ভাতে-মাংসে তৈরি যে মিষ্টান্ন ছিল ভারতের রাজপরিবারের পছন্দের শীর্ষে
আউধের নবাবদের একসময়কার মশহুর নগরী, উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌয়ে এক শীতল সন্ধ্যায় আমরা বসে আছি লেবুয়া লক্ষ্ণৌ সারাকা এস্টেটের প্রাঙ্গণে। ১৯৩০-এর দশকের এই এস্টেটকে পর্যটনের খাতিরে পরিণত করা হয়েছে বিলাসবহুল বুটিক হোটেলে। আমাদের সামনেই টেবিলভর্তি নানা রকমের উপাদেয় খাবার। পোস্তদানা ছিটানো বা জাফরান মাখানো রুটি, স্মোকি কাবাব, আর আছে চাল ও মাংসের মিশ্রণে তৈরি সুগন্ধি খাবার লক্ষ্ণৌয়ি বিরিয়ানি যা মুখবন্ধ পাত্রে রান্না করা হয়।
কিন্তু প্রধান শেফ মহসিন কুরেশি বললেন, আজকের সন্ধ্যার মূল আকর্ষণ এমন এক ডেজার্ট 'যা আপনি আগে কোনোদিন খাননি'।
এরপরে তিনি যা পরিবেশন করলেন, ওটাকে প্রথম দেখায় পরিচিত একটা খাবার বলেই মনে হলো।
জাফরানে রাঙানো ভাতের ওপর ছড়ানো কাজুবাদাম, কিশমিশ, আমন্ড বাদাম, মাখনা (ফক্স নাট) ও খোয়া এবং উপরে সামান্য ভার্ক (সিলভার লিফ) ছিটানো।
জাফরান আর মশলার গন্ধ মিশে একাকার, সেইসঙ্গে ঘিয়ে ভাজা কাজুবাদাম ও আমন্ডের একটা নাটি ফ্লেভারও পাওয়া যাচ্ছিল। তবে এই ডেজার্টের মধ্যে আরও আছে পরিমিত মশলা মাখানো কিন্তু হালকা মিষ্টি মাংসের টুকরো।
শেফ কুরেশি বললেন, 'এটা হলো মুতাঞ্জন। একসময় বকরি ঈদে ভোজনবিলাসী, সমঝদারদের খাওয়ার টেবিলে এই আইটেম ছিল চাই-ই চাই।'
বর্তমানে সব অঞ্চলে এই মিষ্টান্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও, কেউ যদি একবার এর স্বাদ নিতে পারে তাহলে খোঁজার প্রচেষ্টা স্বার্থক হবে, কারণ মুতাঞ্জন কোনো সাধারণ ডেজার্ট নয়।
'মুতাঞ্জন' শব্দটি এসেছে পারসো-আরবীয় শব্দ 'মুতাজ্জান' থেকে, যার অর্থ 'প্যানে ভাজা'। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মুতাঞ্জন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা খাবার। তবে মধ্যযুগীর আরব রন্ধনশালার মুতাজ্জান নামক খাবারের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের চাল-মাংস মেশানো চিনিযুক্ত খাবার মুতাঞ্জনের মিল খুব কমই আছে।
উদাহরণস্বরূপ, খাবারটির একটা ধরন হলো: তিলের তেলে ভাজা পালংশাক এবং এতে রসুন, জিরা, শুকনো ধনিয়া এবং দারচিনি দেওয়া হয়। আবার আরেকটা ধরন হলো, সেদ্ধ ডিম আস্ত ভেজে লবণ-মশলার মিশ্রণে গড়িয়ে নেওয়া একটি থালা যা প্রথমে পুরো ভাজা হয় এবং মশলা ও লবণের মিশ্রণে গড়িয়ে নেওয়া নয়। অন্যদিকে, পারস্যের সাফাভি বংশের শাহ আব্বাস দ্য গ্রেট-এর প্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচিত ১৬ শতকের পার্সিয়ান আইটেম 'মুতাঞ্জন'-এ অল্প আঁচে রান্না করা মাংস ব্যবহৃত হতো।
'কাদিম লক্ষ্ণৌ কি আখিরি বাহার' বইয়ে লেখক মির্জা জাফর হুসাইন লিখেছেন, তিনি মনে করেন লক্ষ্ণৌ এই পৃথিবীকে ১৩টি উপহার দিয়েছে, যার মধ্যে মুতাঞ্জন একটি।
