‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ থেকে ‘ডিজাইনড ইন বাংলাদেশ’
বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারের ওপর আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর নির্ভরশীলতার কল্যাণে পোশাকের ভেতরে সেঁটে থাকা 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ট্যাগটি বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত লেবেল। কিন্তু এসব পোশাকের বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোতে করা ধারণা ও নকশার ফসল।
কেমন হয় যদি কোনো কিছুর ধারণা ও নকশা বাংলাদেশে করে সেগুলো পশ্চিমে তৈরি করা হয়?
এ কাজটাই করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশি তরুণ ডিজাইনার রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা। সম্প্রতি তিনি জার্মান স্নিকার লেবেল একেন ফুটওয়্যার-এর সঙ্গে একত্রে কাজ করে 'কামথালা' নামক একটি জুতার নকশা করেছেন।
চিরায়ত 'গ্লোবাল নর্থে নকশাকৃত, গ্লোবাল সাউথে তৈরিকৃত' ধারণাকে উল্টে দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠালের নামে নামকরণ করা কামথালা বৈশ্বিক পোশাকশিল্পকে গ্লোবাল সাউথ নিয়ে নতুন করে ভাবাতে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ তৈরি করেছে।
এ জুতার পেছনে ধারণাটি হলো, এমন একটি পাদুকা তৈরি করা যা হবে সম্মানের প্রতীক। দশকের পর দশক ধরে পোশাকখাতের সমর্থক হয়ে ওঠা সরবরাহ চেইনের অনৈতিক কার্যক্রম, দূষণ, শোষণ ইত্যাদিকে বদলে দেওয়া এবং তরুণ প্রজন্মের অর্থবহ পরিবর্তনের আগ্রহের সঙ্গে তাল মেলানো — এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ জুতার জন্ম।
"আমরা 'ডিজাইনড ইন বাংলাদেশ নয়' বরং 'মেঅড ইন বাংলাদেশ' শব্দগুচ্ছটিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এখন ভিন্নভাবে ভাবতে ও কাজ করতে শুরু করেছে। আর এ প্রজন্মের অংশ হিসেবে, পরিবর্তন আনার এ সুযোগটা পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি অসংখ্য মানুষের স্বপ্নের জীবন যাপন করছি, তাই এ সুযোগের সঙ্গে অনেক দায়িত্বও জড়িয়ে রয়েছে," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা।
কামথালা সম্পূর্ণভাবে একটি ভেগান পণ্য। এটি তৈরি করা হয়েছে রিসাইকেল করা কৃত্রিম লেদার ও নিওপ্রেন থেকে। পাকা কাঁঠাল থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে এ জুতার নকশায়।
"আমার নিজের শিকড় ও শৈশবের স্মৃতিও এ নকশায় প্রভাব রেখেছে। একেন কামথালার উৎসাহ আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল থেকে পেয়েছি আমি — এ ফলের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। বাড়ির সামনেই একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। ওটার তলায় আমি খেলতাম, আঁকতাম, ঘুমাতাম," বলেন রোকাইয়া।
২০১৫ সালে একেন ফুটওয়্যার জিএমবিএইচ প্রতিষ্ঠা করেন নোয়েল ক্লিন-রিজিংক। খেলাধুলার সরঞ্জামের বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এসব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি ফ্যাশনেবল, উচ্চমানসম্পন্ন, ও পরিবেশবান্ধব জুতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
অন্য সব জুতা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মতো সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতি না করে উচ্চমানের জুতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে একেনের সবগুলো জুতা পর্তুগালে তৈরি করা হয়।
নারী ও পুরুষ উভয়ের পরার উপযোগী কামথালা জুতা ৩৬ থেকে ৪৬ সাইজে পাওয়া যায়। এগুলোর দাম ধরা হয়েছে ২০০ ইউরো বা প্রায় ২৪,০০০ টাকা।
"খুব দ্রুতই জুতাগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের রেফারেন্সের জন্য আমাদেরকে কয়েক জোড়া রেখে দিতে হয়েছিল," রোকাইয়া বলেন।
ছোটবেলা থেকেই সমাজের গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধাচারণ করে এসেছেন রোকাইয়া।
