সাপে কাটার সংখ্যা কমলেও কেন আগের চেয়ে বেশি মানুষ সর্পদংশনে মারা যাচ্ছেন?
নজরুল ইসলাম সাপের খেলা দেখান। জালে আটকানো সাপটাকে দেখে তিনি মনে করেছিলেন বাচ্চা অজগর।
কিন্তু সাপটা ছিল চন্দ্রবোড়া। গায়ের গোল গোল ছাপগুলো নির্বিষ অজগরের মতোই, নজরুল সেখানেই ভুল ঠাওরালেন। আশপাশে জড়ো হওয়া মানুষজন তাকে সাপটা ধরতে বলল। সাপুড়ে মানুষ নজরুল অজগর ভেবে চন্দ্রবোড়া ধরলেন।
এ ঘটনা ফরিদপুরের চর ভদ্রাসনের। সাপ নিয়ে ফেরার সময় কৌতূহলী মানুষজন প্রাণীটিকে দেখতে চাইল। ওই সময়ই হাতের আঙুলের ডগায় ছোবল হানল ওটি। নজরুল পাত্তা দিলেন না, কারণ তিনি জানেন ওটা নেহায়েত একটা অজগরের বাচ্চা।
একটু পরই চোখের দৃষ্টি কমে এল, নজরুল অস্থির হয়ে উঠলেন। ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, বিষধর সাপের কামড় খেয়েছেন তিনি। ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে নেওয়া হলো তাকে।
কিন্তু হাসপাতালটিতে সাপের কোনো অ্যান্টিভেনম (বিষ প্রতিষেধক) নেই। তাই নজরুলের পরিবার হাজারের ওপর টাকা খরচ করে বাইরে থেকে প্রতিষেধক কেনেন।
তারপরও সেখানে অবস্থা খারাপ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় নজরুল মারা যান। তার পরিবারের কাঁধে পড়ে এক লাখ টাকার বেশি চিকিৎসা খরচ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (এনসিডিসি) সর্বশেষ জরিপ (১৮ জুন, ২০২৩) অনুযায়ী, ২০২১–২২ সালে দেশে প্রতি বছর প্রায় চার লাখ তিন হাজার মানুষকে সাপে কামড়ায়। এদের মধ্যে সাত হাজার ৫১১ জন মারা যান।
কিন্তু ২০২০ সালে সাপের কামড়ের শিকার হয়েছিলেন ছয় লাখ মানুষ। ওই বছর মারা যান ছয় হাজার জন। ২০১৭ সালে মার্কিন একটি জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় নয় লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায়, যাদের মধ্যে ছয় হাজার জন মারা যান।
অর্থাৎ এনসিডিসি'র সর্বশেষ তথ্য বলছে, আগের তুলনায় এখন কম সংখ্যক মানুষকে সাপে কামড়াচ্ছে, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি হচ্ছে।
কেন এমনটা হচ্ছে?
সাপের কামড়ে মৃত্যু বাড়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা বলছেন সর্প বিশেষজ্ঞরা।
ভারত থেকে আনা অ্যান্টিভেনমগুলো বাংলাদেশে সাপের কামড়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ কার্যকরী কি না তার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। আবার হাসপাতালগুলোতে যে অ্যান্টিভেনম রয়েছে, সেগুলোর কতগুলো প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে— তাও উল্লেখ করেছেন তারা।
নগরায়ন বাড়ার কারণে সাপের বাসস্থান ঝুঁকিতে পড়েছে। ফলে সাপ মানুষের আবাসস্থলের কাছাকাছি চলে আসছে। এছাড়া বরেন্দ্র ও চরাঞ্চলে একই জমির ওপর বারবার অতিরিক্ত হারে ফসল ফলানো, সাপের কামড়ের পর হাসপাতালে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা না নিয়ে সাপুড়ের কাছে ধর্না দেওয়া — ইত্যাদিও মৃত্যুহার বাড়ার পেছনে অবদান রাখছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর ম্যানেজমেনট অভ স্নেকবাইট-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাপের প্রায় ১০০ প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি বিষধর। এগুলোর ১৬টি সামুদ্রিক সাপ, তিনটি গোখরা প্রজাতি, শঙ্খিনীর পাঁচটি প্রজাতি, দুই ধরনের প্রবাল সাপ, ছয় ধরনের গ্রিন পিট ভাইপার এবং একটি রাসেল ভাইপার তথা চন্দ্রবোড়া
পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই বিষধর সাপের অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। ভারতের ৩০০'র বেশি প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৬০টি বিষধর। প্রতি বছর ৬৪ হাজারের বেশি ভারতীয় সাপের কামড়ে মারা যান যা বিশ্বে বার্ষিক সর্পদংশনে মৃত্যুসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি।
