পুরান ঢাকায় এখনও আছেন তারা!
একবিংশ শতাব্দীতে ঢাকা শহরকে আজ যে রূপে দেখছি, তার সঙ্গে আদি ঢাকার কিন্তু একেবারেই মিল নেই। ঢাকায় একসময় বনজঙ্গল ছিল। আর সে বনজঙ্গলে ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর (যেমন, হাতি, বন্য শূকর, বুনো মহিষ, বড় বিড়াল) আনাগোনা। এমনকি, সতেরো শতকে এই ঢাকার আশপাশের বনাঞ্চলে বেশ কিছু বাঘ এবং অসংখ্য চিতাবাঘও না-কি দেখা যেত! অর্থাৎ, বিগত চার শতাব্দী ধরে ঢাকা নগরীর অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে যে, বুনো প্রাণীর অস্তিত্ব জড়িয়ে ছিল, তা নিশ্চিত। যদিও ক্রমবর্ধমান ঢাকা শহর এই বুনোজগতের অস্তিত্বকে কোণঠাসা করে ফেলেছে অনেক আগেই। যে প্রাণীদের সাথে ঢাকাবাসী একই শহরে বেড়ে ওঠেছে, আজ তারা অনেকেই এই শহর থেকে বহু দূরের অভয়ারণ্যে। তাদের মধ্যে টিকে আছে ঝিঁঝিঁব্যাঙ, তক্ষক, গুইসাপ, বন বিড়াল, বানর ইত্যাদি। এমনকি বানরের সদৃশ প্রাইমেটের অন্য সদস্য 'হনুমান', গত শতকেও ঢাকায় বিচরণ করতো। কিন্তু বন উজাড় হতে আরম্ভ করলে, তাদের সংখ্যাও কমতে শুরু করে।
ঢাকা শহর যখন ঝোপঝাড় আর বনজঙ্গলে ভরাট ছিল, তখন এই বানরদের আবাস ছিল এখানেই। বানরদের আধিক্যের কারণে, পুরান ঢাকার জয়নাগ রোডের পাশেই একটি ছোট্ট এলাকার নাম হয়ে যায় 'বানরটুলি'। নামের সঠিক উৎপত্তি জানা না থাকলেও ঢাকার রেওয়াজ অনুযায়ী এ কথা ধরে নেওয়া যায়, নিশ্চয়ই এখানে একসময় বানরদের আস্তানা ছিল। শুধু এখানেই নয়, গেণ্ডারিয়া, মিলব্যারাক, বনগ্রাম, মৈশুণ্ডি, জনসন রোড, নবাবপুরের রথখোলা, টিপু সুলতান রোড, সূত্রাপুর, স্বামীবাগ, বানিয়া নগর- এই এলাকাগুলোতে এখনও বানরদের দেখা মেলে।
বানর হিংস্র না শান্ত?
নাজির হোসেন তার 'কিংবদন্তীর ঢাকা' বইয়ে বানরদের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন, '…গাছগাছালি ও বাড়ির ছাদে অসংখ্য বানর চলাফেরা করতো। এমনকি ভোরবেলা শত শত বানর দলবদ্ধভাবে রাস্তার মাঝখানে বসে থাকতো আর মনের সুখে একে অপরের উকুন মারতো। রাস্তার ওপর বানরগুলো এমন বেপরোয়াভাবে বসে থাকতো যে পথচারীদের প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই থাকতো না। দলবদ্ধভাবে বানরদের বসে থাকতে দেখে অনেকেই পথ চলতে ভয় পেত। একা একা তাদের সামনে দিয়ে যেতে সাহস পেত না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়তো। চার-পাঁচজন একত্রিত হলে, তবে বুকে সাহস সঞ্চার করে ধীর পদক্ষেপে বানর দলকে অতিক্রম করে সরে যেত। এসময় বানররা হয়তো সরে যেত, কিন্তু পথচারীদের তাদের মাঝ দিয়ে পথ দিয়ে অগ্রসর হতে হতো। বানররা স্বভাবতই উচ্ছৃংখল প্রাণী। কিন্তু তাদের যেমন ছিল বুদ্ধি, তেমনি ছিল সাহস। তারা সুযোগ বুঝে মানুষের মতো ঘরের শিকল খুলে ঘরে ঢুকে খাবার-দাবাড়গুলো সাবাড় করে দিতো। রান্না করা ভাতের হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে গিয়ে