"মূলধারার পড়াশোনার ধারণা ও পাঠ্যপুস্তক পড়ে মুখস্থ করার প্রবণতা আমার কখনোই ভালো লাগেনি। ছবি ও রং ছিল আমার নিজেকে প্রকাশ করার একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবিত উপায়। আজকের দিনেও রং আমাকে অনেক কিছু মনে রাখতে সাহায্য করে," রোকাইয়া বলেন।
পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়ালেখা করেন। বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন তিনি।
রোকাইয়া স্নাতক পড়ালেখার সময়েই তার পরিশ্রম ও মেধার স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালেই ডেনিম অ্যান্ড জিনস ইন্টারন্যাশনাল শো-এ নিজের নকশা করা ক্যাপের জন্য পুরস্কার পান তিনি। এরপর থেকে অনেক পুরস্কারই পেয়েছেন তিনি।
এর আগে মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সার-এর জন্য পূর্ণকালীন গার্মেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন রোকাইয়া। সেখানে তিনি টিম অ্যাওয়ার্ড জেতেন। নিউজিল্যান্ডে ইন্টারন্যাশনাল এমার্জিং ডিজাইনার অ্যাওয়ার্ডও লাভ করেন তিনি। ওই শোয়ে তিনি আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের সংগ্রহ প্রদর্শন করেন।
নিজ দেশে অন্যরা যারা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চান এবং ফ্যাশন ও ভিজ্যুয়াল শিল্পে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদেরকে উৎসাহ জোগাতে রোকাইয়া আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নারীদেরকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত করার কাজটাকে নিজের জীবনের মিশনে পরিণত করেছেন। নিজের কাজের জন্য রোকাইয়া উদ্যোক্তা পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে তিনি ইউনেস্কো কাউন্সিল অব জার্মানির একজন ইউনেস্কো ফেয়ার কালচার বিশেষজ্ঞ। এছাড়া সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে ফোর্বস-এ জায়গা করে নিয়েছেন রোকাইয়া।
রোকাইয়া আদিবাসী পোশাক বিশেষজ্ঞ এবং নিজের প্রতিটি সৃষ্টিতেই তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। এটা সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে তার নিজের 'র্যাপ' লেবেলে।
২০১৯ সালে রাশিয়ার ফ্যাশন উইকে নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক, ফোক মোটিফ, ও বস্ত্রশিল্পের দুর্দান্ত সংগ্রহ প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ফ্যাশনকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নতুন করে জানান দেওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছেন রোকাইয়া।
একই বছর তার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে নিয়ে ইনস্টাগ্রামে যোগাযোগ করে জার্মান ব্র্যান্ড একেন। প্রকল্পটিকে বাস্তব রূপ দিতে তাদের প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল।
"ব্র্যান্ডটি আমাকে স্থানীয় অনুপ্রেরণা নিয়ে আমার মতো করে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছিল। আর আমি এ সুযোগের প্রতিটা অংশকে কাজে লাগিয়েছি। এটাই ছিল আমার প্রথমবারের মতো কোনো জুতার নকশা করা আর আমি এ কাজে আমার সর্বোচ্চটুকু দিই। প্রায় শখানেক ডিজাইন জমা দিয়েছিলাম, শেষপর্যন্ত কামথালা নির্বাচিত হয়," তিনি বলেন।
রোকাইয়া আরও জানান এ প্রজেক্টের জন্য তাকে যে আর্থিক মূল্য দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি গ্রহণ করেননি।
"পুরো ব্যাপারটায় টাকা মুখ্য ছিল না, বরং সমাজে একটা পরিবর্তন আনা, দেশের তরুণ ডিজাইনারদের জন্য একটি উদাহরণ তৈরি করাটাই আমার কাছে মূখ্য ছিল," রোকাইয়া বলেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ডিজাইনারদের জন্য শীঘ্রই নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করবেন রোকাইয়া। এ প্ল্যাটফর্মে তাদের নকশাগুলো প্রদর্শন ও প্রমোট করা হবে। এ প্রকল্পের সঙ্গে একেনও জড়িত থাকবে। কামথালা বিক্রির লাভের টাকা এ প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজে বিনিয়োগ করা হবে।