শতবর্ষের স্বাদ এখনও লক্ষ্মী নারায়ণের মিষ্টিতে!
'যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা,' আহমদ ছফাকে দেওয়া অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বিখ্যাত উপদেশ। নতুন কোনো অঞ্চলে গেলে সে জায়গার মানুষকে জানতে অধ্যাপক সাহেবের এই উপদেশ আমিও অনুসরণ করার চেষ্টা করি সবসময়। এক্ষেত্রে মানুষের খাদ্যাভ্যাস জানতে কাঁচাবাজারের পাশাপাশি বহু বছরের পুরানো খাবারের দোকানও বেশ আকর্ষণীয় জায়গা আমার কাছে। আর ভাগ্যক্রমে যদি দেখা মেলে তিন পুরুষ পুরানো কোনো মিষ্টির দোকানের, তবে তো আর কথাই নেই!
সব বয়সী, আর সব শ্রেণির ক্রেতার আনাগোনার দেখা মেলে এলাকার প্রাচীন মিষ্টির দোকানগুলোতে। বেশিরভাগ দোকানেই মিষ্টির পাশাপাশি অল্পবিস্তর চা-নাস্তারও আয়োজন থাকে। দোকানের ভেতরে চায়ের টেবিলের প্রাণোচ্ছল আড্ডায় জানা যায় সে অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস আর এলাকার চলতি সব খবরাখবর।
কিশোরগঞ্জের এমন প্রাচীন এক মিষ্টির দোকান 'লক্ষ্মী নারায়ন মিষ্টান্ন ভান্ডার'। জেলা শহরের একরামপুর এলাকায় মৃত নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত দোকানটিকে বাইরে থেকে দেখে চোখে পড়ে না কোনো বিশেষত্ব। আর দশটি সাধারণ মিষ্টির দোকানের মতোই সামনের কাচের বাক্সে সাজানো রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, জিলাপি আর বাতাসা। আগের দিনের লম্বা এক কাঁচের আলমারিতে রাখা সন্দেশ, বরফি, কাঁচাগোল্লাসহ নানা ধরনের মিষ্টি। একপাশে চারটি টেবিল পাতা, আর পেছনের দিকে নিরিবিলিতে বসার জন্য আছে দুটি কেবিন। শতবর্ষ ধরে কাঁচাগোল্লা, রসগোল্লা আর রসমঞ্জুরীর স্বাদে শহরবাসীর মন জয় করে সগৌরবে টিকে থাকা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টির দোকান এই লক্ষ্মী নারায়ণ।
ঠিক কত সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল দোকানের তা মনে করতে পারেননি লক্ষ্মী নারায়ণের বর্তমান মালিক অলক বসাক। দাদা স্বর্গীয় আনন্দ চন্দ্র বসাকের আমলে প্রতিষ্ঠিত দোকানটি দেখাশোনার ভার ন্যস্ত হয়েছে তিনি ও তার বড় ভাই মানিক চন্দ্র বসাকের ওপর। ষাটের দশক থেকে লক্ষ্মী নারায়ণের জমজমাট স্মৃতির কথা মনে আছে অলকের। বাবা স্বর্গীয় রাম নারায়ণ বসাকের মুখে গল্প শুনেছেন, ব্রিটিশ আমলে যখন ব্যবসার শুরু তখন পাশের নরসুন্দা নদী ছিল খরস্রোতা। শহরের বাসিন্দারা নদীপথে যাতায়াত করতেন দূর-দুরান্তে। তেলের বাতি জ্বলত দোকানে। সন্ধ্যে হলেই আর মানুষ থাকত না রাস্তায়।
দোকানে পাওয়া যেত রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা, রসমঞ্জুরী (রসমালাই) আর বাদশাভোগ। ব্রিটিশ আমলে কিশোরগঞ্জের সুগারমিল আর পাটকলে যেসব পাকিস্তানি কর্মকর্তা কাজ করতেন, তারা করাচি ফেরার সময় প্রতিবার লক্ষ্মী নারায়ণের কাঁচাগোল্লা আর রসমালাই নিতে ভুলতেন না।
বড় গোলাকার মিষ্টি বাদশাভোগের এক একটি ছিল এক পোয়ার চেয়েও বেশি ওজনের। একটা মিষ্টির দাম পড়ত আট আনা। অলক যখন দোকানের দায়িত্ব নেন তখন দুই থেকে আড়াই টাকা কেজি দর ছিল মিষ্টির।
