পুরুষবিহীন গ্রাম উমোজা ও পল নিনসনের ক্যামেরায় আফ্রিকার গল্প
কেনিয়ার সাম্বুরু কাউন্টির গ্রাম উমোজা। এটি বাকি সব আদিবাসী গ্রামগুলোর মতোই, আশেপাশে আছে তৃণভূমি ও বসতিগুলো কুঁড়েঘরের। স্থানীয় সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ীই চলে জীবনযাপন। পার্থক্য একটিই, উমোজায় কোন পুরুষ নেই।
কিসোয়ালী ভাষার শব্দ 'উমোজা' অর্থ একতা। আক্ষরিক অর্থেই এখানের বসবাসকারীদের মধ্যে একতা বিদ্যমান। সাম্বুরুতে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার কবলে পড়া নারীদের জন্য ১৯৯০ সালে গ্রামটির প্রতিষ্ঠা। এটি এখন সব বয়সী নারীদের আবাসস্থল। যৌন সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে বেঁচে ফেরা, পরিবারে বঞ্চনার শিকার, সেই সাথে বাল্যবিবাহ বা যৌনাঙ্গচ্ছেদের মতো ঘটনা থেকে পালিয়ে আসা মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করতে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে উমোজায়।
ঘানার ফটোগ্রাফার পল নিনসন প্রথমে একটি ব্লগ পোস্ট থেকে উমোজার নারীদের সম্পর্কে জানতে পারেন। ২০১৭ সালে এই গ্রামের ছবি তোলার জন্য কেনিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। উমোজায় যাওয়ার কারণ হিসেবে নিনসন জানান, তিনি অনুভব করেছিলেন যে, নারীদের গল্পগুলো একটি আফ্রিকান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা দরকার। নারীদের সাথে কোন যোগাযোগ না করেই গ্রামের অবস্থান জেনে তিনি তার সফর শুরু করেন।
উমোজার প্রথমদিকের কয়েকজন সদস্য সাম্বুরুর বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছেন। তাদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বর্তমানে স্ব-নির্ভর গ্রামটিতে ৫০টি পরিবারের বসবাস। নারী এবং তাদের সন্তানদের নিয়েই প্রতিটি পরিবার গঠিত। পুরুষ শিশুদের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানকার সব বাসিন্দাকেই নারীর অধিকার এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিষয়ে পড়ানো হয়।
নিনসন জানান, উমোজায় (ছবি তুলতে) ঢুকতে পারা ছিল কঠিন এক কাজ। তবে নিজের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর নারীরা তাকে স্বাগত জানায়। আর নিজেদের ছবিগুলো দেখে তারা 'খুব, খুব খুশি' ছিলেন। নিনসন জানান, সেখানের বাসিন্দারা পরিমিত জীবনযাপন করেন। নারীরাই উপার্জন করেন।
উমোজা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে 'মাসাই মারা ওয়াইল্ডলাইফ রিজার্ভ' অবস্থিত। অনেক পর্যটক এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য দেখতে আসেন। উমোজা পরিদর্শন করতে ইচ্ছুক পর্যটকদের ছোট অংকের প্রবেশমূল্য দিতে হয়। তারা সম্বুরু নারীদের হাতে তৈরি পুঁতির গহনা এবং অন্যান্য কারুকাজ কিনতে পারেন।
কমিউনিটি স্টোরিটেলিং
'ভিলেজ উইথ নো ম্যান' নিনসনের কয়েকটি ফটোগ্রাফি সিরিজের একটি। এই ফটোগ্রাফার জানান, তিনি এমন ছবি তুলতে যান, যা 'সামাজিক, পরিবেশগত বা রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় এবং মানুষকে পদক্ষেপ নিতে, চিন্তাভাবনা করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে উদ্বুদ্ধ করে।'