ইতিহাসবিদরাও বর্ণনা করেছেন কীভাবে নবাব পরিবারের খাবারের টেবিলে কিংবা নবাব বাড়ি থেকে অন্য লোকেদের বাড়িতে পাঠানো খাবারের তালিকায় সবসময়ই মুতাঞ্জন থাকত।
কিন্তু খুব সম্ভব মোগল বাদশাহদের রাজকীয় রন্ধনশালা থেকেই এই সুস্বাদু খাবারটি নবাবদের ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে এবং তাদের খাবার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে।
১৬ শতকে মোগল সম্রাট আকবরের গ্র্যান্ড উজির আবুল ফজল তার লেখায় রাজদরবারের খাবার টেবিলে অন্যান্য আইটেমের সঙ্গে মুতাঞ্জনের কথাও উল্লেখ করেছেন।
১৭ শতকের মোগল পাণ্ডুলিপি 'নুসখা-ই-শাহজাহানি' (শাহজাহানের রেসিপি)-এর একটি 'ট্রান্সক্রিয়েশন', 'দ্য মোগল ফিস্ট' বইয়ের লেখক ও ইতিহাসবিদ সালমা হুসাইন বলেছেন, এ বইয়েও মোগলদের রাজকীয় রন্ধনশালা থেকে উঠে আসা মুতাঞ্জন পোলাওয়ের রেসিপি আছে।
১৪ শতকের আরব ইতিহাসবিদ শিহাবুদ্দিন-আল উমারি তার বইয়ে সুলতান মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের শাসনামলে ভারতের চিত্র বর্ণনা করেছেন। তিনি ভারতের বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন খাবারের মধ্যে মুতাঞ্জনের নামও উল্লেখ করেছেন, যে খাবার শুধু রাজপরিবারের বা অভিজাতদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল না, বরং সাধারণ মানুষও এটি খেতে খুবই পছন্দ করত।
আবার কারো কারো ধারণা, আরব অথবা পার্সিয়ান খাদ্যভাণ্ডার থেকে মুতাঞ্জনের উৎপত্তি; যার মধ্যে চিনি, চাল এবং মাংসের সমন্বয় ঘটেছে। আল ওয়ারাকের দশম শতাব্দীর বই 'অ্যানালস অব দ্য খলিফাস' কিচেন'-এ দুধ দিয়ে চাল ও মশলাযুক্ত মাংস দিয়ে রান্না এবং উপরে মধু ছড়িয়ে দেওয়া একটি আইটেমের কথা উল্লেখ আছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুতাঞ্জন পোলাও দেখে পার্সিয়ান মোরাসা পোলাও অথবা 'জুয়েলড রাইস' এর কথা মনে পড়ে--চালের সঙ্গে মুরগির বুকের মাংসের টুকরো মিশিয়ে রান্না করা এ খাবারে দেওয়া হয় বারবেরি, পেস্তা বাদাম, কিশমিশ আর কমলার খোসা।
ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ জিনিসের মতো মুতাঞ্জনের উৎপত্তি সম্পর্কেও একক কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটা যে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বিনিময়ের তারল্য প্রকাশ করে তা-ই নয়, একইসঙ্গে খাবারের বিবর্তনের এবং যুগে যুগে এক অঞ্চল থেকে খাবারের সংস্কৃতি অন্যত্র চলে আসার যে জটিল প্রক্রিয়া, সেটিও প্রকাশ করে। তবে দেশি-বিদেশি অসংখ্য ধারার প্রভাবে এসেও এবং সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও, ভারতীয় উপমহাদেশের মুতাঞ্জন পোলাও হিসেবেই একটি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। আর মুতাঞ্জন রান্না করারও কোনো একক রেসিপি নেই। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রামপুরের মুতাঞ্জনের কথাই ধরা যাক।
