জলযোগ: যশোরের ১৩০ বছর পুরোনো মিষ্টির দোকান এখনো ধরে রেখেছে আদি স্বাদ ও ঐতিহ্য
উনিশ শতকের শেষের দিক। অবিভক্ত ভারতের অন্যতম নগরী যশোরের এক জমিদারের গাঁতিদার ছিলেন কালীপদ বিশ্বাস। জমিজমার খাজনা আদায় করাই ছিল তার মূল কাজ। বছরে তখন ফসল উঠত একবারই। সেই আয়ে বিশাল পরিবারকে সামলাতে গিয়ে প্রায়ই হিমশিম খেতে হতো কালীপদ বাবুকে। বাড়তি আয়ের বন্দোবস্ত করতে তাই শহরের রেলরোডের পাশে শুরু করেন চা-নাস্তা আর মিষ্টি খাবারের দোকান জলযোগ। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই জলযোগ এখনো মিশে আছে যশোরবাসীর ঐতিহ্যের সঙ্গে।
'দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যশোর শহরে এলে কেউ জলযোগের মিষ্টি না চেখে যায় না,' বলছিলেন দোকানটির বর্তমান কর্ণধার সাধন বিশ্বাস, কালীপদ বিশ্বাসের নাতি। কথাটি অবশ্য ফেলে দিতে পারলাম না। ঈদের ছুটিতে একদিনের জন্য যশোরে গিয়ে কী কী দেখব আর খাব সে তালিকায় আমরাও প্রথম দিকেই রেখেছিলাম শতবর্ষাধিক পুরোনো জলযোগের নাম।
শহরের দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সড়ক অর্থাৎ রেলরোড ধরে এগিয়ে গিয়ে মেইনরোডের পাশেই দেখা মেলে লাল সাইনবোর্ড আর নীল দরজায় সাজানো ছোট্ট দোকান জলযোগের। দরজার বাইরে এক কোণে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন, আরেক দিকে মিষ্টির খালি বাক্সের স্তূপ। ভেতরে অল্প খানিকটা জায়গায় চারটা টেবিল আর বেশ কিছু বসার বেঞ্চ পাতা। একপাশে হলদে রঙের আলমারির তাকে তাকে সাজানো নানান পদের মিষ্টি। তার সামনে বড় গামলায় ডাল আর ঝুড়িভর্তি গরম গরম ভাজা লুচি।
সাধন বাবু জানালেন সব ধরনের মিষ্টি এখানে নেই এখন। সকাল থেকে শুরু করে দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যায় বিশেষ মিষ্টিগুলো। তবে বিকেলবেলায় এসেও ছানার পোলাও, মিহিদানা, রসমালাই, পানতোয়া, কালোজাম, রাজভোগ, চমচম আর টক-মিষ্টি দইয়ে সাজানো আলমারির তাক দেখে যেকোনো মিষ্টিপ্রেমীই কাবু হতে বাধ্য।
টেবিলগুলোতে বসার জায়গা পেতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল কিছুক্ষণ। এ ফাঁকে সাধনবাবুর সঙ্গে আলাপ করে ঘুরে এসেছিলাম জলযোগের সোনালি অতীত থেকে। কালীপদ বাবুর সময় এত পদের মিষ্টি ছিল না এখানে। শুরুতে শুধু লুচি, ডাল, চা আর অল্প কয়েকপদের মিষ্টি তৈরি হতো। ব্রিটিশ ভারতের যেসব ব্যবসায়ীরা দূর-দূরান্ত থেকে যশোরে আসতেন তাদের জলযোগের ব্যবস্থা হতো এখানেই। রেলস্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় ভিড় লেগেই থাকত দোকানে।
বর্তমানে দোকানে যেসব আসবাবপত্র আছে তার বেশিরভাগই শত বছরের পুরোনো। তখন টেবিলের ওপরের পাটাতন ছিল পাথরের। খাবার পরিবেশন করা হতো কাসার থালা-বাটিতে। সময়ের পরিবর্তনে কাচের থালা-বাটির প্রচলন শুরু হলে পাথরের পাটাতন সরিয়ে সম্পূর্ণ কাঠের টেবিল আনা হয় দোকানে। কারণ পাথরে ধাক্কা লেগে সহজেই ভেঙে যেত কাচের বাসনপত্র।
ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসায় সাহায্য করতেন কালীপদ বিশ্বাসের ছেলে ও সাধন বিশ্বাসের বাবা অজিত কুমার বিশ্বাস। সাধন বিশ্বাসের বয়স যখন ১০-১২, তখন থেকেই বাবার সঙ্গে নিয়মিত দোকনে আসতেন তিনি। তার বাবার আমলের অনেক কর্মচারী এখনো কাজ করছেন তার অধীনে। ৫৫ বছর ধরে জলযোগে কাজ করা নারায়ণ কুমার জানান, এখানে কেউ কাজ শুরু করলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছেড়ে যান না। কালীপদ বাবুর আমলের এক বাবুর্চি সাত বছর বয়সে কাজ শুরু করছিলেন জলযোগে। ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন এখানেই।
টেবিলে বসার সুযোগ পেয়েই অর্ডার করলাম লুচি, ডাল, রসমালাই আর ছানার পোলাও। খেতে খেতে কথা হলো পাশে বসা ষাটোর্ধ্ব ইকবাল চৌধুরীর সঙ্গে। জানালেন, অজিত বাবুর সময় থেকেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে জলযোগে খেতে আসতেন তিনি। পঞ্চাশ বছর ধরে দোকানটির একইরকম চিত্র দেখে এসেছেন তিনি। বর্তমানে কাজের সূত্রে ঢাকায় স্থায়ী হয়েছেন। তবে যশোরে এলে জলযোগের নাস্তা করতে ভুল হয় না তার। এবারেও সকালে শহরে পৌঁছে বিকেলেই হাজির হয়েছেন জলযোগে।
এখানে এসে ইকবাল সাহেবের অর্ডারও থাকে প্রায় অভিন্ন। লুচি ডালের পাশাপাশি রসমালাইয়ের রসে মেখে ছানার পোলাও খেতে পছন্দ করেন তিনি। বর্ণনা শুনে রসমালাইয়ে মেখে ছানার পোলাও খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না আমরাও। এখানকার গুড়ের সন্দেশও তার পছন্দের তালিকায় অন্যতম বলে জানালেন।
পুরোনোদের পাশাপাশি নতুনদের আগমনও কম হয় না জলযোগে। বাবা-মায়ের হাত ধরে পুঁচকেরাও এসে লুচি-মিষ্টির স্বাদ নেয় এখানে। সাধন বিশ্বাস জানান, যশোরের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের বিয়ে বা বড় কোনো অনুষ্ঠানের খাবার মেন্যুতে বিশেষ স্থান পায় জলযোগের মিষ্টি।
জলযোগের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলায়। কিন্তু সীমানা ভাগ হলেও ওপার বাংলায় এখনো কদর কমেনি জলযোগের নলেন গুড়ের সন্দেশের। বেড়াতে আসা পর্যটক বা এপারের আত্মীয়স্বজনের হাতে করে প্রায়ই ওপারে পৌঁছায় খাঁটি ছানা আর গুড়ের সুগন্ধিযুক্ত এই সন্দেশ।
এত বছরের স্বনামধন্য দোকান হলেও তাতে সব খাবারের দাম এখনো হাতের নাগালেই। ডাল বা সবজি প্রতি প্লেট ১৫ টাকা, লুচি প্রতিটি সাত টাকা। উল্লেখযোগ্য মিষ্টির মধ্যে প্রতি কেজি নলেন গুড়ের সন্দেশ ৪৬০ টাকা, ছানা পোলাও ২৮০ টাকা, রসমালাই ৪৪০ টাকা, রাজভোগ ৩৫০ টাকা, পানতোয়া ৩০০ টাকা আর মিহি দানা পাওয়া যায় ৩৫০ টাকায়।
বাপ-ঠাকুরদার আমলের সুনাম ধরে রাখতে এখনো বদ্ধ পরিকর সাধন বিশ্বাস। দেশে নানা ধরনের ফিউশন মিষ্টির চল শুরু হলেও সেগুলো বানানোয় আগ্রহ নেই তার। শতবর্ষী রেসিপিতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিগুলো তিনি বিক্রি করেন আদি নামেই। জলযোগের হাত ধরে দেশীয় মিষ্টির সুনাম যেন টিকে থাকে অনন্তকাল, সে স্বপ্নই দেখেন তিনি।