আক্কেলপুরের ‘ইঁদুর আনোয়ার’: ৪৫ বছর ধরে ইঁদুর শিকার করছেন তিনি
বহুবছর আগে একদিন ধানক্ষেতে কাজ করছিলেন আনোয়ার। হঠাৎ দেখলেন, একটা গর্তের ভেতর একদল ইঁদুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে। কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একটা ইঁদুর ধরে ফেললেন আনোয়ার। আরও অবাক হয়ে দেখলেন, গর্তের ভেতর অনেক ধান জমে আছে।
আনোয়ারের বয়স তখন ১৬ — অন্যের ক্ষেতে কাজ করতেন তিনি। ধানগুলো পেয়ে পুঁটলি বেঁধে নিলেন, তারপর মানুষের বাড়ি থেকে সেগুলোর বিনিময়ে কিছু মোয়া-মুড়কি পেলেন।
মোয়া-মুড়কি খেয়ে ভালো লাগল আনোয়ারের। আবার গেলেন মাঠে, ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এভাবে দীর্ঘ কয়েক বছর পর দক্ষ ইঁদুরশিকারি হয়ে উঠলেন আনোয়ার। তার পেশাও হয়ে গেল সেটি।
আজ ৪৫ বছর ধরে ইঁদুর শিকার করছেন আনোয়ার।
'গরীবঘরে জন্মেছি। ছোটবেলা থেকেই অন্যের ক্ষেতে কাজ করি। সেদিন ইঁদুরের গর্তে ধান পাওয়ার পর সেগুলা দিয়ে মোয়া-মুড়কি খেতে পারাটা আমার জীবনের অন্যতম আনন্দ ছিল,' বলেন আনোয়ার হোসেন।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নূর নগরের বাসিন্দা আনোয়ার। তার বাড়ি খুঁজে পেতে বেশি হয়রান হতে হয়নি, কারণ সেখানে তাকে সবাই তার ডাকনামে — ইঁদুর আনোয়ার — চেনেন।
খুব সকালে তার বাড়িতে গিয়ে উঠি আমরা। দিনের বেলা নওগাঁর একটি ছোট দোকানে ইঁদুর মারার ঔষধ বিক্রি করেন তিনি। তবে সে বিক্রিবাট্টা চলে যখন মাঠে ইঁদুর শিকারের মৌসুম থাকে না।
আশ্বিন থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত সারাদেশে ঘুরে বেড়ান আনোয়ার। বিশেষ করে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের দিকে বেশি ইঁদুর শিকার করেন তিনি।
'তাদের ক্ষেতে ইঁদুর ধরার জন্য মানুষ ডেকে নিয়ে যায় — বেশিরভাগই ধান আর আলুক্ষেত। তবে ঘরবাড়িতেও ইঁদুর ধরি,' বলেন তিনি।
পেশা হিসেবে ইঁদুর ধরাকে বেছে নিলেন কেন আনোয়ার? তার প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক ছিলেন কৃষি কর্মকর্তা — আনোয়ারের ইঁদুর ধরা পেশা সৃষ্টির পেছনে ওই ভদ্রলোকের অবদান আছে।
১৯৮০-এর দশকের কোনো একদিন ওই কর্মকর্তা আনোয়ারের কাছে জানতে চান, ধরার পর ইঁদুরগুলো দিয়ে তিনি কী করেন। স্বভাবতই আনোয়ার ইঁদুর ধরার পর সেগুলো মেরে ফেলে দিতেন। কিন্তু ওই কৃষি কর্মকর্তা তাকে ইঁদুরের লেজগুলো জমিয়ে রাখতে বললেন।
কারণ ওসব লেজ স্থানীয় কৃষি অফিসে জমা দিলে তার বিনিময়ে গম পাওয়া যাবে। ওই সময় প্রতি একটি লেজের জন্য সরকার আধাসের করে গম দিত।
'এ পুরষ্কারের কথা জানার পর আমি ইঁদুর মেরে প্রতি সপ্তাহে লেজগুলো স্থানীয় কৃষি অফিসে নিয়ে যেতাম। যে গম পেতাম, তাতে পরিবারের বেশ উপকার হতো,' আনোয়ার বলেন।
আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি অফিসে প্রতি বছর আনোয়ার ১০ থেকে ১২ হাজার ইঁদুরের লেজ জমা দেন।
'আগে ইঁদুরের কারণে অনেক ফসল নষ্ট হতো। এমনকি এখনো কৃষকদের জন্য ইঁদুর একটি বড় সমস্যা,' আনোয়ার জানান।
আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০২২ সালেই আক্কেলপুর উপজেলায় ৬৭ দশমিক ৫ মেট্রিক টন ধান, ৪৩ মেট্রিক টন আলু ও তিন মেট্রিক টন গমের ফসলের ক্ষতি করেছে ইঁদুর। এতে কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা।