তবে অনেকগুলো দেশে যথেষ্ট সংখ্যায় বিষধর সাপের প্রজাতি থাকলেও সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ১৭২ প্রজাতির সাপের মধ্যে ১০০ প্রজাতিই বিষধর। তা সত্ত্বেও দেশটিতে প্রতি বছর কেবল তিন হাজার জন সাপের কামড়ে মারা যান।
তবে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার সময় সাপের আগ্রাসী আচরণের ভিন্নতা, মানববসতির ঘনত্ব ও অন্যান্য বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়। বাংলাদেশে সাপ-মানুষের সংঘাতের হার বেশি, সাপে কাটা প্রতিরোধ নিয়ে মানুষের মধ্যে জ্ঞান কম। যেমন, আমাদের কৃষকেরা মাঠে কাজ করা সময় জুতা পরেন না, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞানও নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রাম বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. রোবেদ আমিন বলেন, 'আমাদের অ্যান্টিভেনম আছে, কিন্তু সেগুলো আমাদের নিজস্ব নয় (ভারত থেকে আমদানিকৃত)। এসব অ্যান্টিভেনম আমাদের স্থানীয় সাপের বিষের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকরী তা নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই। সব দেশেরই নিজস্ব অ্যান্টিভেনম তৈরি করা উচিত।'
বাংলাদেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমসমূহ পলিভ্যালেন্ট। এগুলো শঙ্খিনী, গোখরা, চন্দ্রবোড়াসহ চার ধরনের বিষধর সাপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ভারত থেকে দেশে কেবল ইনসেপ্টা এ অ্যান্টিভেনম আমদানি করে।
'আমাদের শঙ্খিনী আর ভারতের শঙ্খিনী একই নয়। তাই ভারতের অ্যান্টিভেনমসমূহ এখানকার সাপের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়নি। এখানকার শঙ্খিনীর বিরুদ্ধে এসব প্রতিষেধক কাজ করবে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করার পরও মানুষ মারা যাচ্ছেন,' বলেন ডা. রোবেদ।
বেশি মৃত্যু ঘটার এটা একটা কারণ হতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তেমনটা মনে করা যেতে পারে। তবে এগুলো সবকিছু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে হবে।'
তবে তিনি আরও জানান, দেশে আগের চেয়ে এখন সাপের কামড়ে মৃত্যুর খবর বেশি মানুষের নজরে আসছে। তাই সাম্প্রতিক মৃত্যুর বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক।
ডা. রোবেদ বলেন, আগের পরিসংখ্যানের তথ্য অসম্পূর্ণ ছিল, কারণ সেগুলো কেবল গ্রামভিত্তিক উপাত্ত ছিল। সর্বশেষ জরিপটি গুচ্ছভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়েছে।
সর্প বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদের সাপ নিয়ে অভিজ্ঞতা কয়েক দশকের। তিনি জানান, প্রতি বছরের সাপের কামড়ের হিসাব রাখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তিনি বলেন, ২০২২ সালে এক হাজার ৪৫৭ জন সাপে কাটার চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সংখ্যা ২০২১ সালে ৮৬৪, ২০২০ সালে ৭৫৫ ও ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৬১২।
হাসপাতাল নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায় সাপে কাটা মানুষের হাসপাতালে আসার সংখ্যা বেড়েছে নাকি আদতেই সাপে কাটার সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এছাড়া গত এক দশকে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়েছে। এসব অ্যান্টিভেনম রোগীরা বিনামূল্যেই পান। তবে এগুলোর মেয়াদ শেষ হয় পাঁচ বছরের মধ্যে।
'চিকিৎসকেরা এগুলো খুব একটা ব্যবহার করেন না। কেন? উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকরা নতুন, তাদের এগুলো ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেই। তারা আশঙ্কা করেন, অ্যান্টিভেনম ব্যবহারের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রোগী অ্যালার্জির শিকার হবেন। আর তার চিকিৎসার জন্য এসব স্থানীয় হাসপাতালে আইসিউ'র মতো পর্যাপ্ত বিভিন্ন সুবিধা নেই।
