নিমতনামা: ভারতবর্ষের রন্ধনশৈলী গড়ে দিয়েছে মধ্যযুগের যে বই
কিরগিজিস্তানের রাজধানী বিশকেক, এখানকার আলা-তু চত্বর বেশ মনোরোম– চারপাশে গোলাপ ঝাড়বেষ্টিত সুন্দর এক ফোয়ারা মাঝখানে। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে সেপ্টেম্বর আসার আগে নেই রোদের তীব্রতা । বাতাসে ভেসে আসছিল গোলাপ ও উনুনে টাটকা তৈয়ার পেস্ট্রির ঘ্রাণ। সন্ধ্যা হতেই চত্বরে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়।
আগতদের অনেকের হাতেই ছিল কাগজের তৈরি মোড়ক, যাতে রাখা ছিল 'সামসা' নামের মুখরোচক নাস্তা।
ভেড়ার মাংসের কিমা ও চর্বির পুরু স্তর দেওয়া এই নাস্তা ত্রিকোণ আকারে তৈরি করা হয়। ভাবছেন, চেনেন তো। দূরদেশে এতো স্বদেশী খানার বয়ান। আসলে পুরোপুরি ভুল ভাবেননি খাদ্য রসিক, আমাদের প্রিয় সমুচা-ই তার মধ্য-এশিয়ার উৎপত্তিস্থলে এ নামে পরিচিত।
সামসার খ্যাতি ও সমাদর যে আজ বিশ্বজুড়ে – মরক্কো থেকে বাংলাদেশ – সর্বত্র। এরমধ্যে নানান দেশ ও অঞ্চলে – সামবুসাক, সামুসাক, সামোসা, সমুচা কত নামের বাহার।
দক্ষিণ এশিয়াবাসী সমুচাকে আপন করে নিয়েছেন বহু যুগ আগেই। উপমহাদেশের আজকের দিনে অতি-পরিচিত এই নাস্তার আদি জন্মস্থান কিরগিজাস্তানের রাজধানী। তারপর কালে কালে উপাদান ও অনুষঙ্গে কতই না পরিবর্তন, সংযোজন দেখেছে সামসা।
শতাব্দীর পরিক্রমায় উপমহাদেশের রন্ধনশৈলীতে বিভিন্ন সংস্কৃতির অনবদ্য মিলমিশের প্রতীক হয়ে উঠেছে সামসা। ভারতবর্ষের সাথে মধ্য এশিয়ার বহু যুগের সম্পর্কের তা নিদর্শনও।
সামসার সবচেয়ে প্রাচীন প্রস্তুতপ্রণালীর বর্ণনা থাকা বইটি কিন্তু সযত্নে রক্ষিত আছে ৩,৪০০ মাইল দূরে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে।
কিতাব নিমতনামা -ই - নাসিরশাহী' নামের এ বইটির বাংলা তর্জমা দাঁড়ায়- 'নাসির শাহের সুখাদ্যের বই'। ১৫ শতকের বইটি সংক্ষেপে নিমতনামা নামেই পরিচিত। মধ্যযুগের এই রেসিপি গ্রন্থে রয়েছে খাদ্য প্রস্তুত ও পরিবেশনের মিনিয়েচার ছবি, আর তার সাথে হাতে লেখা পাদটীকা।
ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গেলে ১৬২৩ সালে প্রকাশিত শেক্সপিয়ারের নাটক সংকলন 'ফার্স্ট ফোলিও'র পাশেই পেয়ে যাবেন বইটির একটি কপি। যার প্রতিটি পাতা আজো মুগ্ধ করে খাদ্য ঐতিহাসিকদের। এমনই একটি পাতায় রয়েছে মাংসের কিমা, শুকনো আদা, রসুন ও বেগুন দিয়ে সামসা তৈরির ছবিসহ বর্ণনা।
ঐতিহাসিক উল্লেখ
ধারণা করা হয়, ১৩ শতকের দিকে নাস্তা হিসেবে উদ্ভব সমুচার। তখন একে বলা হতো সামুসাক। অভিজাত মুসলিম শ্রেণির ভোজের বর্ণনা দিতে গিয়ে এর উল্লেখ করেছেন সুফি পণ্ডিত, কবি ও গায়ক আমির খসরু। তিনি জানান, মাংস ও পেঁয়াজকে ময়দায় পুরে গাওয়া ঘিয়ে ডুবিয়ে সামুসাক ভাজা হতো।
এর প্রায় ৫০ বছর পর মাগরেব অঞ্চলের বিখ্যাত পর্যটক ও পণ্ডিত ইবনে বতুতা দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে কাজী বা বিচারক পদে নিযুক্ত হন।
দরবারের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে একসময় তিনি কাজে ইস্তফা দিয়ে ভারত ছাড়েন। কিন্তু, তাঁর আগে ছয় বছর ছিলেন কাজী পদে। এসময় ভারতের নানান অঞ্চল ঘুরে অভিজাত শ্রেণিসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাপিতজীবন, খাদ্যাভ্যাসের বর্ণনা লিখেছেন।