নিনসন আফ্রিকান দেশগুলো ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এই ভেবে যে, তিনি এই মহাদেশের একেবারেই অপ্রকাশিত কিংবা স্বল্প প্রকাশিত গল্পগুলো তুলে আনতে চান। এই ফটোগ্রাফি সিরিজের নাম তিনি দিয়েছেন 'কমিউনিটি স্টোরিটেলিং'।
নিনসন বলেন, কোন ঘটনা না গল্প বর্ণনায় আমাদের (আফ্রিকানদের) দুর্বলতা আছে। আর আফ্রিকা যেভাবে বিশ্বের কাছে চিত্রিত হয়েছে, তা বহিরাগতদের মাধ্যমে এই মহাদেশের গল্প প্রচারের ফলাফল।
ঘানা, কেনিয়া এবং ইথিওপিয়ার আশেপাশে তোলা ছবিগুলোর মাধ্যমে নিজের পোর্টফোলিও ভারি করেন নিনসন। এরপর ২০১৯ সালে তিনি নিউইয়র্কে যান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব ফটোগ্রাফিতে পড়তে। সেখানে তিনি গল্প বলার প্লার্টফর্ম 'হিউম্যানস অব নিউ ইয়র্ক' এ ব্র্যান্ডন স্ট্যান্টনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন।
সিএনএনকে স্ট্যান্টন বলেন, ২০১৬ সালে ঘানায় একসঙ্গে কাজ করা শুরুর পর তিনি নিনসনের প্রতিভা ও সংকল্পে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। নিনসনের বিশ্বাসই তার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। স্ট্যান্টন তাকে আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিসেবেও বর্ণনা করেন।
আফ্রিকার বৃহত্তম ফটোগ্রাফি লাইব্রেরি
নিনসন জানান, নিউইয়র্কে পড়াশোনার সময় থেকে আফ্রিকানদের লেখা কিংবা আফ্রিকানদের নিয়ে লেখা ফটোবুক জমা করা শুরু করেন তিনি। যে বইগুলো আফ্রিকায় পাওয়া যায় না।
ঘানায় পাঠানোর জন্য নিনসন যত বেশি সম্ভব বই কেনার সিদ্ধান্ত নেন। একসময় তার অ্যাপার্টমেন্টে সেগুলো রাখার জায়গা হতো না। পরবর্তীতে, স্ট্যান্টন ও হিউম্যানস অব নিউইয়র্কের সহায়তায় নিনসন প্রায় ১০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেন এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঘানার রাজধানী আক্রা-তে উদ্বোধন করেন আফ্রিকার বৃহত্তম ফটোগ্রাফি লাইব্রেরি 'ডিকান সেন্টার'।
লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করেন স্ট্যান্টন। তিনি বলেন, নিনসনের ডিকন সেন্টার নির্মাণ করতে দেখা অনেকটা 'অবাস্তবের' মতো। স্ট্যান্টন বলেন, নিনসন খুব সহজে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করেছে। তার কাছে আসা মানুষদের দেখলে মনে হয় তারা ঘানার ভবিষ্যত কোন নেতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। নিনসন এত সফলভাবে ডিকন সেন্টার চালু করেছে যে, এটি তার অভিজাত ফটোগ্রাফার হওয়ার সত্তাকে ছাপিয়ে গেছে।
নিনসন জানান, তিনি এরই মধ্যে আফ্রিকান গল্পকারদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাদেরকে ফটোবুকের বিশাল লাইব্রেরিতে বিনামূল্যে প্রবেশের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং ছবি প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
মানুষদের একে অপরের সাথে এবং তাদের চারপাশের বিশ্বের সাথে সংযুক্ত করাই নিজের লক্ষ্য বলে জানান নিনসন। তিনি বলেন, আগামী বছর আবারো উমোজায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে আমার।
এই ফটোগ্রাফার বলেন, 'আমি গল্প বলার শক্তিতে বিশ্বাস করি। এতে মানুষদের একত্রিত করার এবং বিশ্বকে নতুন এবং অপ্রত্যাশিত উপায়ে দেখতে সাহায্য করার ক্ষমতা আছে।'