উটের বদলে বিমান! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে বিমানের মালিক হলেন বিকানেরের রাজা!
বিকানেরের ষোড়শ শতাব্দীর জুনাগড় দুর্গ এবং জাদুঘরের বিক্রম বিলাস দরবার হলে হঠাৎ করে ঢুকলে একটি অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে। একটি ডিএইচ.৯ (ডি হ্যাভিল্যান্ড), প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক বোমারু বিমান। দুর্গের বাকি অংশ এবং জাদুঘরের সাথে এর কোনো মিলই নেই। সাতটি প্রাসাদ, উঠান, প্যাভিলিয়ন এবং ঐতিহ্যবাহী রাজপুত স্থাপত্য এবং শিল্পকর্ম সমন্বিত ব্যালকনি মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দিলেও হঠাৎ করে এই বিমান দর্শনার্থীদেরকে আধুনিক যুগে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
১৫৮৯ থেকে ১৫৯৩ সালের মধ্যে বিকানেরের তৎকালীন শাসক রাজা রায় সিং নির্মাণ করেছিলেন এই জুনাগড় দুর্গ। তারপর থেকে প্রতিটি মহারাজাই তাদের নিজ নিজ রাজত্বকালে এই দুর্গে নতুন কিছু সংযোজন করেছেন। ১৯০২ সালে, রাজপরিবার লালগড় প্রাসাদে চলে আসে এবং জুনাগড় একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হয়ে ওঠে। ২০০০ সালে দুর্গের একটি অংশকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়, যেখানে রাজপরিবারের ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্তু এবং আসবাবপত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। রাজপরিবারের দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল তা এ থেকে বোঝা যায়। সেদিক থেকে বিক্রম বিলাস দরবার হলের প্রদর্শনীগুলো তাই রাজপুত ইতিহাসের একটি কম পরিচিত অংশকে নির্দেশ করে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে তাদের উটারোহীর (ক্যামেল ক্যাভালরি) ভূমিকা।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মহারাজা গঙ্গা সিং উট রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেশে-বিদেশে অনেক যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছে এই রেজিমেন্ট, যার মধ্যে রয়েছে ১৯০০ সালে চীনে বক্সার বিদ্রোহ এবং ১৯০২-০৪ সালের সোমালিয়ায অভিযান।
বিশ্বযুদ্ধে উটারোহী রেজিমেন্ট
তাহলে এই উটারোহী রেজিমেন্টের সাথে দরবারে থাকা বোমারু বিমান কীভাবে সংযুক্ত? ১৯১৪ সালে মহারাজা গঙ্গা সিং ব্রিটিশদের কাছে ৫০০ উটের একটি ক্যামেল কর্পস প্রস্তাব করেছিলেন। ইতিহাসবিদ বিনয় নলওয়ার মতে, মহারাজা ছিলেন ভারতীয় রাজাদের মধ্যে প্রথম, যিনি ব্রিটিশ সম্রাট কর্তৃক 'জেনারেল' পদে ভূষিত হন, এবং ইম্পেরিয়াল ওয়ার ক্যাবিনেটে একমাত্র অ-শ্বেতাঙ্গ অংশগ্রহণকারী। ১৯১৯ সালে মিশরে উট রেজিমেন্ট মোতায়েন করা হয়। তুর্কিদের অগ্রগতি থেকে সুয়েজ খালকে এত সফলভাবে এই রেজিমেন্ট রক্ষা করেছিল যে, ফিলিস্তিন এবং সিনাইয়ের মতো শুষ্ক জায়গায় গেরিলা অভিযানের জন্য কমনওয়েলথ সেনাদের নিয়ে আরও ক্যামেল-মাউন্টেড রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় গঙ্গা রিসালাকে মোতায়েন করা হয়।
উড়ন্ত উপহার
জাদুঘরের সূত্র অনুযায়ী, 'বিকানের রাজ্যের বাহিনীর সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন উপহার হিসেবে দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দুটি ডিএইচ-৯ ডি হ্যাভিল্যান্ড যুদ্ধ বিমানের গুলিবিদ্ধ অংশ। বিকানেরের ক্যামেল কর্পসের বেঁচে থাকা সৈন্যদের সাথে জাহাজে করে এই দুটো বিমানের অংশগুলো আলাদা আলাদাভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারে নির্মাণ করা একক-ইঞ্জিন বাইপ্লেন ডি হ্যাভিল্যান্ড (ডিএইচ) ১৯১৮ সালে জার্মান শহরগুলোতে বোমা হামলার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। ১৯২০ সালে জুনাগড় দুর্গে পৌঁছায় প্লেনের টুকরোগুলো। মনে করা হয়, গঙ্গা সিং-এর ছেলে মহারাজা কর্নি সিং এবং স্থানীয় কারিগররা প্লেনের অংশগুলো জোড়া লাগান এবং বিক্রম বিলাস দরবার হলে প্রদর্শনের জন্য রাখেন।
