তুরস্ক-সিরিয়ার প্রাণীরা কি আগেই ভূকম্পন টের পেয়েছিল?
তুষারে ঢাকা ভবনগুলোর উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গেল শত শত পাখি। কুকুরগুলো ডাকতে থাকলো জোরে জোরে। পরক্ষণেই তুরস্ক-সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়লো বাড়িঘর, যাতে মৃত্যুসংখ্যা এখনো পর্যন্ত ১৫ হাজারের ঘর ছাড়িয়ে গিয়েছে।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা জানিয়েছে, ৭.৮ মাত্রার তীব্র এই ভূমিকম্প ও এর আফটারশকগুলোর ঠিক আগেই প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিলো তারা। এই দাবিকে প্রমাণ করার মতো কোনো ফুটেজ পাওয়া না গেলেও, প্রাণীরা যে মানুষের আগেই ভূকম্পন টের পায় এমন তত্ত্ব কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই প্রচলিত।
বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও এর সত্যতা প্রমাণ হয়। ভূকম্পন মাপার সিসমোলজিকাল মেশিনে ধরা পড়া অনেক কম্পনই মানুষের শরীর টের পায় না। ঠিক একইভাবে প্রাণীরাও ছোট ছোট ফোরশক (মূল ভূমিকম্পের আগে হওয়া ছোট কম্পন) মানুষের আগেই টের পেয়ে যায়। অনেকের মতে ফোরশকের আগেও তারা ভূমিকম্পের আভাস পায়। সম্প্রতি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিকাল সার্ভে (ইউএসজিএস) অনুযায়ী, মূল ভূমিকম্পের কয়েক সেকেন্ড আগে প্রাণীদের এই অস্বাভাবিক আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় দুই ধরনের সিসমিক তরঙ্গের মাধ্যমে। ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সময় প্রথমেই প্রাইমারি বা পি ওয়েভ ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে সেকেন্ডে কয়েক মাইল বেগে ছড়িয়ে পড়ে। পি ওয়েভের ঠিক পরপরই সেকেন্ডারি বা এস ওয়েভ শুরু হয়, যেটি ভূমিকে প্রচণ্ড মাত্রায় নাড়াতে থাকে।
ইউএসজিএস-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, "খুব কম মানুষই পি ওয়েভ বুঝতে পারে। যেটি ভূকম্পনের কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দ্রুত ছুটে আসে এবং এস ওয়েভ পৌঁছানোর আগেই ভূকম্পনের পূর্বাভাস দিয়ে যায়। তবে অনেক প্রাণীই এস ওয়েভ আসার আগেই এই পি ওয়েভ শনাক্ত করতে পারে।"
সিসমোলজি মেশিনের মাধ্যমে এই পূর্ব-কম্পনগুলো খুব দ্রুত শনাক্ত করে বিশ্লেষণ করে সতর্ক সংকেত পাঠানো যায়, তবে সেই পূর্বাভাস পাওয়া যায় এক মিনিটেরও কম সময় আগে। কিন্তু প্রাণীরা কি আধুনিক এই যন্ত্রগুলোর আগেও ভূকম্পন টের পায়?