'রোগীরা হাসপাতালে যখন পৌঁছান, ততক্ষণে তারা শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন জটিলতা প্রদর্শন শুরু করেন। কারণ তারা হাসপাতালে আসার সিদ্ধান্ত নিতে প্রায়শই দেরি করে ফেলেন। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে আইসিউ'র ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়। তাই তাদেরকে বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসকেরা,' সাঈদ বলেন।
ডা. রোবেদ আমিন জানান, সরকারের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে তারা ২০২০-২১ সালে ৫০ হাজার অ্যান্টিভেনম ভায়াল সরবরাহ করেছেন।
'উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো এসব প্রতিষেধক ব্যবহার না করলে সেগুলো নষ্ট হবে। অনেক অ্যান্টিভেনম ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। যদিও মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত এগুলো ব্যবহার করা যায়, কিন্তু চিকিৎসকেরা করেন না। ফলে অনেকসময় তারা বলেন, তাদের কাছে অ্যান্টিভেনম নেই,' ডা. আমিন বলেন।
তিনি আরও জানান, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে তারা এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে চাচ্ছেন।
'আমরা অনলাইন ও অফলাইনে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিই চিকিৎসকদের বোঝানোর জন্য। এ বিষয়টি মোকাবিলায় অনেক উপজেলা হাসপাতালে আলাদা দল গঠন করা হয়েছে। আবার অনেক হাসপাতাল কিছুই করছে না। আমাদের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হতে সময় লাগবে, কিন্তু হবে,' বলেন ডা. রোবেদ আমিন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আগে ইনসেপ্টার অ্যান্টিভেনমের দাম পড়ত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এখন প্রতি ভায়ালের দাম বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকা।
সাপের দংশনের শিকার কাউকে অ্যান্টিভেনম দিতে হলে মোট দশটি ভায়ালের দরকার হয়। তাই সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না পাওয়া গেলে বাইরের ফার্মেসি থেকে কেনার জন্য সবমিলিয়ে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয় রোগীপক্ষকে।
আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাপের কামড়ের শিকার হন কৃষক, সাপুড়ে, গ্রামের মানুষ অর্থাৎ দরিদ্ররা। আবু সাঈদ বলেন, 'আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সাপেকাটা রোগী চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ করেন। ফরিদপুরের ওই রোগী (নজরুল) মৃত্যুর আগপর্যন্ত এক লাখের বেশি টাকা খরচ করেছিলেন।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে কথা বলা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যান্টিভেনম ব্যবসায় একটি প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধ করা গেলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটতে পারে।
পাঁচ বছরের অ্যান্টিভেনম একবারে কিনে না ফেলে প্রতি বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রতিষেধক কেনার পরামর্শ দিয়েছেন আবু সাঈদ। এতে করে সর্বশেষ উৎপাদিত অ্যান্টিভেনম হাসপাতালগুলোর মজুতে থাকবে।
'সাপের কামড়ে মৃত্যু বাড়ার আরেকটি কারণ হলো, নগরায়ন ও উন্নয়নের নামে মানুষ কৃষিজমি, পুকুর, জলাশয় ইত্যাদি ভরাট করে ফেলছে। ফলে সাপ এর প্রাকৃতিক বাসস্থান হারিয়ে ফেলছে এবং মানুষের আবাসস্থলে— বিশেষ করে শরৎকালে— চলে আসছে। এতে সাপের কামড়ের হার বাড়ছে,' বলেন আবু সাঈদ।
'এছাড়া, বরেন্দ্র অঞ্চলে এক মৌসুমে একটি ফসল ফলানো হতো। এখন তার স্থলে তিন ফসল ফলানো হচ্ছে। ফলে সাপের বাসস্থান ছোট হয়ে আসছে। একইভাবে চরাঞ্চলেও এখন আর জমি অনাবাদি পড়ে থাকে না। এসবের কারণে সাপে কাটার হার বাড়ছে,' তিনি আরও বলেন।