তবে প্লেনের সবগুলো অংশই যে এসেছিল তা নয়। একে মেরামতের জন্য আলাদাভাবে ইঞ্জিনের জন্য হাতল বানানো হয়, একটি খোদাই করা তক্তা দিয়ে বানানো হয় প্রপেলার এবং সঠিক ল্যান্ডিং গিয়ারের জায়গায় কিছু ঠেলাগাড়ির চাকা লাগানো হয়। অত্যন্ত বিরল সিডেলি পুমা ২৪০ ইঞ্জিনটি ১৯২০ সালে একটি খাল প্রকল্পের জন্য পানির পাম্পে ব্যবহার করা হয়, যা ছিল মহারাজা গঙ্গা সিং বিকানেরের শুষ্ক জমিতে সেচ দেওয়ার প্রচেষ্টার অংশ।
১৯২০ সালে 'ইম্পেরিয়াল গিফট স্কিম'-এর অধীনে ব্রিটেন ভারতকে 60টি ডিএইচ.৯ প্লেন দেওয়া হয়। এগুলো মূলত যুদ্ধের পর বেঁচে যাওয়া যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে উপনিবেশ এবং কমনওয়েলথ দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব বিমান বাহিনী তৈরি করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল। তবে পাইলট, বন্দুক এবং প্রশিক্ষণের অভাবে বিমানগুলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর জন্য ব্যবহার করা হয়নি, ফলে বিভিন্ন রাজ্য, সংস্থা এবং ব্যক্তিগত কাজের জন্য এগুলো বিতরণ করা হয়। বিকানেরে কতগুলি ডিএইচ.৯ এসেছিল তা স্পষ্ট নয়, এবং প্রদর্শন করা বিমানটি আসলে এই বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ ছিল কিনা, তা সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায় না।
১৯৯৯ সালে একজন ব্রিটিশ জুনাগড় দুর্গের পিছনে লুকিয়ে থাকা বিমান দুটোর ধ্বংসাবশেষের একটি ছবি প্রচার করেন, যা গায় ব্ল্যাক নামের একজন বিমান বিশেষজ্ঞ ও বিমান রিস্টোরেশন কোম্পানির প্রধানের কাছে পৌঁছায়। তিন বছর পর ব্ল্যাক জুনাগড়ে আসেন এবং আবিষ্কার করেন, হাতির জিনের স্তূপের মধ্যে ইঞ্জিনবিহীন ডিএইচ.৯-এর এয়ারফ্রেম, যার কাঠ আংশিকভাবে উইপোকা খেয়ে ফেলেছে এবং এর বেশিরভাগ কাপড়ের আবরণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
হাতির আস্তাবল থেকে সাম্রাজ্যকালীন যুদ্ধ জাদুঘরে
ডিএইচ.৯ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জনপ্রিয় হলেও ক্রমশ বিরল হয়ে উঠেছিল এবং একপর্যায়ে যুক্তরাজ্য থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়।
রাজপরিবারের সাথে আলোচনার পর ব্ল্যাক দুটি বিমানের অংশ কিনে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান। তিনি দুটিকেই পুনরুদ্ধার করে ইম্পেরিয়াল ওয়্যার মিউজিয়ামে প্রায় ১ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করেন, যার একটি এখন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজের ডাক্সফোর্ড এয়ারক্র্যাফট হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। অন্যটি, হিস্টোরিক এয়ারক্র্যাফট কালেকশন লিমিটেডের মালিকানাধীন রয়েছে এবং বিমানটি প্রথম ওড়ার এক শতাব্দী পর ২০১৯ সালে ডাক্সফোর্ডে পুনরায় ওড়ানো হয়। এই প্লেনটি বর্তমানে একমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিমান, যা আজও উড়ছে। অদ্ভুত বিষয় হলো, উদ্বৃত্ত হিসাবে দেওয়া বিমানটিই এখন জাদুঘরগুলোর কাছে ব্যাপক মূল্যবান হয়ে উঠেছে।
বিশ্বযুদ্ধের পর এই ডি হ্যাভিল্যান্ড বোমারু বিমানের আন্তঃ-মহাদেশীয় ভ্রমণ ভারতের যুদ্ধকালীন অবদানকে তুলে ধরে, যেটিকে প্রায়ই ভুলে যাওয়া হয়। জুনাগড় দুর্গের জাদুঘরের ইতিহাসও বিশ্বযুদ্ধে ক্যামেল কর্পসের সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করে। মরুভূমির অপ্রস্তুত হয়ে পড়া ব্রিটিশ বাহিনীকে দারুণভাবে এগিয়ে দেয় বিকানেরের রাজার এই ক্যামেল কর্পস, বিশেষ করে যান্ত্রিক অস্ত্রের উপর ফোকাস করা গল্প এবং চলচ্চিত্রগুলোতে খুব কমই এই উটের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে। ক্যামেল রেজিমেন্টকে ১৯৭৪ সালে ভারতীয় বাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও এটি এখনো ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের অংশ হিসাবে থর মরুভূমিতে তাদের টহল অব্যাহত রেখেছে, যা আধুনিক যুগে এখনও দরকারি পরিবহন।