প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ খেয়াল করেছে ভূকম্পনের কয়েক মিনিট, এমনকি কয়েক ঘণ্টা আগেও প্রাণীরা তা টের পেয়ে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছে। তবে কীভাবে এটি সম্ভব তা নিয়ে বিজ্ঞান এখনো অস্পষ্ট অবস্থানে রয়েছে।
ফোরশকের আগেই প্রাণীরা ভূমিকম্প টের পেতে পারে এরকম মত দিয়েছেন বেশ কয়েকজন গবেষক। এ বিষয়ে গবেষণা চালানো ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনিস্টিটিউট ফর অ্যানিম্যাল বিহেভিয়ারের ডিরেক্টর মার্টিন উইকেলস্কি জানান, "আমাদের কাছে বেশ ভালো প্রমাণ রয়েছে যে প্রাণীরা ভূকম্পনের পূর্বাভাস আগেই পেয়ে যায়, তবে সেটি কোনো সিসমিক অ্যাক্টিভিটি নয়।"
২০২০ সালে প্রকাশিত তার দলের পিয়ার-রিভিউড নিবন্ধে গবেষকরা ইতালির এক খামারের একদল গরু, কুকুর এবং ভেড়ার গায়ে ইলেকট্রনিক ট্যাগ লাগিয়ে দেন। উদ্দেশ্য ছিল ভূমিকম্পের সময় প্রাণীগুলোর নড়াচড়া ও চলাচল পর্যবেক্ষণ করা। কয়েক মাস ধরে তারা প্রাণীদের চলাচল ও নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করার পর খুঁজে পান যে, খামারের অঞ্চলে অনুভূত হওয়া আটটি ভূমিকম্পের সাতটির আগেই তাদের নড়াচড়ায় অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া যায়, যেটিকে তারা নামকরণ করেছেন 'সুপারঅ্যাক্টিভ' অবস্থা হিসেবে। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তারা ক্রমাগত সুপারঅ্যাক্টিভ অবস্থা বজায় রাখে।
উইকেলস্কি জানান, ভূকম্পনের ফোরশকের ১২ ঘণ্টারও বেশি আগে প্রাণীরা ভূমিকম্প বুঝতে সক্ষম বলে মনে করা হয়।
তবে কী কারণে প্রাণীরা অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। উইকেলস্কি জানান, "তারা যে টের পায় তা আমরা স্পষ্টভাবে ধরতে পারলেও তারা সেটি কীভাবে পায়, তা আমরা এখনো জানি না।"
তিনি বিশ্বাস করেন, তাদের বিপদের অনুভূতি টের পাওয়ার সাথে প্রাণীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার সক্ষমতার যোগসূত্র রয়েছে।
"গরুরা প্রথমে হঠাৎ করেই একেবারে নড়াচড়া থামিয়ে দিল। তারপর কুকুরদের মধ্যেও নার্ভাসনেস দেখা গেল। তারপর তারা পাগলাটে আচরণ শুরু করলো, প্রচণ্ড জোরে ডাকা শুরু করলো। আর এরপর ভেড়াদের মধ্যে অদ্ভুত আচরণ দেখা গেল। শেষমেশ দেখা যায়, গরুরাও প্রচণ্ড লাফঝাঁপ শুরু করলো।"
উইকেলস্কির গবেষণা অনুযায়ী, ভূকম্পনের কেন্দ্র থেকে ১২ মাইল দূর থেকে প্রাণীরা তার পূর্বাভাস পাওয়ার সক্ষমতা থাকতে পারে। তিনি এ বিষয়ে আরও গবেষণা করতে চান। তার ধারণা, ভূগর্ভস্থ চাপে বাতাসে লোহার পরিমাণ বেড়ে গেলে প্রাণীরা সেটি আগেই টের পাওয়ার ফলে ভূমিকম্প ধরে ফেলতে পারে তারা।
"এখানে আরও অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত, যেগুলো কেবল প্রাণীরাই ধরতে পারে। কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে আমরা জানি না," বলে জানান উইকেলস্কি।
২০১৮ সালে ভূমিকম্পের আগে প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণের ৭০০টি রেকর্ড রিভিউ করা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, কোনো ধারণায় পৌঁছানোর আগে আরও প্রমাণ ও সেগুলোর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
গবেষকদের মূল লক্ষ্য ছিল, সিসমিক মেশিনে কম্পন ধরা পড়ার আগেই প্রাণীরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস টের পায় কি না সেটি লক্ষ্য করা। ঐতিহাসিক প্রমাণ যেগুলো রয়েছে, তার অনেকগুলোই হয়তো ভূমিকম্পের কয়েক সেকেন্ড আগে পাওয়া পি ওয়েভের বিবরণ, এমনটাই মনে করে সেই রিভিউয়ের গবেষকগণ। তাছাড়া যে বিবরণগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো গবেষণাভিত্তিক না হওয়ায় তেমন নির্ভরযোগ্য নয়।
তবে প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগের উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ হলো রোমান লেখক এলিয়ানের বিবরণ, যেখানে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন কীভাবে ইঁদুর, সাপ, গুবরেপোকা হেলিক শহর থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৩ সালে হওয়া এই ভূমিকম্পে বাড়িঘর ভেঙে পড়ে এবং ঠিক তার পরেই হওয়া সুনামিতে পুরো শহরই ধ্বংস হয়ে যায়।
অন্যদিকে, ২০১৬ সালে ওকলাহোমায় হওয়া ভূমিকম্পের ১৫ মিনিট আগে সেখানকার পাখিরা অস্বাভাবিকভাবে হাজারে হাজারে ওড়া শুরু করে, যেটি রাডারেও ধরা পড়ে।