধ্যে এটিই প্রথম ছিল বলে মনে করা হয়। এ যন্ত্র অবিশ্বাস্য নির্ভুলতায় ভূমিকম্প কোন দিকে হচ্ছে তা নির্দেশ করতে পারত।
সময়ের অনেক আগে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে চীনার। তাই ইতিহাসবিদেরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি এত আগে কীভাবে এমন যন্ত্র মানুষ তৈরি করতে পেরেছিল।
যন্ত্রটির প্রতিটি ড্রাগন একটি প্রধান কম্পাস দিক নির্দেশ করত। কোনদিকে ভূমিকম্প হচ্ছে তা নির্দেশ করার জন্য ওই দিকের ড্রাগনের মুখ থেকে একটি বল নিচে বসে থাকা ব্যাঙের মুখে পড়ত।
দিল্লির লৌহস্তম্ভ
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত ৭.২১ মিটার লম্বা একটি পিলার ৪র্থ শতক থেকে সেখানে অবস্থান করছে। এর বিশেষত্ব হলো, এত বছর এভাবে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পরও এ পিলারের গায়ে কোনো মরিচা নেই।
এমন ঘটনায় বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। অনেকে মনে করেন, দিল্লির শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এ পিলারে মরিচা ধরে না। আরেকদল বিশ্বাস করেন, পিলারটির অনন্য উপাদানই এটিকে মরিচার হাত থেকে রক্ষা করছে।
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি
ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় বই ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি। ১৯১২ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়।
১৫ শতকে এ বই লিখা হয়েছে বলে জানা যায়। এ বইটি এমন ভাষায় লিখা হয়েছে যা এখন পর্যন্ত কেউ পড়তে পারেনি।
রেনেসাঁর সময় ইতালিতে এটি রচিত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। বিভিন্ন উদ্ভিদের আপাত-বৈজ্ঞানিক ছবি আঁকা আছে বইটিতে। তবে প্রকৃতিতে এসব উদ্ভিদের কোনো অস্তিত্ব নেই।
ভারতীয় উড্ডয়নযন্ত্র
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমান আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন লেখায় উড়তে সক্ষম এমন বস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটি হচ্ছে রুক্ম বিমান। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে ভারতীয় বৈদিক গ্রন্থ রুক্ম বিমান লেখা হয়।
এটি লিখেছেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। তার গ্রন্থে এ যন্ত্রের চিত্রও পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন এগুলো কীভাবে চালাতে হয়। এমনকি প্রয়োজনে সৌরশক্তি ব্যবহার করে কীভাবে এ বিমান চালানো সম্ভব তাও বর্ণনা করেছেন তিনি।
সুপ্রাচীন পারমাণবিক যুদ্ধ
কুরু এ পাণ্ডবদের মধ্যকার যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে মহাভারত-এ। অনেকে মনে করেন, মহাভারত-এ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের যে বর্ণনা রয়েছে তা বাস্তবে ঘটেছে।
মহাভারত'র কিছু যুদ্ধের বর্ণনার সঙ্গে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে মিল রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে মহাভারত-এ অসংখ্য প্রাণক্ষয়ের কথা অনেকবার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এমটা শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে গবেষণা করে দেখা গেছে, এখানকার প্রাচীন বাসিন্দাদের মধ্যে ক্যান্সার ও খুঁত নিয়ে জন্ম নেওয়ার অস্বাভাবিক রকমের হার ছিল। ইতিহাসবিদ বা বিজ্ঞানীরা, কেউই এ রহস্যের কিনারা করতে পারেননি।
চিকিৎসক সুশ্রুত
নবম শতকের ভারতীয় চিকিৎসক ছিলেন সুশ্রুত। তিনি শল্যচিকিৎসার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। নিয়মিত রোগীদের অস্ত্রোপচার করতেন সুশ্রুত।
তার সময়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগ ভালো করা মিরাকল বলেই মনে হওয়ার কথা। নিজের গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতায় অনেক অস্ত্রোপচারের বিবরণ লিখে গেছেন তিনি।
সুশ্রুত এমন সব অস্ত্রোপচার করেছেন যা আজকের দিনেও জটিল বলে মানা হয়। তার অস্ত্রোপচারের মধ্যে ছিল ছানির অস্ত্রোপচার, নাকের পুনর্গঠন, ও এমনকি প্রস্থেটিক সার্জারিও।