এছাড়া সরকারি কৃষি বাতায়নের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ইঁদুরের কারণে বাংলাদেশে কৃষকেরা প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ফসল, ফল ও আসবাবপত্রের ক্ষতির শিকার হন।
'এ কাজে আমার গর্ব আছে। আমি অনেক গরীব কৃষককে সাহায্য করি,' বলেন আনোয়ার।
ইঁদুর শিকারের জন্য ধরাবাঁধা কোনো পারিশ্রমিক নেই আনোয়ারের। 'মানুষ খুশিমত দেয়। যার যা সামর্থ্য, আমি কিছু মনে করি না।' সাধারণত, একবার শিকার অভিযানের জন্য আনোয়ার ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পান।
আনোয়ারের এ শখকে টিকিয়ে রাখার পেছনে অবদান রয়েছে বিভিন্ন পুরষ্কার, শংসাপত্র, স্বীকৃতি ইত্যাদির। যেমন, ২০০৫ সালে আনোয়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে ২৩ হাজার ৪৫১টি ইঁদুরের লেজ জমা দিয়েছিলেন। তার পুরষ্কার হিসেবে পান একটি ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন। সেটি পাওয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছিল তার বাচ্চারা।
২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পাওয়া প্রায় ২০টির মতো পুরষ্কার-সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট ইত্যাদি দেখালেন আনোয়ার।
এত ইঁদুর কীভাবে মারলেন তা জানতে চাইলে আনোয়ারকে বেশ বিনয়ী শোনাল। 'আমার কোনো জাদু জানা নেই। গত কয়েক দশকে শেখা জ্ঞান আর কৌশলকে কাজে লাগাই আমি।'
আনোয়ার এখন কেবল মাটির দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারেন ওই মাটির তলায় ইঁদুর আছে কি না।
'ইঁদুর আছে কি না বুঝতে পারা সহজ, বিশেষ করে মাটির গন্ধ থেকে সহজেই বোঝা যায়। ইঁদুর থাকলেই সেখান থেকে ইঁদুরের মল-মূত্রের গন্ধ বের হবেই,' তিনি ব্যাখ্যা করেন।
লম্বা নলের মতো একটি প্লাস্টিকের পাইপ বের করে দেখালেন আনোয়ার। গায়ে অনেকগুলো গর্ত। তিনি জানান, বেশ কয়েক দশক আগে এ ফাঁদ তৈরি করেছেন তিনি।
পাইপের দুই দিকে টিনের পাতের তৈরি দুটো ব্লক প্রবেশ করানো যায়। ব্লকের ভেতরটা ফাঁপা থাকে। ভেতরে খাবার রেখে ওই ব্লকগুলো প্রবেশ করিয়ে দিতে হয়। ইঁদুর ব্লকের মধ্যে দিয়ে সহজেই পাইপের ভেতরে খাবার খেতে ঢুকতে পারে। কিন্তু বের হতে গেলেই ব্লকের ভেতরের অংশে থাকা সুচালো মুখে বাধা পায় এটি।
ফাঁদটা খুব সহজ, কিন্তু বেশ কাজের। আনোয়ার এটা বিক্রি করেন না, তবে মানুষকে এ ফাঁদ বানানো শিখিয়ে দেন।
রাইকালির কৃষক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, একটা ইঁদুরই প্রায় ৪০ কেজির মতো আলু নষ্ট করতে পারে। 'তাহলে ভাবেন অনেকগুলো ইঁদুর কত ফসল নষ্ট করবে,' বলেন তিনি।
ইদ্রিস আলী জানান, ইঁদুর থেকে বাঁচতে আক্কেলপুর ও এর আশপাশের উপজেলার কৃষকেরা আনোয়ারের দক্ষতার ওপর অনেকটাই নির্ভর করেন।
কিন্তু আনোয়ারের একার পক্ষে এত কৃষককে সেবা দেওয়া কীভাবে সম্ভব। আনোয়ার জানান, দেশজুড়ে তার ৫৭ জন শিষ্য আছেন। এদের অনেকেই তার সঙ্গে কাজ করেন, আবার অনেকে স্ব-উদ্যোগেই ইঁদুর শিকার করেন।
আনোয়ারের একজন শিষ্য তার পুরষ্কারগুলো ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। আনোয়ার জানালেন, জীবনের বাকিটা সময় তিনি ইঁদুর শিকার আর এটি নিয়ে গবেষণা করেই কাটিয়ে দিতে চান। তার আশা, মৃত্যুর পর তার শিষ্যরা তার এই কিংবদন্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।