লেখক তারানা হুসাইন খান তার 'ডেগ টু দস্তরখান' বইয়ে একটি মিষ্টান্নের কথা উল্লেখ করেছেন, মিষ্টি ভাতের সঙ্গে গুলাব জামুন ও মিটবল মেশানো থাকে তাতে। তিনি লিখেছেন, 'এই রেসিপিতে ভাতের চারগুণ বেশি চিনি দিতে হয়।' তারানা হুসাইন খান মনে করেন, আউধি পাচকদের মাধ্যমে রাজপরিবারের রান্নাঘরে মুতাঞ্জন পোলাওয়ের আগমন। কিন্তু রামপুরের রয়্যাল কিচেনে বড় সাইজের মাংসের টুকরোর বদলে মিটবল দিয়ে এই খাবারটি রান্না করে এতে স্বকীয়তা নিয়ে আসা হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য মুতাঞ্জন একটি বিশেষ আইটেম, যার প্রতি স্তরে স্তরে মিশে আছে সংস্কৃতির আবেগ ও স্মৃতি।
হুসাইন বলেন, 'দেশের কিছু অংশে, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর অঞ্চলে একসময় রেওয়াজ ছিল, নতুন বউ যখন নিজের বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেবে, তখন বিরাট এক হাঁড়ি মুতাঞ্জন সঙ্গে পাঠাতে হবে। মিষ্টি ও নোনতা স্বাদের এই খাবার, সাথে লেবুর একটু টক স্বাদ সবমিলিয়ে যেন এই অনুষ্ঠানের মিশ্র আবেগকেই তুলে ধরে।'
এদিকে সীমান্তের ওপারে, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও মুতাঞ্জন কোনো সাধারণ ডেজার্ট নয়। 'আমি শুধু বিয়েবাড়িতে বা ধর্মীয় উৎসবে বা লঙ্গরে (বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয় যেখানে) এই খাবার পরিবেশন করতে দেখেছি। এটা অবশ্যই একটা বিশেষ খাবারের আইটেম,' বলেন পাকিস্তানি ফুড ব্লগার ফাতিমা নাসিম। তবে তিনি জানান, পাকিস্তানে মুতাঞ্জন পোলাওয়ে কোনো মাংস দেওয়া হয় না, অন্তত বর্তমানকালে যে রেসিপিতে রান্না করা হয় তাতে মাংসের ব্যবহার নেই।
তার বদলে মুতাঞ্জন পোলাওকে সাজানো হয় রংবেরঙের উপকরণ দিয়ে, প্লেটের মধ্যেই এই খাবারটি যেন এক বর্ণিল উৎসব! সিরাপে ভেজানো পোলাও ভাতের একটা লেয়ার দেওয়া হয়, যার সঙ্গে আবার মেশানো হয় রঙিন পোলাও ভাত, আর থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাদাম, ড্রাইফ্রুট, টুটি-ফ্রুটি, চেরি ও ভাজা নারকেল মিশিয়ে তৈরি ছোট চমচম। কেউ কেউ আবার মুতাঞ্জন পোলাওয়ের উপর সেদ্ধ ডিম দিয়েও সাজিয়ে থাকেন।
বর্তমান সময়ে সুস্বাদু মুতাঞ্জন পোলাওয়ের সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। প্রায়ই এই খাবারটিকে জর্দা (মিষ্টি, হলদে-জাফরানরঙা ভাত) কিংবা অন্যান্য মিষ্টি রাইস ডিশের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। তবে সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, কিছু মানুষ এখনো মুতাঞ্জন তৈরি করতে জানেন। হুসাইন অবশ্য দিল্লির পুরানা দুর্গের কাছে অবস্থিত বাবু শাহি বাবুর্চির ভাটিয়ারখানায় অর্ডার করে খাওয়াই বেশি পছন্দ করেন, যেখানে অনুরোধের প্রেক্ষিতে হাফিজ মিয়া নামের এক প্রসিদ্ধ বাবুর্চি মুখরোচক, সুগন্ধি মুতাঞ্জন রান্না করে পরিবেশন করেন।