ঢাকার 'উইন্ড পকেট'-এর পেছনের বিজ্ঞান
কয়েক বছর আগের কথা। খিলগাঁওয়ের একটি ভাড়া বাসায় ছয় বন্ধু নিয়ে থাকতেন দেলোয়ার। সবাই-ই বেকার, চাকরির জন্য গাইড বই মুখস্থ আর নিজেদের খরচ মেটানোর জন্য প্রাইভেট টিউশন, এভাবেই চলছিল তাদের জীবন। কথায় কথায় জানালেন, কয়েকবছর আগের গ্রীষ্মের মে মাসের এক রাতের কথা, লোডশেডিং আর তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছিলেন সবাই।
দেলোয়ারের পক্ষে আর সম্ভব হলো না ওই বাসায় থাকা। বাতাসের অভাবে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাদের সবার, তাই বন্ধুদের নিয়ে বের হয়ে গেলেন রাস্তায়। তিলপাপাড়ার রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলেন তারা।
কয়েক বছর ধরে একই এলাকায় থাকায়, দেলোয়ারের জানা ছিল সবসময়ই বাতাস থাকে এই রাস্তায়। এবং তার অনুমানই সঠিক, তিন রাস্তার মোড়ের ফুটপাতে বসার পরই উত্তরপশ্চিম দিক থেকে স্বস্তির বাতাস বইতে থাকল।
তবে তিন রাস্তার মোড় হওয়াতেই যে বাতাস বইছিল, বিষয়টা এরকম না; কয়েকশো ফুট দূরে চারটে রাস্তার সংযোগস্থল থাকলেও সেখানে এরকম বাতাস ছিল না।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেলোয়ার বলেন, 'আগের দিনে ঢাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং হতো। আমরা গ্রীষ্মের অনেক রাতই তিলপাপাড়ার সেই তিনরাস্তার মোড়ে কাটিয়েছি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি এবং মজা করেছি'।
'এমনকি এখনও গরমের সময় মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে ওই মোড় ঘুরে তারপর বাসায় আসি। যদিও বিবাহিত জীবনে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে কাটানোর সুযোগ নেই', যোগ করেন তিনি।
শুধু খিলগাঁওয়ে নয়; শহরের অন্যান্য অংশ গরম ও আর্দ্র থাকলেও ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থান আছে যেখানে এরকম মৃদু বাতাস বয়ে যায়। এরকম জায়গাগুলোকে 'উইন্ড পকেট'ও বলা হয়ে থাকে।
বাংলামোটরের হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের রোডের পাশে এরকম একটি উইন্ড পকেটের দেখা মিলবে। বাংলামোটরের দিকে মুখ করে যতবার এই রাস্তা দিয়ে যেতাম ততবারই একটা সতেজ বাতাস অনুভব করতাম।
হাসপাতালের গেটের নিরাপত্তারক্ষীরাও আমার সাথে একমত। তাদের মধ্যে একজন বলেন, 'এই রাস্তার ধারে পাহারা দেওয়ার মজাই আলাদা। সবসময় বাতাস থাকার কারণে আমার এখানে ফ্যানেরও দরকার নেই'।
এই উইন্ড পকেটগুলোর পেছনে অদ্ভুত ঘটনাটি বোঝার জন্য আমরা কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতিদের সাথে কথা বলি।
নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান বলেন, দুটি সহজ কারণে এমনটা হয়ে থাকে। একটিকে ফানেলিং ইফেক্ট বলা হয়—কিছু বাতাস ফানেলের মতো সেখানে জমা হয়। দুই, ওই এলাকায় কোনো কারণে এয়ার টার্বুলেন্স তৈরি হয়েছে। এটি আশেপাশের বিল্ডিং এবং বায়ু প্রবাহের কারণে ঘটতে পারে।
শামসুজ্জামান বলেন, 'এটা পরিকল্পিতভাবে ঘটে না বরং দৈবক্রমে তৈরি হয়। এবং এটি সর্বদা ভালো হয় না কারণ উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে অনেক সময় এ ধরনের বাতাস একটু বেশি গতিতে বইতে পারে'