ভ্রমণকাহিনিতে বতুতা লিখেছেন, 'চীনে মাটির থালায় ঘি, পেঁয়াজ, কাঁচা আদা দিয়ে ভাজা মাংস পরিবেশন করা হতো… একে বলা হতো সামুসাক; এতে কিমা মাংসের পুরের সাথে আরো দেওয়া হতো কাঠবাদাম, কাজু, পেস্তা ও অন্যান্য মশলা। তারপর পাতলা রুটিতে মুড়ে ঘিয়ে ভাজা হতো। প্রত্যেকের পাতে সাধারণত চার থেকে পাঁচটি সামুসাক পরিবেশন করা হতো।'
'এ হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অব ইন্ডিয়া ফুড' বইয়ে খাদ্য ঐতিহাসিক কে. টি. আচার্য জানিয়েছেন, মুগল শাসন শুরু হওয়ার দুই শতক আগেই ভারতের রন্ধনশিল্পে আবিষ্কার ও সৃজনশীলতার এক জোয়ার আসে।
এসময় বিভিন্ন রাজা-সুলতানদের দরবারে খাদ্য হয়ে উঠেছিল বিলাসিতার এক উৎস, নিত্যনতুন রান্নাবান্নাকে তখন খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো।
বিরিয়ানি, নিহারি, পোলাওয়ের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় আজকে সুপরিচিত খাবারগুলো তখনই বর্তমানের রূপ নিতে থাকে।
আর নতুন রেসিপিগুলো লিখে রাখা হতো চমৎকার ছবিসহ বর্ণনার বইয়ে।
নিমতনামা
এ ধরনেরই একটি বই নিমতনামা। ভারতের রন্ধন সাহিত্যে যা এক উল্লেখযোগ্য অর্জন।
মালওয়ার সুলতান গিয়াস আল দ্বিন শাহ খিলজি ফার্সি ভাষায় বইটি লেখায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পরে তাঁর ছেলে নাসির শাহ সে কাজ শেষ করেন। বইয়ের নামও রাখেন নিজ নামে। এটি ১৪৬৯ থেকে ১৫০০ সন পর্যন্ত লিখিত হয়েছিল। বইটিতে থাকা ৫০টি ছবি কালের পরিক্রমায় আজো টিকে আছে।
তবে নেহাত রেসিপির সংগ্রহ নয় এই বই, এতে মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি তাদের ইতিহাস, উপকরণ ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উল্লেখ রয়েছে, ঐতিহাসিক তথ্যের বিচারে যা বলতে গেলে অমূল্য এক সম্পদ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, ভবিষ্যতে মানুষের খাদ্যরুচি কেমন হবে, তা নিয়েও আন্দাজের চেষ্টা রয়েছে এতে।
নিমতনামার আসল পাণ্ডুলিপি বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড ইন্ডিয়া অফিস কালেকশনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এর অনুবাদকারী নোরাহ টিটলে বইয়ের রচনা সম্পর্কে মূল্যবান কিছু তথ্য দিয়েছেন।
যেমন ছবি আঁকিয়ে শিল্পীকে দিকনির্দেশনা দিতে বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় খুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে বলে জানান টিটলে। অর্থাৎ, শিল্পীকে খাদ্যটি রান্না বা পরিবেশনের কোন দৃশ্য আঁকতে হবে এ ছিল তারই নির্দেশনা। যেমন সমুচা প্রস্তুতের ছবি যেখানে আঁকতে হবে সেখানে খুদে অক্ষরে লেখা ছিল 'সানবুসা'।
বইয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরার পাশপাশি বর্তমান যুগে এর রেসিপিগুলো অনুসারে রান্নাবান্না করার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও তুলে ধরেছেন টিটলে।
তিনি বলেন, (সাধারণ পাঠকদের কাছে) এর লেখা মনে হবে রহস্যময় ও সংক্ষিপ্ত – কারণ কালের পরিক্রমায় সে সময়ের রান্নাবান্নার সাধারণ অনেক বিষয়ই আজকের যুগের পাঠকের অজানা। তাছাড়া, কোন উপকরণ কী পরিমাণে লাগবে, তার বর্ণনাও বেশ বিরল নিমতনামায়। তারপরও অবশ্য মধ্যযুগের ভারতের জীবনযাত্রার সম্পর্কে জানায় এ বই, যেকারণে এটি অনন্য এক ঐতিহাসিক নথি।