উঠতো ঘরের ছাদে, গাছের ডালে। খাবার না পেলে অনেক সময় কাপড়চোপড় নিয়ে গাছে বা ছাদে উঠতো। গৃহিণীরা আদর করে খাবার–দাবার দিলেই, তবেই তারা সেগুলো ফেরত দিতো। নতুবা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিতো। ছেলেপুলের হাত থেকেও খাবার-দাবাড় ছিনিয়ে নিতো। বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেই, বত্রিশখানা দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসতো। তখন ভয়ে আর কোনো কথাই বলতে সাহস করতো না কেউ। বানরের উৎপাতে, তখন গাছের লাউ-কুমড়ো থেকে আরম্ভ করে ফলফলাদি কিছুই থাকতো না। এককথায় বানরের উৎপাতে তখন এখানকার মানুষ সবসময়ই সন্ত্রস্ত থাকতো। মানুষ অনেক সময় গুলি করেও অনেক বানর মেরে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করতো না। (কিংবদন্তীর ঢাকা, নাজির হোসেন, পৃ, ২৭৭)
এই বানর এবং বানরদের গুলির স্মৃতি আছে গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরীর ঝুলিতেও। তিনি বলেন, 'একদিন আমার মা আমার বড় ভাইকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে এক বাঁদর ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো। বাঁদরটা এক হাত দিয়ে মায়ের হাত ধরে রেখে, অন্য হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। বাঁদরটা যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ মায়ের হাতটা ধরেই রেখেছিল। ঐ ঘটনার পর বাবা ঠিক করলেন, বাঁদরদের উদ্দেশ্যে ফাঁকা গুলি করবেন। বাবার এই গুলি খুব কাজে এসেছিল। এই ঘটনার পর বাঁদররাও সাবধান হয়ে যায়। তারা আমাদের বাড়ির চারপাশে আর ঘেঁষতো না।'
কিন্তু গেন্ডারিয়া এবং মৈশুন্ডি এলাকার কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এর সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। প্রায় ২৩ বছর ধরে দীননাথ সেন গলিতে বসবাস করে আসছেন অনিরুদ্ধ পাল। তিনি বলেন, 'বানররা তো বাঁদরামি করবেই। কিন্তু তা-ই বলে তাদের মেরে ফেলা বা আঘাত করি না আমরা। সাধনার এই গলিতে বানরের বসবাস সবচেয়ে বেশি। আর এই এলাকার মানুষেরাও এতেই অভ্যস্ত। তাই আমাদের কাছে, মানুষের মতোই প্রতিবেশী তারা।'
পুরান ঢাকার বনগ্রাম রোডের রাঁধাগোবিন্দ জিউ ঠাকুর মন্দিরের পাশে থাকেন শিল্পারানী দাস। প্রতিদিন দুটো রুটি বেশি বানান তিনি বানরদের খেতে দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, 'আমার কাছে প্রতিদিন দুটি বানর আসে। একটি বয়স্ক আর রোগা, আরেকটি ছোটো। রান্নাঘরে না থাকলেই, এটা সেটা নিয়ে দৌড় দেয়। গতকালও একটা আস্ত ফুলকপি নিয়ে দৌড় দিল। তবে হিংস্রতা নেই ওদের মাঝে। জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়, তারপর 'উ...উ... করে ডাকে। খেতে পায় না বলেই তো ওরা আসে। খেতে দিলেই খেয়ে চলে যায়।'
বানরদের বাঁচা-মরার সঙ্গে মানুষের বাঁচা-মরাও একসময় নির্ধারিত হতো!