অলক বসাক বলেন, "তখন তো শহরে মানুষজনই ছিল খুব কম। লক্ষ্মী নারায়ণের সমসাময়িক যেসব মিষ্টির দোকান ছিল সেগুলো সবই হয় বন্ধ হয়ে গেছে, না হয় মালিকানা পরিবর্তন হয়ে সুনাম হারিয়েছে। বংশ পরিক্রমায় দেখাশোনা করে দোকানের নাম টিকিয়ে রেখেছি আমরা।"
বর্তমানে রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা, রসমঞ্জুরী, চমচম, কালোজাম, দই, ছানার আমিত্তি, জিলাপি, সন্দেশ ছাড়াও নানাধরনের মিষ্টি বিক্রি হয় লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে। এখানকার মিষ্টি দামেও বেশ সাশ্রয়ী। প্রতি কেজি রসগোল্লার দাম ২৮০ টাকা, চমচম আর কালোজাম ২৪০ টাকা, মালাইকারী ৩৫০ টাকা, রসমঞ্জুরী ৪৮০ টাকা, কাঁচাগোল্লা আর সন্দেশ ৭০০ টাকা।
শুরুতে পরিবারের সদস্যরাই সরাসরি যুক্ত ছিলেন লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টির কারিগর হিসেবে। বর্তমানে কারিগরসহ মোট ছয় জন কর্মী কাজ করেন এখানে। রোজ সন্ধ্যায় মিষ্টি বানানো হয় দোকানে। প্রতিদিন গড় প্রায় আড়াই-তিন মণ মিষ্টি তৈরি হয়। ঈদের সময় চাহিদা বেশি থাকায় মিষ্টির পরিমাণও বাড়ে।
রোজ সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কেনাবেচা চলে লক্ষ্মী নারায়ণে। মিষ্টির পাশাপাশি নাস্তা হিসেবে সকাল ১০টা পর্যন্ত পাওয়া যায় পরোটা-ভাজি।
সকালের নাস্তায় লক্ষ্মী নারায়ণের মুচমুচে পরোটা বেশ প্রিয় ষাটোর্ধ্ব শাহজাহান সাহেবের। প্রায়ই ভোরে হাঁটাহাঁটি শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে এখানে নাস্তা করতে আসেন তিনি। তার ভাষ্যে, "কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় এখানে। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে মিষ্টি কিনতে আসতাম আমি। আমার ছোট মেয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকে। বাড়িতে এসেই তার প্রথম আবদার থাকে লক্ষ্মী নারায়ণের এলাচসহ রসগোল্লার। গিন্নির পছন্দ কাঁচাগোল্লা। এখানে নাস্তা করতে আসলে সবসময় তার জন্য পরোটা আর কাঁচাগোল্লা নিয়ে যাই বাসায়।"
মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মী নারায়ণে মিষ্টি কিনতে এসেছিলেন রোকেয়া সুলতানা। বললেন, "ছেলের শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি। এখানকার রসমালাই আমার বেয়াইনের খুব পছন্দ। নিজেদের বাসার জন্য মিষ্টি কিনতে হলেও সবসময় এখানেই আসি পরিবারের সবাই।"
অলক বাবু জানালেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদেরও পছন্দের মিষ্টির দোকান লক্ষ্মী নারায়ণ। ছাত্র জীবনে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তিনি প্রায়ই নাস্তা করতে আসতেন এখানে।
তিন পুরুষের এই লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুনাম বংশানুক্রমে আরো শতবছর টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখেন অলক বসাক আর তার ভাই মানিক চন্দ্র বসাক।