বাজফিডের জন্ম, বাজফিডের মৃত্যু, দুইয়ের পেছনেই রয়েছে ফেসবুক
বাজফিডের সংবাদ সম্পর্কিত কার্যক্রম বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার সময় বাজফিডের সিইও জোনাহ পেরেটি তার একটি গুরুতর ভুল স্বীকার করেন: তিনি ভাবতে পারেননি যে ফেসবুক তার বন্ধু নয়।
পেরেটি অবশ্য একে ভিন্নভাবে দেখেছেন। তার মতে, 'প্রিমিয়াম মানের কিন্তু বিনামূল্যে সংবাদ প্রচারের জন্য যে ডিস্ট্রিবিউশন বা আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, সেটি বড় বড় প্ল্যাটফর্মগুলো দিতে চাইবে না', তা বুঝতে অনেক সময় নিয়ে ফেলেছেন তিনি। বাজফিড মূলত তৈরিই করা হয়েছিল ফেসবুকের অ্যালগরিদমের জন্য, উদ্দেশ্য ছিল বিনামূল্যে বিশ্বমানের সংবাদ বিতরণ। কিন্তু এই সপ্তাহে সেই পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
অবশ্য ফেসবুকও যে এখন খুব ভালো অবস্থানে এমন নয়। বাজফিড নিউজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক একদিন আগে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা ৪,০০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। এর আগে ছাঁটাইয়ের প্রথম দফায় ২০২২ সালের শেষদিকে ১১,০০০ এরও বেশি কর্মী ছাঁটাই করে তারা। ইন্টারনেট খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তরুণরা মেটার ফেসবুক ছেড়ে টিকটকের মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের সাম্রাজ্যে মেটা এবং গুগলের প্রভাব কমতে শুরু করেছে।
ফেসবুক (বর্তমান মেটা) চালু হওয়ার ঠিক দুই বছর পর ২০০৬ সালে চালু হয়েছিল বাজফিড। লিস্টিকেল আর কুইজের মতো কন্টেন্ট বের করে বাজফিড ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ফেসবুকের নিউজফিড ভর্তি হয়ে ওঠে বাজফিডের কন্টেন্ট দিয়ে। ২০১১ সালে, পলিটিকোর বেন স্মিথকে নিয়োগ করা হয়, সংবাদ প্রতিবেদনের দিকে আরও জোর দেওয়ার জন্য। অনেকেই মনে করছিলেন বাজফিডই ভবিষ্যৎ, আর এর ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছিলো খুব দ্রুত।
কিন্তু ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা, বিগ টেকের সাথে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হওয়া, আর বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট সবার জন্য বিনামূল্যে অ্যাকসেস দেওয়ার সুবিধা বাজফিডের পথচলাকে কঠিন করে তোলে। প্রযুক্তি এবং মিডিয়া নিয়ে গবেষোণা করা ইউসিএলএ-র পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো কোর্টনি রাডস জানান, "মুষ্টিমেয় কিছু প্ল্যাটফর্মই ডিজিটাল পাবলিক স্ফিয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিউজ আউটলেটগুলো এদের কাছে জিম্মি।"
সাংবাদিকতা, সেটি অনলাইন হোক কিংবা প্রিন্ট, টিভি বা রেডিও, সবসময়ই তাদের অর্থ আয়ের প্রধান উপায় ছিল বিজ্ঞাপন। কিন্তু বিগ টেক কোম্পানি, বিশেষ করে গুগল এবং মেটা, তাদের ব্যবহারকারীদের ডেটা সংগ্রহ শুরু করে দ্রুত এই ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ২০১৭ সাল নাগাদ, বাজফিড প্রতিষ্ঠা হওয়ার নয় বছর পর, মেটা পৃথিবীজুড়ে সমস্ত ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ২০ শতাংশ আয় করা শুরু করে, আর তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ছাড়িয়ে যায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি)।
ডিজিটাল যুগে সবার কাছে পৌঁছে যাওয়ার এই ক্ষমতা ট্রেডিশনাল মিডিয়ার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। ফেসবুকের অ্যালগরিদমকে ব্যবহার করে এর ব্যবহারকারীরা কী ধরনের কন্টেন্ট পছন্দ করে তা বিশ্লেষণ করে খুব দ্রুতই বাজফিড বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সে সময়ে এটা তেমন অবিশ্বাস্য কিছু ছিল না। ২০০৮ সালের মহামন্দার পর ট্রেডিশনাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের বাজেট কমে গিয়েছিল। এবং যখন আবার ২০১০ সালে বিজ্ঞাপনের পেছনে অর্থ ঢালা শুরু হয়, তখন ট্রেডিশনাল মিডিয়ার তুলনায় ডিজিটাল মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ঝোঁক শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের অর্ধেকটাই তখন নিয়ন্ত্রণ করতো ফেসবুক (মেটা) এবং গুগল।