বিষয়টির পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণ ব্যাখ্যা করেন স্থপতি নুরুন্নাহার মিলি। তিনি বলেন, 'দেখুন, বাতাস সর্বত্র আছে। ব্যাপারটাকে নদীর পানির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রবাহিত নদীর কোথাও কোনো কারণে অবরুদ্ধ থাকলে, যেখানে খোলা থাকে সেখান দিয়ে জোরে প্রবাহিত হয়। বাতাসের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই'। এখানে একটা পুশ অ্যান্ড পুল ফ্যাক্টর আছে বলে জানান তিনি।
'একটি বাড়িতে, আপনি প্রতিটি জানালা দিয়ে বাতাস পাবেন না। তবে কিছু জায়গায় বায়ু প্রবাহ ভালো হয়। যখনই এবং যেখানে এই পুশ-পুল প্রক্রিয়াটা ঘটে, অর্থাৎ বাতাসের টান বেশি থাকে সেখান দিয়েই বেশি বাতাস প্রবাহিত হয়,' নুরুন্নাহার বলেছিলেন।
'আপনি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এটি তৈরি করতে পারেন, কিন্তু আমরা তা করি না'।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও শেলটেকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ নাজমুল আহসান এর পেছনে বাতাসের অ্যারোডাইনামিক্সের কথা জানালেন।
তিনি বলেন, দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব বা কখনও কখনও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বায়ু আমাদের দেশে প্রবেশ করে। কিন্তু ঢাকার এই সংকীর্ণ এলাকায় একের পর এক ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
তাহলে শহরে হাওয়া ঢুকবে কী করে? যা ঘটে তা হলো— বাতাস ঢাকা শহরের দালানগুলোর মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে প্রবাহিত হতে থাকে, এতে বাতাসের একটা চ্যানেল তৈরি হয়। এবং ভবনগুলোর বাধার ওপর নির্ভর করে কোনো স্থানে বাতাস জোরে প্রবাহিত হয়, কোনো স্থানে কম।
'উদাহরণস্বরূপ, আমার অ্যাপার্টমেন্টটি উত্তরপূর্ব দিকে মুখ করে থাকায়, এদিক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেশি বাতাস আসার কথা না। কিন্তু পাশের ভবনে বাধা পেয়ে অন্যদিকের প্রবাহিত বাতাস আমার ভবনের মধ্য দিয়ে আসে', বলেন নাজমুল আহসান।
'এটি [বায়ু প্রবাহ] ভবনের নকশা তৈরিতেও ভূমিকা রাখে। ধরুন একটি বিল্ডিং উত্তরপূর্ব দিকে মুখ করে আছে, তবে এর উত্তর দিকটি প্রসারিত করে এমনভাবে ডিজাইন করা যেতে পারে যাতে বাতাস সর্বদা এতে প্রবেশ করে। স্থপতিরা এরকম কিছু আকর্ষণীয় ইম্প্রোভাইজেশন ডিজাইন করতে পারেন', যোগ করেন তিনি।
আপনি যদি ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর বা আগারগাঁওয়ের মতো এলাকাগুলো ঘুরে দেখেন তবে সবসময় বাতাস বয়ে থাকে এমন রাস্তার দেখা পাবেন।
স্থপতি নুরুন্নাহার মিলি বলেন, 'কিছু এলাকার রাস্তা বেঁকে যায় বা সরু হয়ে যায়, যা বাতাসকে বাধা দেয় এবং চাপ তৈরি করে।
'আপনি এটিকে বায়ুচাপের পরিবর্তন হিসেবে ভাবতে পারেন। ঘূর্ণিঝড় কীভাবে তৈরি হয়? এর জন্য আলাদা চাপের প্রয়োজন হয়। এখানেও, একটি নির্দিষ্ট চাপ রয়েছে যা বাতাসকে একটি নির্দিষ্ট দিকে টানে', ব্যাখ্যা করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই নির্দিষ্ট জায়গাটি বাতাসের প্রবাহ পায়। এবং এটি এভাবেই থাকবে যতক্ষণ না উল্লেখযোগ্য জলবায়ু / ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন না ঘটে'।
ভাবানুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন