দরদামে কে বেশি এগিয়ে?
দরদামে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। তা হোক আলু পটল কুমড়ো কিংবা জামা জুতো ঘড়ি যেকোনো কিছু কেনাকাটার প্রশ্ন। বাঙালি যেখানেই যাক না কেন, অনেক দাম করে জিনিস কিনবে। একখানা আলপিন কেনবার জন্যেও তাকে ঘুরতে দেখা যায় এক মুল্লুক থেকে আরেক মুল্লুক। সমস্ত বাজার দাম করে তবেই আসে কেনবার কথা। তবু সে ঠকতে রাজি নয়। ২ কিলো পথ হেঁটে যাত্রাভাড়া বাঁচিয়ে যাত্রাভাড়ার দ্বিগুণ পয়সায় ভাজাভুজি খেতে রাজি আছে বাঙালি। কিন্তু দরদাম করে জিনিস কেনা চাই। অথচ এই ক্রেতা বাঙালিই যখন বিক্রেতা হয়ে ওঠে, তখন কীভাবে বেশি দামে কোন জিনিসটা গছিয়ে দেয়া যায় সেই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। এই অবস্থাতে সে চোখ বুজে ঠকাতে রাজি আছে বইকি! এ এক দ্বৈতসত্তা। নিজে ঠকবে না, কিন্তু মানুষকে ঠকাবে।
সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা সিরিজ ফেলুদার একটি গল্প টিনটোরেটোর যীশু। এই গল্পে রহস্য সমাধানের কাজে ফেলুদা আর লালমোহনবাবু গিয়েছেন হংকংয়ে। কাজ শেষে ভারতে ফেরবার পালা। ফ্লাইট রাত দশটায়। হাতে রয়েছে কিছুটা সময়। ফেলুদা বললেন, কিছু কেনা হোক বা না হোক, হংকংয়ের দু-একটা দোকানে ঢুঁ তো মারা যেতেই পারে। তখন লালমোহনবাবু বলে বসলেন, তার একটা পকেট ক্যালকুলেটর কেনবার শখ। বই বিক্রির হিসেবটা কষতে সুবিধে হয়। সুতরাং, ইলেকট্রনিক্সের দোকানে যাওয়া স্থির হলো। তখন সেখানকার প্রবাসী বাঙালি পূর্ণেন্দু বাবু তাদেরকে নিয়ে যেতে চাইলেন কোনো এক চেনা দোকানে। কেননা সেখানে জিনিসও ভালো আবার দরদাম করবারও একটা সুযোগ আছে। এই গল্পের অবতারণা করবার কারণ এই যে, বাঙালি যেখানেই যাক না কেন, আর যা-ই কিনুক না কেন, হোক সেটা 'প্রবাসে ক্যালকুলেটর', দরদাম মিশে আছে তাদের অস্থি-মজ্জায়।
ঢাকা শহরের নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নূরজাহান প্লাজায় বাঙালিকে দেখা যায় এই চিরচেনা রূপে। একদল দাম চড়াচ্ছে, আরেকদল দাম কমাচ্ছে। বেশ একটা প্রতিযোগিতা। কিন্তু জিতবে কে? বড়োই কঠিন প্রশ্ন। বিক্রেতা বেচারাকেও তো পেটের ভাত জোগাতে হয়! যে জিতুক কিংবা যে-ই হারুক, এই দরদামের দৃশ্যটি কিন্তু আমাদের সবারই কমবেশি পরিচিত। 'আপনার কথাও থাক আর আমার কথাও থাক' দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা মধ্যস্থতায় আসে ক্রেতা-বিক্রতা। এরজন্যে কিন্তু এদেরকে অর্থনীতির বড় বড় কেতাব পড়তে হয় না। জানতে হয় না চাহিদা-জোগান বিধি। তবু দামদরের ব্যাপারে এরা বেশ সহজ, সাবলীল।
দামদরের ব্যাপারস্যাপারে ক্রেতাদের মধ্যে কে এগিয়ে—আমাদের মা-বোনেরা নাকি ঘরের ছেলেরা? এমন গুরুতর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবেন আপনি? এই প্রশ্ন নিয়েই হাজির হলাম নিউ মার্কেটের অলিতেগলিতে। উত্তর খুঁজলাম ক্রেতা কিংবা বিক্রেতার মুখে।
নিউমার্কেট মোড় থেকে শুরু করে গাউছিয়া, ইয়াকুব মার্কেট, নূরজাহান প্লাজা কিংবা ধানমন্ডি হর্কাস অব্দি সারি সারি দোকান। রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়ে বসে আছে নানা দোকানি। প্রসাধনী সামগ্রী থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খুন্তিটিও বাদ যাবে না। আছে শখের সানগ্লাস পর্যন্ত। জামাকাপড় তো রয়েছেই।
দোকানগুলোর বাহ্যিক আড়ম্বর নেই বড়। কিন্তু দোকানের পণ্য দেখে মনে হবে, এইটেই কতদিন ধরে খুঁজছি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সমস্ত দোকানের ক্রেতাদের মধ্যে যেমন রয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, ঠিক তেমনিভাবেই আছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্ত। আছে ছেলে-বুড়ো-শিশু। সুতরাং, নানা বয়সের নানা অভিজ্ঞতার মানুষকে এক জায়গায় দেখতে চাইলে আপনাকে আসতেই হবে এই মার্কেটগুলোতে।
এইবারে নেমে পড়া যাক ময়দানে। নিউমার্কেটের একজন নিয়মিত ক্রেতার সাথে দেখা হলো কোনো একটি দোকানের সামনে। কিনছিলেন সাজগোজের কোনো জিনিস। দামাদামির মাঝখানের সময়টাতে কথা বলতে শুরু করলাম আফিয়া মুশফিকা শ্রাবস্তীর সাথে। জানালেন, বছর দুই ধরে নিউমার্কেটে কেনাকাটা করেন তিনি। পেশায় শিক্ষার্থী। তুলনামূলক কম দামে বেছে জিনিস কিনতেই নিউ মার্কেট আসেন তিনি। নির্দ্বিধায় বলে দিলেন, দরদামে মেয়েরাই সেরা। তিনি নিজেও দর করে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। বিক্রেতা যে দামই বলুক না কেন, তিনি দামাদামি শুরু করেন সেই চাওয়া দামের থেকে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে। এরপর একটা মোটামুটি রকমের দামে দফারফা হয়।
এদিকে ঢাকা কলেজের রাস্তাটা পার হলেই নূরজাহান মার্কেট। জমজমাট বাজার। বাজারজুড়ে মানুষের ভিড়। এত ভিড়ভাট্টা দেখলে কেমন যেন উৎসব উৎসব মনে হয়। এই ভিড়ের আমেজ লেগে থাকে সারাবছরই। তবে ঈদের আগের সময়টাতে ভিড় অনেক বেশি হয়। একেক সময় এই রাস্তার নিয়মিত যাত্রীদের কাছে ভিড়ভাট্টা বোধহয় কিছুটা বিরক্তই লাগে। আবার মঙ্গলবারে বন্ধ থাকে এই মার্কেটগুলো। ক্রেতা-বিক্রেতার জমায়েত নেই। সুতরাং, সপ্তাহের ওই দিনটি রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা। তখন আবার মনে হতে থাকে কী যেন নেই নেই। এই এক মুশকিল বটে।
নূরজাহান মার্কেটের সামনের ফুটপাতে শার্ট, জিন্স কিনতে দেখা গেল এক ক্রেতাকে। একজন নয়। মূলত দুজন। দুই ভাই এসেছেন কেনাকাটা করতে। সাইফ আল মাহমুদ নাইমের সাথে গল্প জমল দরদাম নিয়ে। ওই একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলাম ঘুরেফিরে। কিন্তু একেক ধরনের ক্রেতার একেক রকমের উত্তর। একেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। এক পর্যায়ে এই ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, নারী না পুরুষ দরদামে কে এগিয়ে? তিনি বিশ্লেষণ করলেন এভাবে:
'৪ টা প্যান্ট, ৪ টা শার্ট, ৩টা টিশার্ট কিনলাম। দেড় ঘণ্টা নিউমার্কেট থেকে নূরজাহান প্লাজা ঘোরাঘুরি করে মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে আমার। মোটামুটি দামদর করে কিনেছি। তবে সাথে কোনো মেয়ে থাকলে আরো কম দামে কিনতে পারতাম বলে মনে হয়। যত ভিড়ভাট্টা হোক আর যে জিনিস কেনবার প্রশ্নই আসুক না কেন, মেয়েরা ধৈর্য ধরে বাজার করতে পারে। তারা দরদামে নাকাল হয়ে গেলেও হার স্বীকার করতে রাজি নয়। তাই আমি মনে করি মেয়েরাই ভালো দরদাম করতে পারে।'
তবে সাইফুল নামের এক বিক্রেতা জানালেন, ছেলে কিংবা মেয়ে নয়। দরদামের ক্ষেত্রে ব্রহ্মাস্ত্র হচ্ছে অভিজ্ঞতা। যিনি বহু বছর ধরে বাজার ঘুরে জিনিস কেনেন, তিনি ধারণা করতে পারেন দাম কেমন হতে পারে বা কেমন হওয়া উচিত। তাই তিনি ক্রেতা হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন তার স্ত্রীর তুলনায়।
গাউছিয়া মার্কেটের ভেতরে ঢুকতেই শাড়ি আর সালোয়ার কামিজের দোকান। আছে ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী। এখানে দেখা পাওয়া গেল আরকুন নামের এক তুর্কিশ ভদ্রলোকের। আলাপে জানতে পারলাম, তার শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে। বেড়াতে এসে কেনাকাটা করতে এসেছেন স্ত্রী এবং শাশুড়ির সাথে। আরকুন উচ্ছ্বসিত হয়ে শাশুড়ির দরদামের প্রশংসা করলেন। জানালেন, তিনি এবং তার স্ত্রী কেউই সেভাবে দরদামের ব্যাপারটা বোঝেন না। কিন্তু শাশুড়ি বোঝেন চমৎকার। তিনি এতে রীতিমতো বিস্ময় বোধ করেন। দরদামের এ পর্ব দেখে আনন্দও পান বেশ।
এভাবেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে দরদামের গল্প চলতে থাকল। নানান মুনির নানান মত। কেউ অকপটে স্বীকার করে নেন, দামদর পুরুষের দ্বারা হয়ই না। আর কেউ মেনে নিতে নারাজ। তবে ছেলেদের মুখে নারীদের দামদরের ব্যাপারে যতটা স্তুতি শোনা গেল, শ্রীমতিদের ভাষ্যে সেভাবে শোনা গেল না পুরুষদের দামদরের ব্যাপারে প্রশংসাবাক্য।
আরেকজন ক্রেতা শাহিদ আহমেদ। পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে। তিনি বললেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখনো অনেক মেয়েই গৃহিণী।অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সেই অর্থে আসেনি। তাই আমাদের মায়েদেরকে কোনো জিনিস কিনতে গেলে অনেক হিসাবনিকাশ করেই কিনতে হয়। যার কারণে দামদরের ব্যাপারটি ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তাদেরকে রপ্ত করতেই হয়। তবে সাথে থাকা সমর্পিতা সাহা কিন্তু সে কথা মানতে নারাজ। জানালেন, ছেলেরাও দরদামে কম যায় না। দরদামের মারপ্যাঁচ বোঝে এমন ছেলে আছে বইকি!
নিউমার্কেটের দ্বিতীয় গেটের কাছে দেখা হলো মোহাম্মদ শুকুর মিয়ার সাথে। শুকুর মিয়া ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। কাপড় মেলার ক্লিপ, ন্যাপথলিন থেকে চায়ের ছাঁকনি, বাসন মাজবার সরঞ্জাম সমস্ত দুহাতে সাজিয়ে হেঁটে হেঁটে ফেরি করে বিক্রি করেন। ওঁর বিক্রি করবার একটা অভিনব কায়দা আছে। অন্যরকম একটা হাঁক। অনেক ভিড়ের মধ্যেও চোখ পড়তে বাধ্য। শুকুর মিয়ার হাতে সাজানো নানা দরকারি জিনিস আর সুর করে ডাকবার কায়দায় ক্রেতা দুদণ্ড না দাঁড়িয়ে পারবেন না।
শুকুর মিয়ার সাথে কথা বলে দরদাম সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলাম। শুকুর মিয়া বলেই ফেললেন, একটা ছেলের হাতে ২০ হাজার টাকা দিয়ে কেনাকাটা করতে পাঠালে ছেলেটি টাকা ফেরাতে পারবে না। উল্টে আরো কিছু বেশি খরচ করে আসা সম্ভব। কিন্তু একটা মেয়ের হাতে একই টাকা দিলে জিনিস কেনবার পর হাজার পাঁচেক টাকা ফেরবার সম্ভাবনা থাকে। কারণ মেয়েরা দরদামের হিসেবটা ধরতে পারে। কিছু কিছু ক্রেতা যদিও বা বললেন দরদামে শ্রীমানরাও বেশ দক্ষ, বিক্রেতাদের মুখ থেকে এমন কথা কবুল করতে পারা গেল না। বিক্রেতারা দরদামে আমাদের মায়েদের পক্ষেই রায় দিলেন।
নীলক্ষেত পেরিয়ে নিউমার্কেট গেট থেকে শুরু করে জনা বিশেক মানুষের সাথে দরদামের ব্যাপারে গল্প জমল। হ্যাঁ, দরদামের পাশাপাশি বাঙালি যে গল্প জমাতেও ওস্তাদ, তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই প্রশ্নোত্তর পর্বে একই জোড়ায় থাকা ছেলে এবং মেয়ে ক্রেতার মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্ক লাগবার জোগাড়। কেউ যদি বলে, মেয়েরা দামদরে সেরা; অমনি ওপক্ষ বলে ওঠে, ছেলেরা কেন নয়? কী মুশকিল কাণ্ড! কিন্তু এই প্রশ্নের সমাধান কোথায় পাই? ক্রেতা-বিক্রেতার জরিপে যদিও শ্রীমতীরা এগিয়ে রয়েছে অনেকটাই, তবু সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেওয়া যাক পাঠকের হাতেই।