রাডস মেটা এবং গুগলকে উল্লেখ করেছেন 'সোশ্যাল ওয়েবের অপারেটিং সিস্টেম' হিসেবে। এর প্রথম কারণ, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে তাদের বিশাল প্রভাব এবং দ্বিতীয়ত, সারা বিশ্বজুড়ে থাকা বড় বড় প্রকাশকদেরকে তাদের নিয়মের গণ্ডিতে নিয়ে আসা। ২০১৫ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, বাজফিডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ইন্সট্যান্ট আর্টিকেল ফিচারের মাধ্যমে ফেসবুকে সরাসরি তাদের কন্টেন্ট প্রকাশ শুরু করে, এর বিনিময়ে তারা বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের ৭০ শতাংশ লাভ করতো। বাজফিডের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রেগ কোলম্যান বলেছিলেন, "ফেসবুক সত্যিই বুঝতে পেরেছে যে আমাদের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ হবে।"
এছাড়াও ২০১৫ সালে ফেসবুক নিউজ আউটলেটগুলকে লিখিত আর্টিকেলের চেয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করতে চাপ দেয়, কারণ তাদের কাছে থাকা ডেটা অনুযায়ী সাধারণ মানুষ ভিডিও আরও বেশি দেখে থাকে। এবং বেশি কন্টেন্ট দেখার অর্থ হলো বিজ্ঞাপন থেকে আরও বেশি আয়। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেক সংবাদ প্রতিষ্ঠানই তাদের লেখক আর সম্পাদকদেরকে ছাঁটাই করে নতুন ভিডিও দল তৈরি করেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই বেরিয়ে আসে নতুন এক তথ্য, ফেসবুক ভিডিও দর্শকদের হার যত বড় করে দেখিয়েছে, তার তুলনায় প্রকৃত হার বেশ কম।
ডিজিটাল পাবলিশারদের এই সাফল্য মূলত তখন ফেসবুকের সাফল্যের সাথেই জড়িত ছিল। ২০১৬ সাল নাগাদ বাজফিডের মূল্য ছিল আনুমানিক ১.৭ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ভাইস নামের আরেকটি ডিজিটাল মিডিয়া আউটলেটের মূল্য ছিল ৫.৭ বিলিয়ন ডলার। (বর্তমানে বাজফিডের মূল্য নেমে এসেছে ১০০ মিলিয়ন ডলারে, অন্যদিকে ভাইসের মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম)।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের একটি ব্লগ পোস্টে, মেটা দাবি করেছে যে দীর্ঘ ভিডিও তৈরি করে বাজফিডের বিজ্ঞাপন থেকে আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচন এবং ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির পর ক্রমবর্ধমান যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হওয়ায় ফেসবুকে সংবাদ ডিস্ট্রিবিউট করা কমিয়ে দিয়েছে মেটা, যার ফলে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হচ্ছে তাদের কন্টেন্ট শেয়ারের জন্য ফেসবুক বাদ দিয়ে অন্য প্ল্যাটফর্মে যেতে।
কিন্তু ফেসবুকের নিউজ ফিডের কল্যাণে বড় হওয়া বাজফিডের মতো ডিজিটাল-নেটিভ প্রকাশনাগুলোর জন্য সামাজিক ওয়েবের এই পরিবর্তন এক বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়ন ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যাওয়া টিকটক এক অপ্রতিরোধ্য সামাজিক মাধ্যম হয়ে উঠেছে, যা প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীদের চোখকে এর সাথে আটকে রাখছে। নতুন সোশ্যাল ওয়েবগুলো ব্যবহারকারীদের চোখকে আটকে রাখার এই মডেলটিকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে, যা ডিজিটাল-নেটিভ এবং ট্রেডিশনাল মিডিয়া দুটিকেই হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে, অনেক নতুন নিউজ আউটলেট পেওয়ালের পেছনে নিজেদেরকে আটকে রেখেছে। কিন্তু বাজফিডসহ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরশীল অন্যান্য অনেক ডিজিটাল প্রকাশকের ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব হয়নি।