দীননাথ সেন রোডের এই এক নাম্বার নিকেতন গলিটি ধরে হাঁটলেই, বানরের তার ধরে ঝুলে বেড়ানোর কিংবা রেলিং ধরে হাঁটার দৃশ্য দেখা যায়। আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে বোঝাই যায়, বানরের উৎপাতে বাসার দরজা, জানালায় আলাদা বেড়াজাল লাগিয়ে রেখেছেন তারা। তবে বানর নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। ক্ষিদে পেলে মাঝে মাঝে ছিনতাই বা জামাকাপড়, খাবার চুরি করে নিয়ে যায় ঠিকই, তবে এক টুকরো রুটি, পেঁপে, কলা বা ভাতটুকু জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারলেই আবার নিজ কাজে ফিরে যায়।
গণমাধ্যমকর্মী আদিত্য আহসান বারী থাকেন গেন্ডারিয়ায়। তিনি বলেন, 'বানরকে ক্ষ্যাপালে বানরও আপনার ওপর চটবে। তখন হয়তো কয়েকটা খামচিও বসিয়ে দেয়। এছাড়া তারা নিরীহ, নিজের মতোই থাকে। আবার ক্ষিদে পেলে, খাওয়া না দিলে রাগ করে কাপড়চোপড় নিয়ে যায়। খেতে দিলে আবার ফেরত দিয়ে দেয়।'
লকডাউনের সময় খাবার না পেয়ে একদিন নাকি বারান্দার গ্রিল থেকে তার বাবার পরনের লুঙ্গি আর মায়ের ওড়না নিয়ে গেছিল এক বানর। পরে বাসার কিছু সবজি ছুঁড়ে দিয়ে সে যাত্রায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয় তারা। বানরদের কাছ থেকে এই বস্ত্র উদ্ধার প্রকল্পকে সেখানকার স্থানীয়রা মজা করে 'খাদ্যের বিনিময়ে বস্ত্র ফেরত' প্রকল্প বলে থাকে, জানান বারী।
এদিকে বানরের খামচি নিয়ে 'ঢাকা পুরাণ' বইয়ে নিজ স্মৃতি লিখেছেন মীজানুর রহমান, 'পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, তেলের শিশি উলটে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আলমারি মেঝে তেলে তেলে তেলময়।...আলমারির ওপরে যে বড় আয়না, তার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে ছোটো দুটো বানর লম্ফঝম্ফ করছে আর তাদের কিচিরমিচির শব্দ হচ্ছে।...আমাদের বাসাবাড়ির নিচেই ছিল এক ফার্নিচারের দোকান। দোকানির ছিল একটি বানর। তার পাশে শেকল বাঁধা বানরটি তা-ই দেখতো আর থেকে থেকে কিচিরমিচির করতো। আমরা দুই ভাই বানরের ঐ আনন্দে মজে গেলুম। একদিন গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখে অগ্রজ কাছে গিয়ে ওকে খেলাতে গিয়ে উল্টা বানরের খামচা খেয়ে বসলেন। চিকিৎসক বললেন, ১৪ দিন তক্কে তক্কে থাকতে হবে। বানরটা মরে কি মরে না! যদি বাঁচে, ভাইও বাঁচবে। ভাগ্যিস বানরটা মরেনি।' (ঢাকা পুরাণ, পৃ, ১৯-২০)
তারমানে, বানরের খামচির রেওয়াজ তো আছেই। উলটো, সেই খামচিতে বানরদের বাঁচা-মরার সঙ্গে মানুষের বাঁচা-মরাও একসময় নির্ধারিত হতো!
এই বানরেরা এলো কোথা থেকে?
শুরুতেই বলেছি, ঢাকা শহর আগে শহর ছিল না, ছিল বনাঞ্চল। বিভিন্ন বন্যপ্রাণীদের বাস ছিল এখানে। কিন্তু লোকালয়ে বানরদের ঢুকে পড়া এবং বন উজাড় হয়ে যাওয়ার পরও বানররা কেন এখনো রয়ে গেছে?