বৈচিত্র্যময় নানান পদের রেসিপি ছাড়াও – ছবিগুলোও মুগ্ধ করবে পাঠককে, যেগুলো ইন্দো-ফার্সি শৈলীতে আঁকা।
প্রথমদিকের ছবিগুলোয় শিরাজের ফার্সি 'তুর্কমেন' চিত্রকলার ছাপ স্পষ্ট থাকলেও, পরের ছবিগুলোয় ভারতীয় শৈলীর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।শিল্প অনুরাগে যা গিয়াস শাহী শাসনের উদারতার প্রতিফলন।
১৪৬৯ সনে সুলতান গিয়াস আল দ্বিন শাহ খিলজির শাসনামল শুরু হয় – মসনদে থাকার সময় বিভিন্ন রকম বিনোদনের দিকে মনোযোগ দেন তিনি। প্রজারাও তাকে অনুসরণ করে চমৎকার সময় কাটাবে এমন আশাও করতেন।
সঙ্গীত, কবিতা, বই লেখার পৃষ্ঠপোষকতায় যথেষ্ট সময় দিতে শাহী দরবারের দৈনিক কাজের ভার ছেলে নাসির শাহের হাতেই দিয়ে দেন একপর্যায়ে।
ফলে তার মসনদে থাকার সময় মালওয়া রাজ্যের রাজধানী মান্ডু 'সুখের নগরী' নামে খ্যাতি লাভ করে। ঐ সময়ে শহরটির উৎসবমুখর ও বৈচিত্র্যময় আবহকে তুলে ধরছে এই খ্যাতি। চারপাশের জীবনধারার উদার এই প্রবাহই যেন উঠে এসেছে নিমতনামায়।
ওয়েলশের প্রয়াত মুসলিম পণ্ডিত মেরিল ওয়েইন ডেভিস খাদ্যাভ্যাসের সাথে আধুনিক যুগের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন তার 'ক্রিটিকাল মুসলিম, ফুড ইন ইসলাম' গ্রন্থে।
জীবনধারণে খাদ্যগ্রহণ মানুষের একটি অপরিহার্য চাহিদা। তাই আমরা যেভাবে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছি – তা আধুনিক যুগে বিভিন্ন জটিলতাও তৈরি করছে বলে এতে মতপ্রকাশ করেন তিনি।
একইভাবে, খাবারকে আরো মুখরোচক করার চেষ্টাও আমরা নিমতনামার মতো মধ্যযুগের রেসিপির বইয়ে দেখতে পাই। আর এই চেষ্টা করতে গিয়েই, রান্নায় যোগ হয়েছে নানান নিয়ম, অনুপান। এভাবে ধীরে ধীরে রান্নাবান্নাকে সূক্ষ্ম অথচ জটিল এক শিল্পের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মধ্যযুগের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক আধুনিক যুগ বা মুগল শাসনকালের (১৫২৬ -১৮৫৭ সন) রসনার সংস্কৃতি তুলে ধরেছে নিমতনামা ।
নিমতনামার অনুপ্রেরণা থেকেই মুগল যুগে পরবর্তী সময়ে আলওয়ান - ই - নিমাত, নুশখা -ই- শাহজাহানি এবং আইন -ই- আকবরির মতো গ্রন্থে খাদ্যের নানান বর্ণনা ঠাঁই পেয়েছে।
নিমতনামার পাশাপাশি এসব বই দক্ষিণ এশীয় রান্নাবান্নার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তৈরিতে অবদান রেখেছে, যা আজো বিদ্যমান।
নৃবিজ্ঞানী অর্জুন আপ্পাদুরাই বলেন, দক্ষিণ এশীয় খাবারের পরিচিত ও আদি উৎস সম্পর্কে এই বইগুলোর প্রভাব বেশ সুদূরপ্রসারী। ভারতীয় উপমহাদেশের রান্নার জাতীয় পরিচয় তৈরিতে তারা ভূমিকা রেখেছে। এক কথায়, বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।
তুর্কি ও ফার্সি সংস্কৃতির সাথে ভারতবর্ষের স্থানীয় সংস্কৃতির এই আদানপ্রদান সমুচার মাধ্যমে খুবই স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
মধ্য এশিয়ার জন্মস্থলে মাংসের পুর জনপ্রিয় হলেও, উপমহাদেশে সবজি, ডাল ও পেঁয়াজের পুর দেওয়া সমুচাই বেশি প্রচলিত।