এর উত্তর পাওয়া যায় সাধনা ঔষধালয়ে প্রবীণ দ্বাররক্ষী হিসেবে ভবতোষ দে'র কাছে। বহু বছর ধরে সাধনার সেবায় নিয়োজিত এই বৃদ্ধের দাবি, পুরান ঢাকায় এই বানরদের আগমন প্রফেসর ড. যোগেশচন্দ্র ঘোষের হাত ধরে। যোগেশচন্দ্র ১৯১৪ সালে গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে প্রতিষ্ঠা করেন সাধনা ঔষধালয়। এখানকার কারখানায় ওষুধ বানানোর কাজে ব্যবহার করা হতো গুড়। এই গুড়ের গন্ধে বানরগুলো কারখানায় চলে আসতো এবং চুরি করে করে গুড় খেতো। এই দেখে যোগেশচন্দ্র নিজেই তার কারখানার একটি ঘর বানরদের থাকার জন্য ছেড়ে দেন। বিকেল হলেই আশপাশের এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা আসতেন বানরের খুনসুটি দেখতে। সেই সঙ্গে বানরদের খাবারের ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। একাত্তরের সময়, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে (যোগেশচন্দ্র ঘোষের) নির্মম মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরাও নিয়মিত খাবার দিতেন বানরদের। এখনো এই প্রথা চলে আসছে। এখনো প্রতিদিন সকালবেলা সাধনা এখানকার বানরদের দশ কেজি ছোলা খেতে দেয়। আগে বানরদের ছোলা-বুট, রুটি কিংবা কলা খেতে দেওয়া হতো। পরিমাণে কমে এলেও, এখন পর্যন্ত একদিনের জন্যও খাবার দেওয়া বন্ধ করেন নি বলে জানান ভবতোষ।
এছাড়া এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে সিটি করপোরেশন থেকেও রাজধানীর তিনটি স্থানে বানরদের জন্য পালাক্রমে গাজর, কলা, শসা, টমেটো, বাদাম দেওয়া হতো, যা এখন আর নেই। কেন বন্ধ হয়ে গেল সে ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করলে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে মন্তব্য করেন সেখানকার জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ আবু নাসের।
তবে স্থানীয়দের দাবি, বর্তমানে বনবিভাগ থেকেই নিয়মিত (দু'দিন পরপর) শসা, বাদাম, গাজর আসে। সাধনার প্রাঙ্গণেই মেঝেতে খাবারগুলো ছড়িয়ে তাদের খেতে দেওয়া হয়। তখন সব বানর একসঙ্গে ঘেরাও করে খেতে আসে।
আবার বাইরের লোকজনও বানরদের জন্য খাবার সরবরাহ করে থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব বানরদের রুটি কলা খেতে দিচ্ছে এলাকার বাসিন্দারা। কমবয়সীরা বানরদের দেখে আনন্দ পায়, তাই নিজেরাই বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে কলা, রুটি নিয়ে এসে খাওয়ায় বানরদের। আবার ছুটির দিনে অনেকে আসে বানরদের খাবার দিতে। আবার ছাত্ররা নিজেরা চাঁদা তুলে বানরদের খাওয়ানোর নজিরও পাওয়া গেছে লকডাউনের সময়। দিন দিন গাছপালা কমে যাওয়ায় এসব বানর এখন খাবারের জন্য সম্পূর্ণ 'মনুষ্য মুখাপেক্ষী'।
বর্তমানে সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা এবং পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে ১৫০-২০০ বানর বসবাস করে বলে সাধনার কর্মচারীদের ধারণা এবং এদের বানরদের আনাগোনা মূলত গেণ্ডারিয়া, মিলব্যারাক, বনগ্রাম, মৈশুণ্ডি, জনসন রোড, নবাবপুরের রথখোলা, টিপু সুলতান রোডের এই অংশগুলোতেই। কিন্তু এই বানর আগে ওয়ারী, নারিন্দা, টিকাটুলির ঐ প্রান্তেও দেখা যেত। এখনো দেখা যায়, তবে তুলনামূলক কম। ঢাকায় জনসংখ্যা ছিল দুই থেকে তিন লাখ। আর বানরের সংখ্যা ছিল হাজারের উপরে। এখন তা কমে এসে প্রায় দুইশোতে গিয়ে থেমেছে। 'টিকাটুলীর প্রাণীজীবন' শীর্ষক একটি স্মৃতিচারণায় গবেষক আফসান চৌধুরী লিখেছিলেন, 'একটা সময় ছিল, যখন ঢাকায় মানুষের অনুপাতে বাঁদরের সংখ্যা ছিল বেশি। সেই অনুপাত উলটো হতে হতে আজ বাঁদর প্রায় নেই বললেই চলে।'
সত্যজিৎ রায় তার 'সত্যজিৎ স্মৃতি' নামক বইয়ে ঢাকার ওয়ারীতে বানরদের স্মৃতির কথা লিখেছিলেন এভাবে, 'আমার মামার বাড়ি ওয়ারীতে, র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখন আছে কি না জানি না। সে রাস্তা এখন আছে কি না জানিনা। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই। মনে আছে শুধু যে প্রচণ্ড বাঁদরের উপদ্রব।'(সত্যজিৎ স্মৃতি, পৃ,২০)
প্রিয়ডটকমে প্রকাশিত ২০১৩ সালে লুতফর রহমান লিটন 'পুরান ঢাকার বানরস্মৃতি' শীর্ষক শিরোনামে লিখেছেন, '১৯৮৪ সালে আমি আর শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম কলকাতা গিয়েছিলাম সত্যজিৎ রায় সন্দর্শনে। আমরা দু'জনেই পুরনো ঢাকার বাসিন্দা জেনে সত্যজিৎ রায় জানতে চেয়েছিলেন—ঢাকায় কি এখনো বানরের উৎপাত আছে?'
সুতরাং ঢাকায় যে একসময় বানরের উৎপাত কী প্রচণ্ড ছিল, সে ব্যাপারে বইপুস্তকেও প্রমাণ পাওয়া যায়।
এখন সে উপদ্রব বা সংখ্যা নেই মূলত খাদ্যকষ্টের কারণেই। আগে শক্তি, সাধনার পাশাপাশি বিভিন্ন মঠ-মন্দির-আশ্রম কর্তৃপক্ষ থেকেও বানরের জন্য নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা হতো। হিন্দু সম্প্রদায় সেখানে অনেক ফলমূল দেবতার ভোগ হিসেবে নিয়ে আসত। বর্তমানে মঠ-মন্দির-আশ্রমের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বানরগুলো খাদ্য সংকটে পড়েছে। সেই সঙ্গে গাছপালা উজাড় হয়ে যাওয়ায় শহুরে প্রতিকূলতার মাঝে থাকতে হচ্ছে এসব বন্যপ্রাণীর।
এ ব্যাপারে বনবিভাগ এবং বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তাদের কথাবার্তায় উদাসীনতাই প্রকাশ পায়। মুঠোফোনে যোগাযোগের সময় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট পরিচালক (বনবিভাগ) সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, 'যেখানে এই দেশের মানুষই খাওয়া পাচ্ছে না, সেখানে এসব বানররা খাওয়া পেল কি-না, তা নিয়ে পড়ে থাকা অযৌক্তিক'। ফলে সরকারি প্রশাসন যে এই বিষয়ে আসলে উদাসীন, তা পরিষ্কার।
খাবারের আশায় এই নিষ্পাপ প্রাণীরা ছুটে বেড়ায় এক গলি থেকে আরেক গলি। তবে সন্ধ্যা নামতেই সবাই ফিরে আসে আবাসস্থলে। শক্তি, সাধনা, দীননাথ সেন রোডের কবরস্থান, বিভিন্ন বাড়ির ছাদ, গাছে এদের বসবাস। খাদ্য এবং বাসস্থানের অভাবে বানরের সংখ্যা আজ অনেকটাই কম। আর এ কারণেই প্রাণীগুলো মানুষ এবং বাসাবাড়ির ওপর আক্রমণ করছে, খিটখিটে আচরণ করছে। ফ্রিজ খুলে খাবার-দাবার নিয়ে যাচ্ছে, জানালার গ্রিল থেকে কাপড় নিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে দায়ী মানুষের শত্রুভাবাপন্ন আচরণও। এছাড়াও বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বানর মারা যাচ্ছে। এগুলো বানরের সংখ্যা কমে আসার অন্যতম কারণ।